সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, প্রাচীন গ্রিসে, বিশেষ করে ধুপদি যুগের গ্রিসের সমাজ ও অর্থনীতিতে ক্রীতদাসপ্রথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। এজন্য কোনাে কোনাে পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক প্রাচীন গ্রিসের সমাজকে ‘ক্রীতদাস সমাজ’ (Slave Society) বলতে চান। আবার অন্য একদল ঐতিহাসিক গ্রিসে দাসপ্রথার অস্তিত্ব স্বীকার করলেও এই প্রথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান না বা প্রাচীন গ্রিসের সমাজকে ক্রীতদাস সমাজ’ বলে চিহ্নিত করতেও চান না। এই পরস্পর-বিরােধী অভিমতের ফলে এ বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
[1] প্রাচীন গ্রিসের সমাজকে ‘ক্রীতদাস সমাজ’ বলার পক্ষে অভিমত
-
প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের অভিমত: প্রাচীন গ্রিসের পণ্ডিত প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের লেখাতেও সেখানকার ক্রীতদাসপ্রথাকে সমর্থন এবং সেখানকার সমাজে দাসদের ভূমিকার গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। কারণ, গ্রিকরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করত বলে নিজেদের যাবতীয় কাজ ক্রীতদাসদের দিয়ে করাত।
-
জর্জ টমসনের অভিমত: মার্কসবাদী ঐতিহাসিক জর্জ টমসন মনে করেন যে, যতক্ষণ ক্রীতদাসদের ওপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখা গিয়েছিল, ততক্ষণ দাসশ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা এথেন্সের মানুষের কাছে বিপজ্জনক বা অসুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি। তার মতে, প্রাচীন গ্রিকসমাজ সম্পূর্ণরূপে ক্রীতদাসপ্রথার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
-
পেরি অ্যান্ডারসনের অভিমত: মার্কসবাদী ঐতিহাসিক পেরি অ্যান্ডারসন বলেছেন যে, প্রাচীন গ্রিক নগর- রাষ্ট্রগুলিই সর্বপ্রথম ক্রীতদাসপ্রথাকে একটি সর্বাত্মক চরিত্র দান করে এবং সুপরিকল্পিতভাবে একে উৎপাদনের কাজে নিয়ােজিত করে। তার মতে, গ্রিসের উৎপাদনের কাজে স্বাধীন কৃষক, কারিগর ও ভাড়াটে চাষিরা নিযুক্ত থাকলেও উৎপাদনের কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ক্রীতদাসরা।
[2] প্রাচীন গ্রিসের সমাজকে ‘ক্রীতদাস সমাজ বলার বিপক্ষে অভিমত
-
উইলিয়াম ওয়েস্টারম্যান-এর অভিমত: উইলিয়াম ওয়েস্টারম্যান মনে করেন যে, প্রাচীন গ্রিসে কোনাে ধরনের সংস্কার এবং সংঘাত ছাড়াই স্বাধীন নাগরিক ও ক্রীতদাসরা একই কাজে পাশাপাশি নিযুক্ত হত। তাই একথা বলা যায় না যে, গ্রিক সমাজ ক্রীতদাসপ্রথার ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
-
ভিক্টর ইরেনবার্গ-এর অভিমত: ভিক্টর ইরেনবার্গ মনে করেন যে, প্রাচীন গ্রিসে ক্রীতদাস শ্রমের বিশেষ প্রয়োজন থাকলেও তা কখনােই গ্রিসের অর্থনৈতিক জীবনের মূলভিত্তি ছিল না।
-
জোনস-এর অভিমত: ঐতিহাসিক জোনস মনে করেন যে, প্রাচীন গ্রিসের ক্রীতদাসপ্রথা ছিল একটি দীর্ঘ প্রচলিত ব্যবস্থা এবং বেশিরভাগ মানুষ একে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিল। এথেন্সের স্বাধীন নাগরিক এবং ক্রীতদাসদের মধ্যেকার সম্পর্কে তিক্ততার পরিবর্তে বরং সহমর্মিতাই লক্ষ করা যেত বলে তিনি মনে করেন।
উপসংহার: প্রাচীন গ্রিকরা যে ক্রীতদাসপ্রথার মতাে একটি অমানবিক প্রথাকে টিকিয়ে রেখেছিল সে কথাও ঐতিহাসিকভাবে সত্য। একথাও সত্য যে, প্রাচীন গ্রিকদের সার্বিক উন্নতির পেছনে ক্রীতদাসদের অবদানকে অস্বীকার করাচলেনা। আর তাই প্রাচীন গ্রিসের সমাজকে ‘দাস সমাজ’ বলে অভিহিত করাকে একেবারে অযৌক্তিক মনে করা যায় না।
Leave a comment