ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের স্থান অর্থাৎ সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নারীদের মর্যাদা ও ভূমিকার বিষয়টি বেশ জটিল। আদিম পর্বে, কৃষিতে যখন লাঙ্গলের ব্যবহার রপ্ত হয়নি, তখন ভারতে কৃষিকাজ কেবল মেয়েরাই করত। নতুন নতুন কৃষিক্ষেত্র তৈরীর কাজে পুরুষের সহযোগী হিসেবে কাজ করত মেয়েরাই। কুমোরের চাকা ঘোরাত মেয়েরাই। এমনকি ঋগ্বেদের আর্য-অনার্য যুদ্ধের কালে ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দৈত্য লমুচির বাহিনীতেও মহিলা সেনার উপস্থিতি ছিল বলে উল্লেখ আছে।
কালক্রমে ভারতীয় সমাজে নারীজাতির গুরুত্ব ও মর্যাদা নিম্নগামী হতে থাকে। অনেকের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে সংঘ কেন্দ্রিক জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের ফলে এই পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। স্বয়ং বুদ্ধই নারীকে নিম্নপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করতে কুণ্ঠিত হননি। বৌদ্ধ সংঘের নিয়মানুসারে একজন শতবর্ষীয়া বৃদ্ধা ভিক্ষুণী একজন নাবালক ভ্রমণের চেয়ে মর্যাদায় নিচু বলে গণ্য হতেন। দিগম্বর জৈন গোষ্ঠীর মতে, নারীরা মোক্ষলাভের অধিকারিণী নন।
মৌর্য ও মৌর্য্যোত্তর যুগে ভারতীয় সমাজে নারীর স্থান সম্পর্কে আমাদের প্রধান উপাদানগুলি হল গ্রীক পর্যটকদের বিবরণ, অর্থশাস্ত্র, অশোকের কিছু লেখ, পাণিনি ও পতঞ্জলীর ব্যাকরণ গ্রন্থ, রামায়ণ-মহাভারত, বৌদ্ধ ও সংস্কৃত সাহিত্য এবং স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থমালা।
প্রাক মৌর্য যুগে সামরিক বৃত্তিতে নারীদের যোগদানের বিষয়টি মৌর্য যুগে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সশস্ত্র নারী রক্ষী বাহিনীর কথা বলেছেন। অর্থশাস্ত্রেও নারী রক্ষী বাহিনীর উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষের কোন কোন অঞ্চলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। মহাভারতে বাহীক, মদ্রক প্রভৃতি গোষ্ঠীতে মাতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের কথা আছে। মেগাস্থিনিস পাণ্ড্যরাজ্যকে নারীশাসিত রাজ্য বলেছেন। এক নারীর একাধিক পতি গ্রহণের রীতি নারীর অগ্রণী সামাজিক কর্তৃত্বের নিদর্শন। দ্রৌপদী, জটিলা প্রমুখ নারীর বহুপতি গ্রহণের দৃষ্টান্ত মহাভারতে আছে। আজও ভারতের নানাস্থানে বহুপতীক সমাজের অস্তিত্ব আছে। কেরলে নায়ারদের মধ্যে এই প্রথা লক্ষণীয়। কেরলে ‘মারুমাক্কাট্টিয়ম’ প্রথা মাতৃকেন্দ্রিক উত্তরাধিকারের সাক্ষ্য দেয়। অর্থশাস্ত্রে নারীর গার্হস্থ্য জীবনের বাইরে পেশাদারী জীবন সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। নারী রক্ষী বাহিনীর পাশাপাশি গুপ্তচর হিসেবে ‘গণিকা’দের বিশেষ গুরুত্বের কথা কৌটিল্য স্বীকার করেছেন। অশোকের অনুশাসনে স্ত্রী অধ্যক্ষ মহামাত্র’ নামক উচ্চপদস্থ আধিকারিক নিয়োগের উল্লেখ মৌর্য যুগের প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের স্বীকৃতি বলে মনে করা যায়। অশোকের দ্বিতীয় স্ত্রী কারুবাকী (বা চারুবাকী)-কে একস্থানে রাজপুত্র তীবর এর মাতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যাকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের উদারতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
