পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য পরিবেশের উপাদানসমূহ সম্পর্কে অবহিত হওয়া আবশ্যক। বহু ও বিভিন্ন উপাদানের সমাহারে সৃষ্টি হয় পরিবেশের। পরিবেশের উপাদানসমূহকে দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় : 

পরিবেশের উভয় ধরনের উপাদানসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

(ক) প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ:

পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান বলতে বস্তুত প্রাকৃতিক পরিবেশকেই বোঝায়। ভৌগোলিক উপাদানসমূহকে নিয়েই প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠে। পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থা, ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, জমির গঠন, অরণ্য, পাহাড়-পর্বত, নদনদী, সৈকত রেখা, জীবজন্তু, গাছপালা, মানুষজন প্রভৃতি। এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠে। সমাজবিজ্ঞানী বার্গার্ড (L. R. Ber nard)-এর অভিমত অনুযায়ী প্রাকৃতিক পরিবেশের এই দুটি ভাগ হল: 

জৈব পরিবেশ গড়ে উঠে জীবনযুক্ত প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ নিয়ে। জৈব পরিবেশের উপাদানসমূহের উদাহরণ হল মানুষজন, জীবজন্তু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ প্রভৃতি। অপরদিকে অজৈব পরিবেশের সৃষ্টি হয় জড় বা জীবনহীন প্রাকৃতিক উপাদানসমূহকে নিয়ে। অজৈব পরিবেশের উপাদানসমূহের উদাহরণ হল ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নদনদী প্রভৃতি।

প্রাকৃতিক পরিবেশ বা প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ ‘প্রকৃতির মুক্তদান’ (Free gift of the nature) হিসাবে পরিগণিত হয়। মানুষের জীবনধারায় এবং ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। প্রকৃতির মুক্তদানে সমৃদ্ধ দেশ প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে উন্নত হয়। সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের আনুকূল্যের সদর্থক অবদান অস্বীকার করা যায় না। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ দেশ ও দেশবাসীর সমৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সহায়ক প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে দেশের কৃষি-শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। দেশের মানুষের চিন্তারভাবনা ও কর্মপ্রচেষ্টা প্রসারিত হয় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। বিপরীতক্রমে অনেক অঞ্চলে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতিকূলতা পরিলক্ষিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতিকূলতার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ধারা প্রতিহত হয় এবং জনজীবনে হতাশা ও অব্যবস্থার আশঙ্কা দেখা দেয়।

(খ) অ-প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ

পরিবেশের সকল উপাদান প্রকৃতির মুক্ত দান নয়। পরিবেশের অনেক উপাদানই মানুষের সৃষ্টি। এই সমস্ত উপাদানও মানুষের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই সমস্ত উপাদান অ-প্রাকৃত উপাদান হিসাবে পরিগণিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ পুরোপুরি প্রকৃতির সৃষ্টি। অপরদিকে অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষ। অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ হল অ-প্রাকৃতিক উপাদান সমন্বিত। প্রকৃতি প্রদত্ত উপাদান বহির্ভূত উপাদানসমূহের সমন্বয়কে বলা হয় অ-প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরিবেশ গড়ে উঠে প্রাকৃতিক ও অ-প্রাকৃতিক উপাদানসমূহকে নিয়ে। প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবেশ হল একটি সামগ্রিক ধারণা; পরিবেশের সঙ্গে প্রাকৃতিক উপাদান এবং অ-প্রাকৃতিক উপাদান সংযুক্ত থাকে। মানুষ ও মানবসমাজের উপর অ-প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব অনুকূল হতে পারে আবার প্রতিকূলও হতে পারে।

অ-প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন অংশ বা উপাদান বর্তমান। তদনুসারে অ-প্রাকৃতিক পরিবেশকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। অ-প্রাকৃতিক পরিবেশের এই চারটি ভাগ হল: 

