বাঙলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবের ঠিক আগের যুগটিকে বলা হয় তত্ত্ববােধিনীর যুগ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা কেন্দ্র করে এই যুগের সাহিত্যিক উদ্যোগ সংহতি লাভ করেছিল। তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার সম্পাদকরূপে অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮ ৮৬) ছিলেন এই সারস্বত সমাজের কেন্দ্রীয় পুরুষ। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মধ্যে বাঙলা গদ্যের উৎকর্ষ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা জানতে হলে বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমারের গদ্য রচনাবলীর পরিচয় গ্রহণ প্রয়ােজন। বিদ্যাসাগর যেমন বর্ণনাত্মক গদ্যের রূপ শিল্প-সুষমামণ্ডিত করে তুলেছিলেন, অক্ষয়কুমারও তেমনি আধুনিক মানববিদ্যা ও বিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গ-অবলম্বনে রচিত তার অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধে জ্ঞানচর্চার ভাষারূপে বাঙলা গদ্যের সামর্থ্য ও শক্তি নিঃসংশয়িতভাবে প্রমাণ করেছেন। অক্ষয়কুমারের সাহিত্যিক প্রতিভা আবিষ্কার করেন ঈশ্বর গুপ্ত। ঈশ্বর গুপ্তই তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা প্রকাশের আয়ােজন করতে গিয়ে দেবেন্দ্রনাথ সম্পাদক নিয়ােগের জন্য একটা রচনা প্রতিযােগিতার ব্যবস্থা করেন। এই প্রতিযােগিতায় অক্ষয়কুমারের রচনা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হওয়ায় তাকেই সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। অক্ষয়কুমার ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বারাে বছর তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকার উন্নতির জন্য তিনি বিদ্যা, বুদ্ধি, দৈহিক সামর্থ্য—সবই উৎসর্গ করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথও স্বীকার করেছে যে, অক্ষয়কুমারের মতাে সম্পাদক না পেলে তত্ত্ববােধিনী পত্রিকার এত উন্নতিসাধন সম্ভব হত না। অক্ষয়কুমারের রচনা তত্ত্ববােধিনী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হত। অনেক রচনা এখনও এই পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই রয়েছে, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।

মানসিক গঠনের দিক থেকে অক্ষয়কুমার ছিলেন বৈজ্ঞানিক। আবেগ বা অন্ধবিশ্বাস নয়, কঠিন বুদ্ধির পথে তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণের দ্বারাই তিনি জগৎ ও জীবনের সত্য উদঘাটন করতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান আত্মস্থ করার চেষ্টায় এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দেশের ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের আলােচনায় তিনি বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। বলা হয়, দেশের লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার এবং জাতীয় ঐতিহ্য বিষয়ে সচেতনতা সঞ্চার বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব, কিন্তু তত্ত্ববােধিনীর পুরনাে সংখ্যার পাতাগুলি খুঁজলে দেখা যাবে বঙ্কিমচন্দ্রের আগে অক্ষয়কুমার এই কাজ শুরু করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের কোন রচনাই ঠিক সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে না। তার ভাষাও প্রসাদগুণবর্জিত কিন্তু জ্ঞানচর্চার বাহন হিশেবে তার হাতে বাঙলা গদ্য এমন সরলতা এবং প্রাঞ্জলতা লাভ করেছে যে আধুনিক শিক্ষিত মানুষের শিক্ষা দ্বারা লভ্য সকল বিদ্যাই এই ভাষায় আলােচনা করা সম্ভব। এই যুগে একদিকে বিদ্যাসাগর সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ভাষা হিশেবে বাঙলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেছেন, আর অক্ষয়কুমারের হাতে জ্ঞানচর্চার ভাষা হিশেবে বাঙলা গদ্য প্রভূত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ভাষাকে শিল্প-শ্রীমণ্ডিত করার দিকে অক্ষয়কুমারের চেষ্টা ছিল না, তার উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানের বিষয় সর্বজনবােধ্য প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করা। বিশেষত বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা প্রবন্ধ রচনার সূত্রপাত অক্ষয়কুমারের হাতে। রামমােহনে যার সূচনা—সেই জ্ঞানচর্চার ভাষারূপে বাংলা গদ্যের বিকাশের একটা পরিণত স্তর দেখা যায় অক্ষয়কুমারের রচনায়। রামমােহনের ভাষার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, অক্ষয়কুমার উপযুক্ত ছেদচিহ্নের দ্বারা নিয়মিত এবং অনেক বেশী অর্থবহ বাক্য রচনা করতেন। ক্রিয়াপদের প্রয়ােগ-বৈচিত্র্যও তাঁর ভাষার আর একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