অর্থশাস্ত্রের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, মৌর্যযুগে উচ্চশ্রেণীর নারীদের স্বাধীনতা আংশিকভাবে দেশাচার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। স্মৃতিশাস্ত্রের তুলনায় অর্থশাস্ত্র অনেকটাই উদার। তবে এখানেও নারীর স্বাধীন গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নিম্নশ্রেণীর তুলনায় উচ্চশ্রেণীর মহিলাদের উপর সামাজিক বিধিনিষেধের কঠোরতা বেশী ছিল। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাজ রমণীরা অন্তঃপুরে বিশেষ নজরদারীর মধ্যে বসবাস করেন। পুরুষের সাথে নারীর মেলামেশা কোনভাবেই অবাধ ছিল না। উচ্চশ্রেণীর নারী অভিভাবকের সঙ্গ ছাড়া বাইরে বেরোতেন না। এমনকি ধর্মকর্মেও যেতে পারতেন না।
মৌর্যযুগে নারী স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হলেও সার্বিক ছিল না। বয়স্থা নারী পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই ঘরের বাইরে যেতে বা ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন। অশোকের দ্বিতীয় পত্নী কারুবাকির ধর্মীয় দানের উল্লেখ অশোকের লেখতেই আছে। কন্যা সংঘমিত্রা সম্রাটের পুত্র মহেন্দ্রর সাথে সিংহলে ধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন। নাসিক লেখতে সাতবাহন বংশীর বিধরা রাণী গৌতমী বলশ্রীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের উল্লেখ আছে। স্মৃতিশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ‘নারী সম্মানের যোগ্যা, কিন্তু স্বাধীনতার যোগ্যা নয়’। বাস্তবে এমন কঠোরতা মৌর্যযুগে ছিল না। সাতবাহন বংশীয়া রাণী নায়নিকা তাঁর নাবালক পুত্রের অভিভাবক হিসেবে রাজ্য শাসন করেছিলেন। মৌর্যযুগের অব্যবহিত পরের ভারহৃত ও সাঁচীর নারীরা অংশ ভাস্কর্যে দেখা যায় যে, ধনী মহিলারা কটি দেশ পর্যন্ত উন্মুক্ত অবস্থায় বারান্দা থেকে শোভাযাত্রা দেখছেন। কিংবা অতি স্বল্প বাস পরিধান করে পুরুষের সাথেই বোধিবৃক্ষ পুজায় নারীরা নিচ্ছেন। এগুলি সামাজিক জীবনে উদার লিঙ্গ-সম্পর্কের আভাস দেয়।
উচ্চবংশের নারীদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল। বৈদিক যুগে বেদের স্তোত্র রচনার কাজে সেকালের নারীদের অংশ নেওয়ার কথা আমরা আগেই জেনেছি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীদের দ্বারা গানের সংকলন ‘থেরিগাথা’ রচনাও প্রাচীন ভারতে নারীশিক্ষার অন্যতম দৃষ্টান্ত। মৌর্য যুগেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। সমকালীন সাহিত্যে দু’ধরনের শিক্ষিত নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়— ব্রহ্মবাদিনী এবং ‘সদ্যোদ্বাহ’। যে সকল নারী আজীবন বেদ অধ্যয়ন করতেন তাঁদের বলা হত ব্রহ্মবাদিনী। অন্যদিকে যাঁরা বিবাহের আগে পর্যন্ত বেদ অধ্যয়ন করতেন তাঁদের বলা হত সদ্যোদ্বাহ। পাণিনি বেদের বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়নরত ছাত্রীদের কথা বলেছেন। জৈন গ্রন্থে কৌশাম্বী রাজকন্যা জয়ন্তী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি অবিবাহিত থেকে আজীবন ধর্ম ও দর্শন চর্চা করেছিলেন। জয়ন্তী খোদ মহাবীরের সাথে দার্শনিক বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থসমূহে বহু মহিলার উল্লেখ আছে যাঁরা অবিবাহিত থেকে সারাজীবন শাস্ত্রচর্চা করেছিলেন। শাস্ত্রচর্চা ছাড়াও নৃত্যগীতে পারদর্শিনী নারীর উল্লেখ সমকালীন সাহিত্যে পাওয়া যায়। মহাভারতে দ্রৌপদীকে ‘পণ্ডিতা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পতঞ্জলী বর্শাধারী নারীদের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘শাক্তিকী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