  • (১) সামাজিক পরিবেশ, 

  • (২) আর্থনীতিক পরিবেশ, 

  • (৩) রাজনীতিক পরিবেশ এবং 

  • (৪) কারিগরি পরিবেশ।

(১) সামাজিক পরিবেশ:

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সমাজকে এড়িয়ে বা সমাজের বাইরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব নয়। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং জীবনযাপন করে। সামাজিক পরিবেশের মধ্যেই মানুষের সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়। মানুষই সমাজ গঠন করে এবং সমাজের মধ্যে বসবাস করে। সমাজকে এড়িয়ে চলা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

সামাজিক পরিবেশের সৃষ্টি হয় বহু ও বিভিন্ন সামাজিক উপাদানসমূহের সমন্বয়ে। সামাজিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত উপাদানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বিভিন্ন সামাজিক প্রথা, লোকাচার-লোকনীতি; সামাজিক আচার-ব্যবহার, নিয়ম-নীতি; সাংস্কৃতিক পরিবেশ; মানুষের জীবনধারা, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, শিক্ষা দীক্ষা, ধর্মীয় চেতনা প্রভৃতি। সাধারণভাবে মানুষ বাস্তববাদী ও জীবনমুখী। সমাজে জীবনযাপনের সুবাদে মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা ও অভিজ্ঞতা সূত্রে লেখাপড়া, ধ্যান-ধারণা, জ্ঞানবুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, কল্পনার জগৎ, রুচি, শিল্পকলা, সাহিত্য-দর্শন প্রভৃতির সমন্বয়ে এক পরিমণ্ডল গড়ে তোলে। এই পরিমণ্ডলই সাংস্কৃতিক পরিবেশ হিসাবে পরিচিত। সামাজিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় চেতনা।

সামাজিক পরিবেশই হল যে কোন সমাজের সামগ্রিক মূল্যায়নের মানদণ্ড। উন্নত সামাজিক পরিবেশে উন্নত জীবনধারার নিশ্চয়তা থাকে। সামাজিক পরিবেশ উন্নত, উদার ও মার্জিত হলে সমাজের সার্বিক বিকাশের পথ সুগম হয়। বিপরীতক্রমে সামাজিক পরিবেশ অনুন্নত, জটিল প্রকৃতির এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী হলে সমাজের অবক্ষয় ও অধঃপতন অবধারিত হয়ে পড়ে। সমাজের বিকাশ ও অবক্ষয় উভয়ই সামাজিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। আবার সামাজিক পরিবেশের প্রকৃতি সামাজিক উপাদানসমূহের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সামাজিক উপাদানসমূহের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক পরিবেশের প্রকৃতির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

(২) আর্থনীতিক পরিবেশ:

যে কোন দেশের বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থা অনেকাংশে আর্থনীতিক পরিবেশের সীমানা নির্ধারণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে আর্থনীতিক পরিবেশের প্রকৃতিও প্রকাশ করে। মানবসমাজে মৌল আর্থনীতিক কার্যকলাপ হল ভোগ, উৎপাদন, বিনিময় প্রভৃতি। এই সমস্ত মৌল আর্থনীতিক ক্রিয়াকর্মকে কেন্দ্র করে যাবতীয় আর্থিক ও বাস্তব উপাদানসমূহ পরিচালিত হয়। এই সমস্ত উপাদান সামগ্রিকভাবে একটি দেশের আর্থনীতিক পরিবেশ গড়ে তোলে।

যে কোন দেশের আর্থনীতিক পরিবেশ ও আর্থনীতিক বিকাশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। মূলত আর্থনীতিক পরিবেশের উপর আর্থনীতিক বিকাশ নির্ভরশীল। অনুরূপভাবে আবার দেশের আর্থনীতিক বিকাশের উপর উন্নত আর্থনীতিক পরিবেশ নির্ভরশীল। উন্নয়নের মানের দিক থেকে তিন ধরনের আর্থনীতিক পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। এই তিনধরনের আর্থনীতিক পরিবেশ হল: 

  • (ক) অতি উন্নত আর্থনীতিক পরিবেশ, 

  • (খ) উন্নত আর্থনীতিক পরিবেশ এবং 

  • (গ) স্বল্পোন্নত আর্থনীতিক পরিবেশ। 

উন্নত আর্থনীতিক পরিবেশে যে কোন দেশের কৃষি-শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি উৎপাদনের সকল ক্ষেত্রে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। আর্থনীতিক বিকাশের পথে অগ্রবর্তী দেশের আর্থনীতিক পরিবেশও উন্নত হয়।

আর্থনীতিক ব্যবস্থা তিন ধরনের হয়: 

  • (ক) ধনতান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা, 

  • (খ) সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা এবং 

  • (গ) মিশ্র আর্থনীতিক ব্যবস্থা। 

অবাধ উদ্যোগাধীন আর্থনীতিক ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তিগত বা বেসরকারী মালিকানাধীন। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হয় মূল্যব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি অনুসারে। এখানে উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কাজকর্মের মূলনীতি ও লক্ষ্য হল মুনাফার পরিমাণকে সর্বাধিক করা। ধনতান্ত্রিক ব্যবসায়িক উদ্যোগসমূহ পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। ন্যূনতম হস্তক্ষেপের নীতি অনুসারে সরকারী কাজকর্ম পরিচালিত হয়।

অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হল আদেশমূলক অর্থব্যবস্থা (Command Economy)। এ ধরনের অর্থব্যবস্থা পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের আদেশ-নির্দেশের ভিত্তিতে। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন ও ব্যবসায়িক উদ্যোগসমূহের উপর ব্যক্তিগত বা বেসরকারী মালিকানা অস্বীকৃত।

ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থার মধ্যবর্তী অবস্থায় আছে মিশ্র অর্থব্যবস্থা (Mixed Economy)। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারী উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে বে-সরকারী উদ্যোগের অস্তিত্ব ও সম্প্রসারণকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। সরকারী ও বে-সরকারী উদ্যোগের সহাবস্থান মিশ্র অর্থনীতির পরিচায়ক।

(৩) রাজনীতিক পরিবেশ:

বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে রাজনীতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। রাজনীতিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত উপাদানসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি, সরকারী আইন-কানুন এবং তার প্রয়োগ, আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি, কৃষি-শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত সরকারী নীতি প্রভৃতি। দেশের রাজনীতিক উপাদানসমূহ আর্থনীতিক ক্রিয়াকলাপের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। উন্নত তিক পরিবেশে যাবতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার সার্থক বাস্তবায়ন সহজে সম্ভব হয়। দেশ ও দেশবাসীর সামগ্রিক বিকাশের জন্য আবশ্যক হল সুদৃঢ় শাসনব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নত অবস্থা, রাজনীতিক স্থিতিশীলতা প্রভৃতি।

(৪) কারিগরি পরিবেশ:

কারিগরি পরিবেশ বলতে এমন এক পারিপার্শ্বিকতাকে বোঝায় যেখানে কারিগরি বিদ্যার ধারা অব্যাহত থাকে। আধুনিককালে নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অন্ত নেই। তার ফলে নতুন নতুন যন্ত্রপাতির সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে কারিগরি পরিবেশের উন্নয়নের গতি অব্যাহত আছে। উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতির সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ইলেকট্রনিক ব্যবসা (E, Commerce)-র যুগের সূত্রপাত ঘটেছে। কারিগরি বা প্রযুক্তিগত উপাদানসমূহের উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেই কারিগরি বা প্রযুক্তির পর্যায়ে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।

অনুকূল কারিগরি পরিবেশের সুবাদে দেশে দ্রুত শিল্পায়ন সম্পাদিত হয়। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর কারিগরি উপাদানসমূহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কারিগরি উপাদানসমূহের সূত্রে প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কাও থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, শ্রম-উদ্বৃত্ত দেশে নিয়োগহীনতার সমস্যা অধিকতর প্রবল হয়ে পড়তে পারে।