অক্ষয়কুমারের অধিকাংশ রচনাই প্রথম তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সুপরিকল্পিত বৃহৎ গ্রন্থের ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত অংশগুলিও বস্তুত এক একটা বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধেরই আকারসম্পন্ন। সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ববর্তী কালের লেখকদের মধ্যে প্রাবন্ধিক হিশেবে অক্ষয়কুমারের বিশেষ স্থান আছে।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরবস্তুতঃ এই তিনে মিলে তত্ত্ববােধিনীর যুগ-ই বিষয়-বিস্তারে ও রচনার রীতি-প্রকরণে বাংলা গদ্যসাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তন করে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছিল মূলতঃ সাংগঠনিক প্রতিভা, সাহিত্যসৃষ্টিতে তিনি ততােটা মনােনিবেশ করতে পারেন নি। পক্ষান্তরে অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরই বিষয়বস্তুর ঐশ্বর্যে এবং ভাষার সৌকর্য-সাধনে বাঙলা গদ্যভাযাকে যৌবনদ্বারে উপনীত হতে দিলেন। এঁরা দু’জনেই ভাষায় যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবস্থা দ্বারা গদ্যে সৌষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। এতদুভয়ের যুগপৎ প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করেছিলেন মনীষী রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রচলিত বাঙলা গদ্যরীতির উদ্ভবের মূলে যে এঁদের প্রচেষ্টাই সর্বাধিক সক্রিয় ছিল, তা স্বীকার করে তিনি রচনার প্রভেদ দেখিয়েছেন এভাবে- “Vidyasagar is the more accom plished master of style, Akshaykumar is the more forcible preacher.” 

অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, “অক্ষয়কুমার এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমবয়সী এবং প্রায় সমকালেই সাহিত্যজগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এরা পরস্পর ঘনিষ্ঠতা-সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। কাজেই, স্বভাবতঃ একের উপর অপরের প্রভাব প্রত্যাশিত। বাক্যাড়স্বরযুক্ত যে জাতীয় রচনা বাঙলা ভাষায় দীর্ঘকাল ‘বিদ্যাসাগরী রীতি বলে খ্যাতি ও অখ্যাতি অর্জন করেছে, সে জাতীয় রচনার লেখক কিন্তু আসলে অক্ষয়কুমার আভিধানিক শব্দ এবং দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদের অত্যধিক প্রয়ােগের সঙ্গে যুক্তির ভার যুক্ত হওয়াতে অক্ষয়কুমারের রচনা কতকাংশে শ্লথগতি হলেও ভাষার বলিষ্ঠতা এবং ভারবহনক্ষমতা যে বাঙলা গদ্যভাষার সম্ভাবনাকে বহুদূর বিস্তৃত করেছিল, এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। অক্ষয়কুমারের ভাষারীতির সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মাধুর্য এবং সুষমা যুক্ত হবার পরই বাঙলা গদ্য চিরকালীন আদর্শ রূপ লাভ করে। বস্তুতঃ এই দুই গদ্যসাধকের যুগ্ম প্রচেষ্টার ফলেই বাঙলা গদ্য সম্ভাবনার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়।”

অক্ষয়কুমার দত্তের রচনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বাহ্য প্রকৃতির সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার এবং ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়। বাহ্য প্রকৃতির সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার গ্রন্থটি দুই খণ্ডে ১৮৫২ এবং ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ রচনায় তিনি জর্জ কুম্ব রচিত ‘Constitution of Man’ নামক গ্রন্থের ওপর নির্ভর করেছেন কিন্তু এটা ঠিক অনুবাদ নয়। অক্ষয়কুমার নিজেই লিখেছেন ঃ “ইহা ইংরেজী পুস্তকের অবিকল অনুবাদ নহে। যে সকল উদাহরণ ইউরােপীয় লােকের পক্ষে সুসঙ্গত ও উপকারজনক, কিন্তু এদেশীয় লােকের পক্ষে সেইরূপ নহে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া তৎপরিবর্তে যে সকল উদাহরণ এদেশীয় লােকের পক্ষে সঙ্গত ও হিতজনক হইতে পারে, তাহাই লিখিত হইয়াছে। এদেশের পরম্পরাগত কুপ্রথা সমুদায় মধ্যে উদাহরণস্বরূপে উপস্থিত করিয়া তাহার দোষ প্রদর্শন করা গিয়াছে।”

অক্ষয়কুমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়। গ্রন্থটি দুভাগে যথাক্রমে ১৮৭০ এবং ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে এটি ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বী উপাসক সম্প্রদায়-সম্পর্কে H. H. Wilson-এর লেখা ‘Religious Sects of the Hindus’ নামক নিবন্ধ অক্ষয়কুমারের এই গবেষণামূলক রচনার ভিত্তি। উইলসনের নিবন্ধে ৪৫টা সম্প্রদায়ের বিবরণ। অক্ষয়কুমার স্বাধীন গবেষণা-দ্বারা আরও বহু সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করেন। তার গ্রন্থে ১৮২টা সম্প্রদায়ের বিবরণ পাওয়া যায়। রােগজীর্ণ দেহ নিয়ে এই মহাগ্রন্থ রচনায় তিনি যে পরিশ্রম করেছিলেন এবং যে একাগ্র নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছিলেন বাঙলাদেশে তা সুলভ নয়। ভারতবর্ষীয় সামাজিক ইতিহাসের এক বিশেষ দিকের এমন শ্রমসাধ্য বিপুলায়তন গবেষণাকর্মের দৃষ্টান্ত বাংলা গদ্য সাহিত্যে অক্ষয়কুমারই প্রথম স্থাপন করলেন।

গ্রন্থটির উপক্রমণিকা অংশ সম্পর্কে অধ্যাপক সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন, “দুই ভাগেরই উপক্রমণিকার অংশ সুদীর্ঘ এবং মূল্যবান। প্রথম ভাগের উপক্রমণিকার মূল আর্য (ইন্দো-ইয়ােরােপীয়), আর্য (ইন্দো-ইরানীয়) এবং ভারতীয় আর্য (বৈদিক এবং সংস্কৃত) ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস আলােচিত হইয়াছে। ভাষাবিজ্ঞানের আলােচনা ভারতবাসী কর্তৃক এই প্রথম। দ্বিতীয় ভাগের উপক্রমণিকায় প্রাচীনভারতীয় অর্থাৎ বৈদিক এবং পৌরাণিক ধর্ম ও দর্শন সাহিত্যের আলােচনা করা হইয়াছে।…… অক্ষয়কুমারের গ্রন্থ বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় বাঙালীর মনীষার প্রথম এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।” বস্তুনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা পদ্ধতি-অবলম্বনে অক্ষয়কুমার এই গ্রন্থ রচনায় যে মনীষার পরিচয় দিয়েছেন তা আজও বিস্ময় উদ্রেক করে। বস্তুতঃ এ বিষয়ে তাঁর গ্রন্থের সঙ্গে তুলনাযােগ্য আর কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি।

অক্ষয়কুমার দত্তের অন্যান্য রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য পদার্থবিদ্যা (১৮৪৫) এবং চারুপাঠ-এর তিন খণ্ড (১ম-১৮৫৩, ২য়-১৮৫৪, ৩য়-১৮৫৯)। ‘চারুপাঠ’ দীর্ঘদিন পাঠ্যপুস্তকরূপে ব্যবহৃত হওয়ায় ‘চারুপাঠ’ ই তার রচনাবলীর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত এবং পঠিত গ্রন্থ। ‘চারুপাঠের রচনাগুলিও যে প্রবন্ধ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, সে-বিষয়ে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন- “এই লেখাগুলিতে অক্ষয়কুমারের চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও যুক্তিনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মনের প্রশংসনীয় পরিচয় পাওয়া যায়। শব্দপ্রয়ােগে ও বাক্যগঠনরীতির কিছুটা গতি স্বচ্ছন্দতা, অনায়াসলভ্য সাবলীলতার অভাব থাকিলেও তাহার মননের ঋজুতা ও তথ্যের বিন্যাস পারিপাট্য পাঠকচিত্তের অভিনন্দন লাভ করে। তাঁহার তিনটি স্বপ্নদর্শন-বিষয়ক নিবন্ধ, ইংরেজ প্রাবন্ধিক অ্যাডিসনের দৃষ্টান্ত-প্রভাবিত হইলেও রূপক-কল্পনার সার্থক প্রয়ােগ ও লেখকের নিবিড় মানসানুভূতির স্পর্শে উচ্চাঙ্গের সাহিত্যপদবাচ্য হইয়াছে, শুধু তথ্য ও জ্ঞানের প্রকাশ-সীমা অতিক্রম করিয়া পাঠকের মনে রসবােধের আগ্রহ জাগাইতে সমর্থ হইয়াছে।”