মৌর্য্যোত্তর যুগে নারীদের সামাজিক অবস্থার অবনমন ঘটে। স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে, বিশেষত মনুস্মৃতিতে তার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। মনু নারীদের সম্পর্কে পরস্পর বিরোধ দু’ধরনের মন্তব্য পেশ করেছেন—একটি চরম স্তুতিমূলক এবং অন্যটি নিন্দামূলক। প্রাথমিকভাবে মনু নারীকুল সম্পর্কে অনেক আদর্শবাদী কথা বলেছেন। যেমন, বিচক্ষণ পিতা, ভ্রাতা এবং স্বামী যাঁরা নিজেদের মঙ্গল চান তাঁরা স্ত্রীজাতিকে সম্মান করেন। নারী সম্মানিত হলে দেবতারাও প্রীত হন। যেখানে নারীর সম্মান নষ্ট হয় সেখানে সকল প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ব্যর্থ হয়। সম্পত্তিতে নারীর অধিকার (স্ত্রীধন) মনু বৈধ বলে বিধান দিয়েছেন। নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা অনুচিত বলেই মনু মনে করতেন। বিধবাদের ক্ষেত্রে সতীপ্রথা মনু অনুমোদন করেন নি। উল্লেখ্য যে, সতীদাহের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় উনিশ শতকে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল মনুস্মৃতি। মনু লিখেছেন যে, স্বামীর চিতায় প্রাণ বিসর্জনের থেকে শুদ্ধ ও সংযত জীবন যাপনই নারীর কাছে বেশি কাম্য।
অন্যদিকে নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের যে কার্যকর বিধান মনুস্মৃতিতে দেওয়া হয়েছে, তাতে নারীকে সমাজের অবহেলিত অংশ হিসেবে দেখার প্রবণতা স্পষ্ট। মনু লিখেছেন, ‘ভারতীয় নারী চিরকালই অন্যের অধীন। শৈশবে নারী পিতামাতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বৈধব্যে পুত্রের অধীন’। মনুর বিধান অনুসারে স্বামী স্ত্রীকে শিশুর মত ভর্ৎসনা করতে এবং শাস্তি দিতে পারে। স্মৃতিশাস্ত্রের মতে, ভারতীয় নারী প্রবৃত্তিতাড়িত পশুর সমতুল্য। নারী লোভ-লালসার বশীভূত। তাই নারীকে কোন গোপন কথা বলা উচিত নয়। মনুস্মৃতির বিধান অনুসারে স্বামী যদি কুরূপ হয়, ইন্দ্রিয়ের দাস হয়, মদ্যপ হয়, অন্য নারীতে আসক্ত হয় তবুও পতিব্রতা স্ত্রী তাকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করবে। একপাক্ষিকভাবে স্ত্রীকে বর্জনের বিধানও মনু দিয়েছেন। যেমন—অসুস্থ বা মদ্যপ স্বামীকে যদি স্ত্রী অসম্মান করে তাহলে তিনমাসের জন্য তাকে পরিত্যাগ এবং অলংকারাদি থেকে বঞ্চিত করা যাবে। এছাড়া বন্ধ্যা স্ত্রীকে অষ্টম বৎসরে ত্যাগ করা যাবে। মৃতবৎসা স্ত্রীকে দশম বৎসরে এবং কেবল কন্যা সন্তানের জন্মদাত্রী স্ত্রীকে একাদশ বৎসরে ত্যাগ করা যাবে। তবে স্ত্রী স্বামীর কথার উপরে কথা বললে অর্থাৎ স্বামীর সাথে তর্ক করলে সেই স্ত্রীকে তাৎক্ষণিক ত্যাগ করা যাবে বলে মনু বিধান দিয়েছেন। মনুর বিধান ব্রাহ্মণ্য জাগরণের বেদ রূপে বন্দিত হত। স্বভাবতই সারাজীবন গ্লানি সহ্য করেই নারীকে সমাজে বাস করতে হত। মনু নারীর সতী হওয়াকে সমর্থন করেন নি। কিন্তু হিন্দু নারীর পুনর্বিবাহ তিনি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বলেই মত দিয়েছেন। তাই স্বামীর মৃত্যুর পরে নারীর আরো নির্মম ও দুঃখময় জীবনের সূচনা ঘটত।
