ভূমিকাঃ প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম উন্মেষ সাধিত হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইরনেস্ট বারকার বলেন, গ্রিসীয় যুক্তিবাদের শান্ত পরিবেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার প্রথম সূত্রপাত। ইউরােপে যে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটেছে এবং বর্তমান দুনিয়া যে রাষ্ট্রচিন্তার উত্তরাধিকারী তা মূলত উক্ত নগর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রচিন্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। 

গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যঃ নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত হওয়া ব্যতীত প্রাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাস কল্পনাতীত। নিম্নে গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যসমূহ আলােচনা করা হলােঃ

(১) যুক্তিবােধঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় যুক্তিবােধের স্থান ছিল সর্বোচ্চ। গ্রিকগণ বিশ্বাস করত যে, সমগ্র বিশ্বজগৎ এক প্রকার সৃজনশীল যুক্তিবােধ থেকে উৎসারিত হয়েছে। তারা প্রকৃতিকে ভীতিপ্রদ ও প্রতিশােধমূলক কোনাে অকল্যাণকর বস্তু বলে মনে করেননি। বরং প্রকৃতিকে তারা কল্যাণকর বলে মনে করেছেন- যার অন্তর্নিহিত মৌল উপাদান হলাে যুক্তি। ধর্ম, ঈশ্বর, প্রকৃতি সবকিছুর মাঝেই গ্রিকগণ যুক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছে। 

পড়ুনঃ রোমান সাম্রাজ্য পতনের কারণসমূহ কী কী?

(২) রাজনীতি ও নৈতিকতার সম্পৃক্ততাঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অপর একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এতে রাজনীতি ও ধর্মনীতি তথা নৈতিকতার একাত্মতা ঘটেছে। গ্রিক যুগে রাজনীতি ও ধর্মনীতির মধ্যে কোনরূপ সুনির্দিষ্ট সীমারেখা টানা হতাে না। গ্রিক দার্শনিকদের মতে, জনকল্যাণের জন্য যে সংগঠনের প্রয়ােজন সেটাই রাষ্ট্র। তারা নৈতিকতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন। 

(৩) ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের একাত্মতাঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন বিরােধ ছিল না। ব্যক্তির নৈতিক উন্নতি ও রাষ্ট্রের নৈতিক উন্নতির মধ্যে কোনাে পার্থক্য করা হতাে না। রাষ্ট্রসত্তার মধ্যেই ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণতা। ব্যক্তির স্বার্থকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে জড়িত করে গ্রিক দার্শনিকগণ ব্যক্তি অপেক্ষা রাষ্ট্রকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র বলে কোন কথা তারা কল্পনাও করতে পারতেন না। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পােষণ করাকে গ্রিকগণ এক উন্নততর সত্তার প্রতি আনুগত্য পােষণ বলে মনে করতেন। 

(৪) অবাধ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বঃ গ্রিকগণ মনে করতেন যে, কেবলমাত্র রাষ্ট্রের মাধ্যমেই মানুষের জীবনের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভবপর। কাজেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সীমিত করার কোনাে প্রয়ােজন তারা অনুভব করেননি। মানুষের কল্যাণে নিয়ােজিত যেকোনাে কর্মকাণ্ড সম্পাদন করার অধিকার রাষ্ট্রেরই ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্র যেহেতু এক ও অভিন্ন কাজেই সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্র বলে কিছুই ছিল না। 

(৫) আইনের প্রাধান্যঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় আইনের প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল। হােমারিক রাজতন্ত্রের যুগে আইন ও ধর্মের মধ্যে কোনাে পার্থক্য ছিল না। ধর্মই ছিল সবরকম আইন ও ক্ষমতার উৎস। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজতন্ত্রের স্থলে অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। আইন তখন অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে পড়ে এবং তাতে মানবিক উপাদানের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তা সত্ত্বেও আইন মূলত যুক্তিসঙ্গতই থেকে যায়। সরকারকে আইনের অধীন করা হয় এবং নাগরিকগণের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। 

(৬) স্বয়ংসম্পূর্ণতাঃ গ্রিক নগররাষ্ট্রের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলাে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হলাে- সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়ােজন তার সবকিছুই ওই নগর রাষ্ট্রের আওতাধীন ছিল। একারণেই এরিস্টটল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্র কতগুলাে পরিবার ও জনপদের এমন একটি সমন্বয় যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুখী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা গড়ে তােলা। 

(৭) স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার আরাে একটি বৈশিষ্ট্য হলাে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। গ্রিকদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতার স্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় গণতন্ত্রের ক্রমবিকাশ প্রশংসনীয়। রাষ্ট্রের শাসনের ব্যাপারে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হওয়ার ফলে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। নগর রাষ্ট্রে এথেন্সের জনগণ তাদের সংবিধানকেই বলত গণতন্ত্র।

 

(৮) কমনওয়েলথঃ প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্র বা রাজ্য বলতে শুধুমাত্র একটি ভূ-খন্ডকে বুঝানাে হতাে না। বরং রাষ্ট্র বলতে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত একদল জনসমষ্টিকে বুঝানাে হতাে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হচ্ছে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপনকারী জনসমষ্টির কমনওয়েলথ। প্রকৃত অর্থে তখন রাষ্ট্রগুলাে ছিল জনসাধারণের সম্পত্তি। গ্রীক রাষ্ট্র চিন্তায় এটি খুব ভালোভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, রাষ্ট্র হচ্ছে নাগরিক সাধারণের সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। 

(৯) প্রাকৃতিক দর্শনঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা প্রাকৃতিক আইননির্ভর ছিল। গ্রীক রাষ্ট্রচিন্তা অনুযায়ী মানুষ প্রকৃতির আজ্ঞাবাহী হবে এবং প্রকৃতির নিয়ম মেনে বসবাস ও জীবনধারণ করবে। প্রাকৃতিক আইনের নিয়ম অনুযায়ী মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে জগতে বসবাস করে এবং মানুষের সর্বোচ্চ উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়ােজন। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা অনুযায়ী মানুষ যেমন প্রকৃতির দান, তেমনি রাষ্ট্রও হচ্ছে প্রকৃতির সন্তান। 

(১০) শ্রেণীসংঘাতঃ গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শ্রেণীসংঘাতের আলােচনা। গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলােতে সংখ্যালঘু ধনী আর সংখ্যাগুরু দরিদ্রের মধ্যে সংঘাত ছিল। অভিজাতরা নগররাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী দাসদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনসহ গরিব সাধারণ মানুষের ওপর শােষণের নীতি অব্যাহত রাখত। এ নিপীড়ন ও শােষণ রাষ্ট্রচিন্তাবিদের মনকে আলােড়িত করেছিল। এ কারণেই প্লেটো ও এরিস্টটল উভয়েই তাদের লেখনীতে উক্ত বিষয়ের আলােকপাত করেন। 

পড়ুনঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক সংক্ষেপে আলােচনা কর

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলাের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই যে, আধুনিক যুগের রাষ্ট্রচিন্তা প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রচিন্তার নিকট অনেকাংশে ঋণী। কেননা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় যা কিছু আমরা প্রত্যক্ষ করি তা অনেকাংশে গ্রিক চিন্তাধারারই ফলস্বরূপ। গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় যেসব মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে।