অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, উদ্ভট আতিশয্য বা চরম হাস্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয় ফার্স বা প্রহসন। তবে আলোচ্য নাটকের কায়াগঠন কিন্তু তেমন ভাবে হয়নি, বরং স্বাভাবিক যুক্তিসঙ্গত ঘটনা সন্নিবেশই ‘একেই কি বলে সভ্যতায়’ বেশি লক্ষিত হয়। ইয়ং বেঙ্গল শ্রেণির প্রতিনিধি নবকুমার তার বৈশ্ববভক্ত পিতার কলকাতা-আগমনে স্বাধীনভাবে ফুর্তি করার ব্যাপারে একটু অসুবিধায় পড়েছিল। কিন্তু বন্ধু কালীনাথ কোনো মতে বন্ধুর পিতাকে তাদের জ্ঞান তরঙ্গিনী সভার উচ্চ জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা বলে অনুমতি আদায় করল এবং বারবনিতা পল্লিতে গিয়ে পানাহার, নৃত্যগীত ও বারবনিতার সঙ্গে যথেষ্ট ফুর্তি করল। এরপর রাত্রে পানোন্মত্ত অবস্থায় নবকুমার পিতৃগৃহে ফিরে পিতা-মাতা স্ত্রী ভগ্নীদের সামনেই বেলেল্লাপনা করতে লাগল। নবকুমারের আদর্শপরায়ণ চরিত্র ও তথাকথিত আদর্শবান জ্ঞান তরঙ্গিনী সভার স্বরূপ সেই রাত্রেই উদ্ঘাটিত হয়ে গেল। এই ঘটনা তৎকালীন কলকাতার সামাজিক জীবনে অসম্ভব অবাস্তব উদ্ভট কিছুই নয়।
মূলত কলকাতায় অপেক্ষাকৃত বিত্তবান শিক্ষিত পরিবারের তরুণ যুবকবৃন্দ এমনি করেই তখন কলেজী বিদ্যা আহরণ করে সমাজ সংস্কারের বুলি কপচে তারই আড়ালে অবাধ মধ্যপান ও বারবনিতা নিয়ে চরম ফুর্তির মধ্যে দিন কাটাত । মনে রাখতে হবে, নাট্যকার শহর কলকাতার ফুর্তিবাজ ফুলবাবু সমাজের ছবি আঁকেননি। যাঁরা অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত তাঁদের ভণ্ডামিকেই তিনি উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন। ‘ইন দি নেম অফ ফ্রিডম লেট আস এনজয় আওয়ার সেলিভস’ এই উক্তির প্রচারকদের স্বরূপ উন্মোচন করাতেই তাঁর প্রহসনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়।
এই তথাকথিত শিক্ষিত বা শিক্ষাভিমানী ভণ্ডদের আচরণগত অসংগতির কিছু লঘু অথচ বস্তুনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নাট্যকার তির্যক ভঙ্গিতে–তাই এটি সিরিয়াস নাটক নয়। রূপ নিয়েছে প্রহসনের। নবকুমার সম্প্রদায়ের এই পরিণতি দুঃখজনক, কিন্তু তাকে আপাত পরিহাসের লঘুতায় দেখানো হয়েছে বলেই নাট্যকার একে ফার্স বলতে চেয়েছিলেন। এটি মিলনান্তও নয়, সুতরাং কমেডিও বলা যাবে না। আবার এটি কোনো মহৎ বিষয়ের বিদ্রুপাত্মক অনুকরণও নয়। তাই একে বার্লেস্কও বলা যায় না। এর চরিত্রগুলি অল্পবিস্তর কমিক— সিচুয়েশানও সামান্য পরিমাণে কমিক্যাল। আধুনিক কালের সুররিয়ালিষ্ট ফ্যানটাসি ধর্মী ফার্সের সঙ্গেও এর সম্পর্ক নেই।
ফার্সের অন্যতম ধর্ম হল নিষ্করুণতা, ‘একেই কি বলে সভ্যতায়’ মধুসূদনের ভূমিকাও বস্তুত নিষ্করুণ। অসঙ্গতিকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তাই তীব্র সহানুভূতির রসে তাঁর চরিত্রগুলি দ্রবীভূত হয়নি। ফরাসি ফার্স রচয়িতাদের মতো সমাজ সচেতনতাই মধুসূদনের বিশিষ্টতা, তিনি এখানে প্রখরভাবে সমাজ সচেতন বলেই ফার্সের নামকরণ থেকে শুরু করে বিষয়বস্তু, সর্বত্র একটা দেশকালের সীমার মধ্যে জাতীয় জীবনের একটি বিকৃত রুচি ও জীবনধারাকেই শ্লেষে ফোটাতে চেয়েছিলেন। অনাবিল পরিহাসের সঙ্গে তাই এখানে bitterness ও অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে গেছে।
কৌতুকময়তার পরিভাষাই হল প্রহসন। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ঘনীভূত উদ্দেশ্য হলেও প্রহসনে আগাগোড়াই একটি লঘু পরিহাসের আবরণ থাকে। ‘একেই কি বলে সভ্যতার সংলাপে মধুসূদনের সেই কৌতুকপরায়ণতার উদাহরণ ছড়ানো রয়েছে। এই প্রহসনে ইংরাজি শিক্ষিত নব্যযুবকদের ইংরাজি বাংলা মেশানো বিকৃত সংলাপে মধুসূদনের পরিহাসিক চিত্ত ঝিলিক দিয়ে উঠেছে । শ্রীমদ্ভাগবদ্ গীতা ও জয়দেবের গীতগোবিন্দ, তাদের মুখে রয়েছে শ্রীমতী ভগবতীর গীত আর বিন্দাদূতীর গীতি। শিকদার পাড়ার গলিতে কায়াবিলাসিনীদের রঙ্গরস, পুলিশের চৌকিদার দারোগার শিকার ধরার দৃশ্য। নোটেনের খানসামা বেয়ারাদের নেপথ্য আক্ষেপ, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার সদস্যদের বক্তৃতা, নবকুমারের গৃহে অন্তঃপুরিকাদের তাসখেলার দৃশ্য, সর্বত্র মধুসূদন কৌতুকহাস্যের উপকরণ সন্ধান করেছেন। এই লঘু পরিহাসের আয়োজনেই ‘একেই কি বলে সভ্যতা’র প্রহসন স্বভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
প্রহসন সাধারণত আয়তনের দিক থেকে খুবই সংক্ষিপ্ত, অপরিসর হয় এবং এতে ঘটনার কোনো জটিলতা থাকে না। প্রহসনের প্লট হয় সরল। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ মাত্র চার দৃশ্যের প্রহসন এবং একটিমাত্র দিনের ঘটনা। তার মধ্যে দিয়েই নাট্যকার সরলভাবে কাহিনি বিবৃত করেছেন।
সাধারণত ট্র্যাজেডি বা কমেডি নাটকে নাট্যচরিত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতের যে সুযোগ থাকে প্রহসনের চরিত্রে তার একান্ত অভাব দেখা যায়। প্রহসনে চরিত্রগুলিও তাই জটিল নয়। মধুসূদনও কোথাও কোনো চরিত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেননি। বৈক্ষ্ণব ভক্ত কর্তামশায় থেকে শুরু করে তার অনুগত বাবাজি, নবকুমার বন্ধু কালীনাথ, জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার অন্যান্য সদস্যবৃন্দ, নবকুমারের জননী ও ভগ্নীগণ, পুলিশের প্রতিনিধি বৃন্দ, বারবিলাসিনীর দল সকলেই মাত্র অল্পক্ষণের জন্য প্রহসনে দেখা দিয়েছে—তাঁদের চরিত্রের কোনো গভীর অদৃশ্য গোপন দিকের ওপর নাট্যকার আলো ফেলেননি। কেবল বাইরের দিক থেকেই তাদের স্বরূপগুলি তুলে ধরেছেন। এসকল কারণেই বোধ করি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ যথার্থ প্রহসন হয়ে উঠেছে।
Leave a comment