এ. এল. ব্যাসামের মতে, প্রাচীন ভারতে নারীর প্রতি সমাজের মনোভাব ছিল পরস্পর বিরোধী। নারী একাধারে ছিল দেবী ও দাসী ; সতী ও গণিকা। আবার ধর্মীয় ও নীতিমূলক সমকালীন কবিতায় বলা হয়েছে যে, নারীর কামপরায়তনা অগ্নি সদৃশ, সর্বগ্রাসী। দণ্ডিনের দশকুমার চরিতে বলা হয়েছে যে, নারী কলহপরায়ণা ও বিরক্তি উৎপাদনে দক্ষ। পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীজাতির এহেন বিড়ম্বনা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। যৌক্তিকভাবে কাম্য না হলেও, এটাই ছিল বাস্তব চিত্র।
মৌর্যযুগে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার : স্ত্রী-ধন
প্রাচীন ভারতে সাধারণভাবে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকার করা হত না। ধর্মসূত্রগুলিতে বলা হয়েছে যে কন্যা প্রত্যক্ষভাবে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারবে না। তবে শাস্ত্রকারগণ নারীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে স্ত্রীধনের কথা বলেছেন। এই স্ত্রী-ধন বলতে বোঝায় তারা উপহারস্বরূপ যে সকল অলংকার, পোষাক ইত্যাদি লাভ করে সেগুলি তাদের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে।
অর্থশাস্ত্র, মনুস্মৃতি ও যাজ্ঞবল্ক স্মৃতি থেকে এই সময়কার স্ত্রী-ধনের বৈশিষ্ট্য জানা যায়। কৌটিল্য চার ধরনের স্ত্রী-ধনের কথা বলেছেন। এগুলি হল—(১) শুল্ক অর্থাৎ কন্যার জন্য পাত্রপক্ষ যে মূল্য ধরে দেয় এবং অলংকার ও অন্যান্য সামগ্রী। (২) অন্বাধেয় অর্থাৎ বিবাহের পরবর্তীকালে কন্যা বা বধু উপহার হিসেবে যা যা পায়। (৩) অধিবেদনিক অর্থাৎ বিবাহের পর পতিগৃহে যাত্রাকালে কন্যাকে যা যা দেওয়া হয়। (৪) বন্ধুদত্ত অর্থাৎ কন্যাকে তার বন্ধু বান্ধবের প্রদত্ত উপহার। স্ত্রী-ধনের বিষয়টি মনুস্মৃতি গ্রন্থে আরো সুনির্দিষ্ট করা হয়। মনু তাঁর ভাষ্যে পিতার সম্পত্তির উপর কন্যার অধিকারের কথা বলেন নি। তবে তিনি বলেছেন যে, ভ্রাতারা তাদের ভগ্নীদের বিবাহের জন্য পৈত্রিক সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ ত্যাগ করতে বাধ্য থাকবে। মনু ছয় প্রকার স্ত্রী-ধনের কথা বলেছেন। এগুলি হল-
-
(১) অধ্যাগ্নি, যা বিবাহকালে অগ্নির সম্মুখে প্রদত্ত হয়,
-
(২) অধ্যবাহনিক অর্থাৎ পতিগৃহে যাত্রার প্রাক্কালে কন্যাকে যা দেওয়া হয়,
-
(৩) প্রীতিদত্ত অর্থাৎ বন্ধুবর্গ বা আত্মীয়-স্বজন যা যা কন্যাকে প্রীতি সহকারে প্রদান করেন,
-
(৪) ভ্রাতৃদত্ত বা ভ্রাতা কর্তৃক ভগ্নীকে প্রদত্ত পৈত্রিক সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ,
-
(৫) মাতৃদত্ত অর্থাৎ মাতা তাঁর প্রাপ্ত স্ত্রী-ধনের যে অংশ কন্যাকে দেন এবং
-
(৬) পিতৃদত্ত, যা পিতা কন্যার বিবাহে দানস্বরূপ কন্যাকে দেন।
এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি পুত্রহীন হন এবং যদি কন্যাকে পুত্রিকা রূপে গ্রহণ করেন অর্থাৎ পুত্রের কাজ সম্পাদনের কন্যাকে অর্পণ করেন, তাহলে কন্যাই পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে গণ্য হতেন। এছাড়া মায়ের সম্পত্তির স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী হতেন কন্যাই, পুত্র নয়।
যাজ্ঞবল্ক স্ত্রী-ধন সম্পর্কে মনুর বক্তব্যকে আরো স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনিও ছয় প্রকার স্ত্রী ধনের উল্লেখ করেছেন। যেমন—
-
(১) পিতা, মাতা, স্বামী ও ভাতা প্রদত্ত ধন,
-
(২) বিবাহকালে যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে প্রদত্ত ধন,
-
(৩) স্বামী দ্বিতীয় পত্নী গ্রহণ করলে প্রথম পক্ষকে স্বান্তনা স্বরূপ প্রদত্ত ধন,
-
(৪) কন্যার আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক প্রদত্ত ধন,
-
(৫) কন্যাকে পাত্রপক্ষের মূল্য হিসেবে প্রদত্ত ধন এবং
-
(৬) বিবাহের পরবর্তীকালে কন্যা বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সকল ধন লাভ করেন।
যাজ্ঞবল্ক মনে করেন স্ত্রীই স্ত্রী-ধনের সম্পূর্ণ মালিক। তবে পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বহুকথিত স্ত্রীধনের উপর স্বামীর এমন কিছু নিয়ন্ত্রণের বিধান স্মৃতিকাররা দিয়েছেন যা অনভিপ্রেত হলেও বাস্তব। কিছু কিছু বিশেষ অবস্থায় স্ত্রী-ধনের উপর স্বামীর হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। যেমন—স্ত্রী তার সম্পত্তি যথেচ্ছভাবে দান করতে চাইলে স্বামী বাধা দিতে পারতেন। দুর্ভিক্ষাবস্থায়, কোন ধর্মানুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজন হলে, স্বামী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার প্রয়োজনে (অসুস্থতা নিবন্ধন) স্বামী স্ত্রী-ধন ব্যয় করতে পারতেন। অবশ্য স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্ত্রী-ধন তার কন্যাই পেত, স্বামী বা পুত্র নয়। অর্থাৎ প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর সম্পত্তি হিসেবে গালভরা ‘স্ত্রী-ধন’ ব্যবসথার সংস্থান থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে সেই সম্পত্তির উপর স্বামীর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখা হয়েছিল। এ. এল. ব্যাসামের মতে, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সঙ্কুচিত হলেও, অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার তুলনায় ভারতবর্ষে উদারতা ছিল বেশী। কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী-ধনের বাইরেও কিছু সম্পদ মেয়েদের থাকত।
মৌর্যযুগে বিবাহ ব্যবস্থা :
প্রাচীন ভারতের বিবাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের মূলত স্মৃতিশাস্ত্রসমূহের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি রচিত হয়েছিল সামাজিক যুগ পরিবর্তনের সময়কালে। তাই সেগুলিতে সর্বদা সুনির্দিষ্ট বিধান দেওয়া হয়নি। বহু ক্ষেত্রেই একই রচনাকারের মন্তব্যে অন্তর্বিরোধ আছে, যেমন, মনুস্মৃতি। আবার ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রের মতের মধ্যেও অমিল দেখা যায়। তথাপি সাবধানতার সাথে গ্রহণ করলে স্মৃতিসমূহই বিবাহ বিষয়ক প্রধান সূত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এছাড়া মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ, চীনা পর্যটকদের বিবরণ, বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দ পঞহো, বাৎসায়নের কামসূত্র প্রভৃতি এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করে।
প্রাচীন সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে কন্যার বিবাহ দান ছিল পিতার অধিকার ও কর্তব্য। পিতার অবর্তমানে এই দায়িত্ব পড়ত নিকট আত্মীয়ের উপর। যাজ্ঞবল্কস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, যৌবন প্রাপ্ত কন্যার বিবাহ দিতে না পারলে ঐ কন্যা যতদিন অবিবাহিত থাকে, ততদিন পিতা ভ্রূণ হত্যার পাপ করেন। যুবতী কন্যার বিবাহ দিতে পিতা বা অভিভাবক অপারক হলে কন্যা নিজেই পাত্র নির্বাচন করে বিবাহ করতে পারত। মনুস্মৃতি ও মহাভারতে এই স্বীকৃতি আছে। বৌধায়ন সূত্রের মতে, যৌবন প্রাপ্তির পর কন্যা বিবাহের জন্য তিন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। অতঃপর নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। স্ববর্ণে কিন্তু ভিন্ন গোত্রে পাত্র-কন্যার বিবাহ ছিল সর্বাগ্রে কাম্য। মনুতে বলা হয়েছে যে, পাত্র-পাত্রী মায়ের দিক থেকে পূর্ব পুরুষের মধ্যে সপিণ্ড সম্পর্ক থাকলে বিবাহ দেওয়া সঠিক নয়। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতিতে এ বিষয়ে সময়কাল বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, পাত্র-পাত্রীরা মাতার দিক থেকে ঊর্ধ্বর্তন পাঁচ পুরুষ এবং পিতার দিক থেকে ঊর্ধ্বতন সাতপুরুষের মধ্যে সপিণ্ড সম্পর্ক থাকলে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। তবে দক্ষিণ ভারতে এই বিধান মানা হত না। সেখানে মামাতো-পিসতুতো বোনের মধ্যে বিবাহ হত বলে বৌধায়ন সূত্রে উল্লেখ আছে। মনু এই সম্পর্কের তীব্র বিরোধিতা করেছেন, যদিও বৃহস্পতি একে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
বর্তমান কালের মতই সবর্ণ ও স্বজাতির মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনে জোর দেওয়া হত। তবে অসবর্ণ বিবাহ অপ্রচলিত বা শাস্ত্রবিরোধী ছিল না। উচ্চবর্ণের পাত্র ও নিম্নবর্ণের পাত্রীর বিবাহ ‘অনুলোম’ বিবাহ নামে পরিচিত। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের পুরুষ ও উচ্চবর্ণের নারীর মধ্যে বিবাহ ‘প্রতিলোম’ বিবাহ নামে পরিচিত। সাধারণভাবে অনুলোম বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হত। কারণ সেক্ষেত্রে এই বিবাহজাত সন্তানদের জাত্যোৎকর্ষের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রতিলোম বিবাহজাত সম্ভানদের জাত্যাপোকর্ষ ঘটত, যা কাম্য ছিল না। এই অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহের ফলেই বর্ণসংকর জাতিতত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণভাবে যৌবনপ্রাপ্তির পরে মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হত। সমকালীন সাহিত্যে বাল্য বিবাহের কোন উল্লেখ নেই। মহাভারতে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বিবাহকে সমর্থন করা হয়েছে। দ্রৌপদী, কুত্তি, উত্তরা প্রমুখের বিবাহ তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। ধীরে ধীরে বাল্য বিবাহের প্রচলন ঘটেছিল। মনু পাত্রের ন্যূনতম বয়স ধার্য করেছেন কুড়ি বছর। আবার তিনি পাত্রীর বয়স পাত্রের বয়সের এক-তৃতীয়াংশ হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মত দিয়েছেন। অর্থাৎ মনুস্মৃতি বাল্যবিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যাজ্ঞবল্ক স্মৃতিতেও যৌবন প্রাপ্তির পূর্বে মেয়েদের বিবাহের বিধান দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে নারদস্মৃতিতে আবার যৌবন লাভের পর কন্যার বিবাহ দেওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। সম্ভবত, সম্ভ্রান্ত ও উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহে উৎসাহ দেওয়া হত। গুপ্তপূর্ব যুগে সাধারণভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার বিবাহদান বহুল প্রচলিত হয়নি।
