খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীসে প্রহসনের উৎপত্তি হয়। কোরিয়ান গ্রীকদের মধ্যে বিশেষ করে মোগারা প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে প্রহসন জনপ্রিয় ছিল। মনে হয়, গ্রীকদেবতা ডায়োনীসিয়াসের উদ্দেশে নিবেদিত অনুষ্ঠানাদিতে এর আত্মপ্রকাশ। সম্ভবত মদ্যদেবতা ও তাঁর উর্বরাশক্তির আনুষ্ঠানিক আবাহনের জন্য দেবতা, বীরগণ, এমনকি স্থানীয় চরিত্রসমূহের হাস্যকর অনুকরণ প্রয়োজন ছিল। হাস্যরস সামাজিক অনাচার এবং অব্যবস্থা দূরীকরণে শক্তিশালী হাতিয়ার রূপে পরিগণিত হতো। প্রহসনের মঞ্চায়নের শুরু থেকেই মুখোশের ব্যবহার হয়েছে এবং ব্যক্তিবিশেষের বাচনভঙ্গী, চলাফেরা ইত্যাদি কৌতুকপূর্ণ অনুকরণের জন্য বিশেষ বিদ্রূপ ভাষার প্রয়োগ হয়েছে। প্রহসনের প্রচলন প্রাচীন রোম ও ইউরোপেও হয়েছে।

প্রহসনের যে কটি উপাদানের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে তা হলো-

“(১) সূক্ষ্ম চাতুর্যের সঙ্গে ঘটনাসৃষ্টির প্রবণতা। (২) চরিত্র ও সংলাপ মুখ্যতা। (৩) চাতুর্যপূর্ণ নাট্য সিচুয়েশন সৃষ্টির বৈচিত্র্য। (৪) হাস্যরস উদ্রেক। (৫) একটি অঙ্কের মধ্যে কাহিনীর বিচরণ। (৬) উদ্ভট চরিত্রসৃষ্টি। (৭) হালকা কৌতুকপূর্ণ পরিবেশ। (৮) হাস্যরসসৃষ্টিতে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও কৌশলগত নাট্যপ্রয়োগের ব্যবহার।”

আসলে ইংরেজি Farce শব্দের প্রতিশব্দরূপে বাংলায় প্রহসন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ফার্স-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে—“Farce may be defined as exaggerated comedy; its problems is unlikely and absurd its action ludicrous and one sided, its manner entirely laughable.”

বাংলা প্রহসনের সংজ্ঞায় বলা যেতে পারে—“টাইপধর্মী চরিত্রগুলি তাদের নিজস্ব ভাষাভঙ্গী ও পরিবেশের সীমারেখার সমকালীন বহু আলোচ্য ঘটনাবলীকে যখন এক থেকে দুই অঙ্কের সীমায়িত নাটিকায় জীবন্ত করে তোলে, তখন হাস্যরসাত্মক যেই নাটিকাকে বলা হয় প্রহসন”,

গ্রহসনের বেশ কিছু সর্বজনগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

আঙ্গিকের দিক থেকে প্রহসন হবে এক বা দুই অঙ্কে বিন্যস্ত। এর অঙ্গীরস হবে হাস্য; তবে ভাঁড়ামি এবং স্থূল হাস্যরূপ থাকবে না এমন নয়। সমকালীন ঘটনা অবলম্বনে প্রহসন রচিত হতে পারে। চরিত্র টাইপধর্মী হলেও তার স্বাতন্ত্র্য থাকবে এবং অধিকাংশ চরিত্রই নিজ নিজ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবে। সংলাপ হবে চরিত্রের মর্যাদা অনুযায়ী।

কমেডির একটি শ্রেণিকে বাংলায় প্রহসন বলা হয়। ইংরাজীতে একে ফার্স বলে। বাংলার ফার্স কথার মাধ্যমে গ্রাম্য নক্সাজাতীয় হালকা ধরনের হাস্যরসের নাটকের কথা মনে হয়। প্রহসনের মূল কথা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সৃষ্টি। এখানে মানব জীবনের একাংশের অতিরঞ্জিত চিত্র ও বিদ্রুপাত্মক উপকরণগুলি পরিবেশিত হয়। সমাজের বাস্তব চিত্র অবলম্বনে কুপ্রথা, কুসংস্কার প্রভৃতি বিষয়কে বিদ্রূপ করে সাধারণ প্রহসন রচিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, কমেডি রচনা শিথিল ও দুর্বল আঙ্গিক যুক্ত এবং হালকা বিষয় সম্বলিত বলেই তা প্রহসন রূপে বিবেচিত হয়। আসলে প্রহসন জাতীয় রচনা হল পরিস্থিতি প্রধান হাস্যরসাত্মক নাটক। এখানে মানসিক ক্রিয়া অপেক্ষা দৈহিক ক্রিয়া প্রাধান্য লাভ করে। প্রহসনের অপেক্ষা সমাজ সমস্যার চিত্র অবলম্বনে মূল হাস্যরস পরিবেশেনের দিকে নজর বেশি থাকে।

প্রহসন রচনার প্রকৃতি ও লক্ষণ বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা যায়—

  • (১) প্রহসন হাস্য রসাত্মক সৃষ্টি; প্রহসন হালকা ও স্থূল হাস্যরস পরিবেশনের জন্যই রচিত হয়।
  • (২) প্রহসনের চরিত্র সৃষ্টি মুখ্য নয়— ঘটনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 
  • (৩) প্রহসনে মানসিক অপেক্ষা দৈহিক ক্রিয়ার প্রাধান্য থাকে।
  • (৪) প্রহসনে সমাজের অসঙ্গতি, উদ্ভট রূপ, ব্যর্থতা প্রভৃতি পরিবেশিত হয়।
  • (৫) প্রহসনে কাহিনীর কোনো সুসঙ্গত পরিণতি থাকে না।
  • (৬) কোনো চরিত্রের আকস্মিক আবির্ভাব, অতিনাটকীয় আচরণ, খেয়ালী ও উৎকেন্দ্রিক স্বভাবের মানুষের চিত্র প্রদর্শিত হয়। 
  • (৭) কোনো কোনো চরিত্রের কথা আচরণ প্রভৃতি মুদ্রাদোষ, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন উদার সর্বস্বতা, পোশাক-পরিচ্ছেদের অবিন্যস্ততা দেখানো হয়।
  • (৮) প্রহসনে অতিরঞ্জিত কল্পনা বা অতিরঞ্জিত বিষয়ের অবতারণা থাকে।
  • (৯) প্রহসনে সমাজের কুসংস্কার কুপ্রথা প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়। 
  • (১০) এতে হিউমারের উজ্জ্বল হাস্যরস প্রদর্শিত হওয়ার পরিবর্তে স্যাটায়ারের অসংলগ্ন বিদ্রূপ প্রকাশিত হয়।

উল্লিখিত আলোচনার পটভূমিকায় মধুসূদনের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনাটির প্রহসন সার্থকতা আলোচ্য। এর কাহিনী এবং চরিত্র সমকালীন যুগ চিত্রকে প্রতিবিম্বিত করেছে। মধুসূদন আলোচ্য প্রহসনে ধর্মধ্বজী বৃদ্ধ কৃপণ জমিদার ভক্তপ্রসাদের ব্যভিচারী রূপের পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। এখানে প্রহসনের চরিত্র সৃষ্টিতে কাহিনীগত বাস্তবতা অঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে সমকালীন যুগ চিত্র প্রতিবিম্বিত হয়েছে। হানিফ গাজী, পাঁচী, ভগী প্রভৃতি চরিত্রগুলিও পরিচিত সমাজের চেনা চরিত্র। প্রহসনের কাহিনী বিশেষ কালে বহু আলোচিত বিষয়কে নিয়ে রচিত হয়। এখানে যে সমাজ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাতে দেখা যায় ব্যভিচারী জমিদার বা ধর্মধ্বজী গ্রাম প্রধানদের নৈতিক পঙ্কিলতার প্রতি মধুসূদন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ভক্তপ্রসাদ এই শ্রেণির চরিত্রদের প্রতিনিধি। গদাধর আর পুঁটি ভক্তপ্রসাদের কুকার্যের দুই সহচর। হানিফ শোষিত কৃষক সমাজের প্রতিনিধি হলেও তার চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। একদিকে তার শরীরে আছে আসুরিক শক্তির সাহস, অন্যদিকে সে জমিদারের ভয়ে ভীত। এছাড়া অর্থের ব্যাপারে তার চরিত্রগত দুর্বলতা আছে। সামাজিক ব্যাধিকে অবলম্বন করে আলোচ্য প্রহসনটি লিখিত হলেও সমাজ সংস্কারের কোনো প্রচেষ্টা আলোচ্য প্রহসনে নেই। জৈব প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে পড়েছে, বিত্তবান বৃদ্ধজমিদার সেই শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধি। তার প্রবৃত্তির মধ্যে চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।

সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও মধুসূদন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। প্রহসনের অঙ্গীরস হাস্যরস সে রসের বাহন চরিত্রের শৈথিল্য এবং সরস সংলাপ। এখানে চরিত্র রচনায় মধুসূদন যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চরিত্রগুলিকে প্রহসনের উপযোগী করে তুলেছেন। সংলাপের ক্ষেত্রে মধুসূদন পরিচিত পূর্ববঙ্গীয় গ্রাম্য ভাষার ব্যবহার করেছেন। ভক্তপ্রসাদের কামনা লোলুপতার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে তার সংলাপে।

এছাড়া আলোচ্য প্রহসনে ত্রয়ী ঐক্য রক্ষিত হয়েছে। এখানে সময়, কাল এবং ঘটনাগত ঐক্য যথাযথভাবে গৃহীত হওয়ায় প্রহসনের সমস্ত গুণ পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাহিনীর বাঁধন সম্পর্কে অতিরিক্ত সাবধানতার রস সৃষ্টি বিঘ্নিত হতে পারে। মধুসূদন এই শৈল্পিক কারুকর্ম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলেই হাস্যরস উদ্বোধক প্রহসনের সংক্ষিপ্ত কাঠামোয় প্রয়োজনীয় কাজ দ্রুত মিটিয়ে নিয়েছেন। প্রহসনের সংলাপের যে সমস্ত গুণ থাকা উচিত তা মধুসূদনের আলোচ্য প্রহসনটিতে আছে। স্পষ্টতা সহজতা সংক্ষিপ্ততা সরসতা সবই এখানে থাকার ফলে ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ একটি উল্লেখযোগ্য প্রহসন রূপে সার্থকতা অর্জন করেছে।