প্রাচীন ভারতে মোটামুটি আট প্রকার বিবাহ প্রচলিত ছিল। (১) ব্রাহ্মবিবাহ, এক্ষেত্রে পিতা সৎচরিত্র, সদাচারী পাত্র মনোনীত করে তার হাতে সালঙ্কারা কন্যাকে সমর্পণ করতেন। (২) দৈববিবাহ, যেখানে পিতা যথাবিহিত যজ্ঞ করে সালঙ্কারা কন্যাকে কোন পুরোহিতের হাতে সমৰ্পণ করতেন। (৩) আর্যবিবাহ, এক্ষেত্রে পিতা এক জোড়া গাভী বা বৃষ পাত্রের কাছ থেকে গ্রহণ করে তাকে কন্যাদান করতেন। মেগাস্থিনিসও এমন বিবাহের কথা উল্লেখ করেছেন। (৪) প্রজাপত্য বিবাহ, যেখানে পিতা উপযুক্ত পাত্রের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করে পরামর্শ দিতেন যে, “উভয়ে যেন একত্রে ধর্মসঙ্গত কর্তব্য সম্পাদন করে। (৫) আসুর বিবাহ, এক্ষেত্রে পাত্রপক্ষ কন্যাপক্ষকে অর্থ প্রদান করে তাকে গ্রহণ করে। মাদ্রীর সাথে পাণ্ডুর বিবাহ কিংবা কৈকেয়ীর সাথে দশরথের বিবাহ আসুরমতে সম্পাদিত হয়েছিল। (৬) গান্ধর্ব বিবাহ, যেখানে পাত্রপাত্রী স্বেচ্ছায় পরস্পরের সাথে সম্মিলিত হয়। (৭) রাক্ষস বিবাহ, এক্ষেত্রে কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে বিবাহ দেওয়া হয়। ভীষ্ম তাঁর ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করেছিলেন। (৮) পিশাচ বিবাহ, এক্ষেত্রে নিছক সম্ভোগের জন্য। ঘুমন্ত, মত্ত বা মানসিকভাবে অসুস্থ কন্যাকে হরণ করা হত।
ড. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, শেষ চারপ্রকার বিবাহ সম্ভবত পরবর্তীকালের কষ্টকল্পিত উদ্ভাবন। পিশাচ বিবাহকে মনু অপরাধমূলক কাজ বলেই নিন্দা করেছেন এবং অপরাধীর কঠোর শাস্তির বিধান দিয়েছেন। সম্ভবত গন্ধর্ব, অসুর, রাক্ষস, পিশাচ ইত্যাদি আদিম উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত বিবাহ প্রথাগুলিকে স্মৃতিশাস্ত্রের তালিকায় সংযোজিত করা হয়েছে। অসুর বলতে বোঝায় প্রাচীন ইরাণীয়দের, যারা আর্য ভাষা গোষ্ঠীর একটি অংশ। আজও মধ্যপ্রদেশ থেকে ছোটনাগপুরের মালভূমি পর্যন্ত বিস্তারিত অঞ্চলে অসুর নামক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়। রাক্ষস বলতে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিল। রামায়ণে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী রাক্ষস জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। পিশাচ বলতে কোন্ জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত এদের ভাষা ছিল ‘পৈশাচী-প্রাকৃত’, যে ভাষায় গুণাঢ্য তাঁর ‘বৃহৎকথা’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন।
মূলতঃ ক্ষত্রিয়দের মধ্যে ‘স্বয়ম্বর’ নামে একপ্রকার বিবাহ প্রচলিত ছিল। এইরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিবর্গ বিবাহসভায় উপস্থিত হতেন এবং পাত্রী নিজের পছন্দমত পাত্রের কণ্ঠে মাল্যদান করে স্বামী হিসাবে বেছে নিতেন। বহুক্ষেত্রে বিবাহ প্রার্থী নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করে জাহির করে কন্যার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে কন্যার সমর্থন আদায় করে নিতেন। রামায়ণে সীতা ও মহাভারতে দ্রৌপদীর বিবাহ এভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল। পানিপ্রার্থী পুরুষেরা মল্লযুদ্ধ, মুষ্টিযুদ্ধ বা দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েও নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে কন্যার মন জয় করতে পারতেন। গ্রীক লেখক নিয়ারকসের রচনাতেও স্বয়ম্বর জাতীয় বিবাহ প্রথার উল্লেখ পাওয়া যায়।
অর্থশাস্ত্রে বিবাহ প্রথার ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে প্রায় সম-অধিকার দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু কারণে অর্থশাস্ত্র বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহকে অনুমোদন করে। যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না ঘটলে কিংবা স্বামী দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারতেন। বিধবাদের পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্র ধর্মশাস্ত্রের বিধানকেই অনুসরণ করেছে। অর্থশাস্ত্রের বিধান অনুসারে স্বামীর মৃত্যু হলে, স্বামী সন্ন্যাস গ্রহণ করলে বা দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশে থাকলে স্ত্রী পুনর্বিবাহের অধিকারী হতেন। নারদ স্মৃতিতেও শর্ত সাপেক্ষে নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর স্ত্রীকে পুনর্বিবাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বামী নিরুদ্দিষ্ট হবার পর পরস্থিতি অনুযায়ী ছয় বা আট বছর অপেক্ষা করার পর স্ত্রী পুনর্বিবাহের অধিকারী হতে পারতেন। তবে মনুস্মৃতির বক্তব্যে অন্তর্বিরোধ আছে। কোন কোন স্থানে মনু দাবি করেছেন যে, কুমারী কন্যার একবারই বিবাহ হয়। আবার অন্যত্র তিনি পুনর্বিবাহিত (পুনর্ভূ) রমণীর পুত্রের পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র নারীর বিবাহ ব্যবস্থা বিষয়ে যতটা উদার, মনু ঠিক ততটাই অনুদার ও একপাক্ষিক। আবার নারদ স্মৃতি, পরাশর স্মৃতি প্রভৃতি মহিলাদের পুনর্বিবাহের বিষয়ে যথেষ্ট উদার। পুনর্বিবাহের ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছিন্না পত্নী তাঁর স্বামীর কূলের কোন ব্যক্তিকে বিবাহ করলে পূর্বস্বামীর সম্পর্কে প্রাপ্ত স্ত্রী-ধন ভোগ করতে পারতেন। ‘নিয়োগ প্রথা’ অর্থাৎ স্বামী সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে, তারই কূলের অন্য কোন উপযুক্ত ব্যক্তি অথবা কোন সদ্ ব্রাহ্মণের সাহায্যে স্ত্রী ‘ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করতে পারতেন। ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিদুর ক্ষেত্রজ পুত্র ছিলেন।
আলোচ্য সময়কালে সতীদাহ বা বহুবিবাহ সর্বজনীন কোন প্রথা ছিল না। ওনোসক্রেতিস, অ্যারিস্টোবুলাস, ডিওডোরাস প্রমুখ গ্রীক লেখক ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে সহমরণে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মাদ্রীর সহমরণের ঘটনা এ বিষয়টিকে সমর্থন করে। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরেও তাঁর কোন কোন পত্নী আত্ম বিসর্জন দিয়েছিলেন। আবার দশরথের মৃত্যুর পর তাঁর তিনজন পত্নীই সংসারে ছিলেন। তাই মনে করা হয় যে, সম্ভবত ক্ষত্রিয় রাজন্যবর্গের মধ্যে সতীদাহ প্রথা সীমাবদ্ধ ছিল। তাছাড়া সতী হওয়া ছিল পত্নীর ইচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত, কোনরূপ বাধ্যবাধকতা ছিল না। একইভাবে বহুবিবাহ সাধারণভাবে কাম্য ছিল না। তবে রাজা, ব্রাহ্মণ এবং নিম্নবর্ণের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে বহুবিবাহের চল ছিল। স্মৃতিশাস্ত্রে বহুবিবাহ প্রথাকে উৎসাহিত করা হয়নি। নারদ স্মৃতিতে বহু বিবাহিত ব্যক্তিকে আদালতে সাক্ষ্যদানের অনুপযুক্ত বলা হয়েছে। তবে পুত্রহীনা স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামীর পুনর্বিবাহকে বংশরক্ষার তাগিদে একটি ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিবেচনা করা হত। এক্ষেত্রেও বিষয়টি রাজবংশ বা ধনী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ব্যতিক্রমী প্রথা ছিল।
Leave a comment