বাংলায় প্রহসন শব্দটি ইংরেজি Farce (ফার্স) শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইংরেজি Farce শব্দটি লাতিন Farcita শব্দ থেকে; আবার Farcita শব্দ এসেছে ‘Farcio’ থেকে। বাজে কথায় নিম্নস্তরের ভাঁড়ামি বলতে ‘Farcio’ বোঝানো হয়। তাহলে ফার্স বা প্রহসন বললে বুঝতে হবে— ‘যাতে স্বল্পায়তনের মধ্যে স্থূল রুচিসম্পন্ন লঘু হাস্যরসের প্রকাশ ঘটে।’
পাশ্চাত্যে লঘু রসের নাটককে যে চারিটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে ‘ফার্স’ অন্যতম। ফার্সের সংজ্ঞায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে—“A form of comedy in dramatic art, the object of which is to excite laughter by ridiculous situations and incidents.” আবার নাট্যতত্ত্ববিদ্ নিকল ফার্সের কাহিনিতে অসম্ভাব্যতা ও মাত্রাতিরিক্ততার কথা বলেছেন। ‘গ্রীক কমেডি’ রচয়িতা নরউড্ (Norwood) এর মতে—“Farce may be defined as an exaggerated comedy; its problem is unlikely and absurd, its action ludicrous and one-sided, its manner entirely laughable.”ফার্স বা প্রহসন বলতে কেউ বুঝিয়েছেন—“the type of drama stuffed with low humour and extravagant wit.”
উপরি-উক্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে প্রহসনের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে- (১) প্রহসনের কাঠামো কমেডির মত। (২) মূলরস হাস্যরস। (৩) পরিস্থিতি অদ্ভুত। (৪) মাত্রাতিরিক্ততা। (৫) অসম্ভাব্যতা। (৬) প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি। (৭) চরিত্রের ত্রুটি সমূহের অনুকরণ। (৮) নাট্যকারের পক্ষপাতিত্ব। উনিশ শতকে যাঁরা বাংলা গ্রহসন রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে -উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলা গ্রহসনের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নোক্ত—
(১) আঙ্গিকের দিক থেকে এক বা দুই অঙ্কে বিন্যস্ত, নক্সাধর্মীও হয়ে থাকে এবং একটি ঘটনার সঙ্গে আর একটি ঘটনার মিল নাও থাকতে পারে।
(২) মূল রস হাস্যরস; ভাঁড়ামি বা স্থূল হাস্যরসও অনুপস্থিত নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করুণরস থাকতে পারে।
(৩) সমকালীন ঘটনাকে অবলম্বন করে বিষয়বস্তু গড়ে উঠবে।
(৪) চরিত্র টাইপধর্মী হলেও স্বাতন্ত্র্য থাকবে। চরিত্রগুলি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।
(৫) সংলাপ হবে চরিত্রের মর্যাদানুযায়ী এবং ভাষায় তির্যকতা থাকবে।
এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য থেকে প্রহসনের একটা সংজ্ঞা নির্ণীত হতে পারে—“টাইপধর্মী চরিত্রগুলি তাদের নিজস্ব ভাষাভঙ্গী ও পরিবেশের সীমারেখায় সমকালীন বহু আলোচ্য ঘটনাবলীকে যখন এক থেকে দুই অঙ্কের নাটিকায় জীবন্ত করে তোলে, তখন হাস্যরসাত্মক সেই নাটিকাকে বলা যায় প্রহসন।”
জে. টি. সিপ্লে Farce বলতে বুঝিয়েছেন— “Farce generally means low comedy intended solely to provoke laughter through gesture, buffoonery, action or situation as opposed to comedy of character of manners.”
যাই হোক, ফার্স বা প্রহসনে ঘটনাসন্ধি বা পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কোনো রকম উচ্চস্তরের নাটকীয় কলাকৌশল প্রত্যাশিত নয়। এখানে টাইপ চরিত্রই থাকবে এবং ঘটনার বাহ্যবৈশিষ্ট্য থেকে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যেও প্রচুর প্রহসন লিখিত হয়েছে। সংস্কৃত ‘দৃশ্য-শ্রব্য-কাব্য’-এর অন্তর্গত ‘দশরূপক’-এর অন্যতম হল প্রহসন। ভরত প্রহসনকে দুভাগে ভাগ করেছেন— শুদ্ধ এবং সংকীর্ণ। নাট্যাচার্য ভরতের মতে, শুদ্ধ প্রহসনে শৈবসন্ন্যাসী, তপস্বী, বৌদ্ধ ভিক্ষুক, বেদবিৎ শ্রোত্রিয় ও বিপ্ল— এইসব উচ্চস্তরের চরিত্রই প্রধান। এসব চরিত্র তাদের অসংগত আচরণের মধ্য দিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করে। আর সংকীর্ণ প্রহসনের চরিত্র হবে বিট, বেশ্যা, ধূর্ত, নপুংসক প্রভৃতি। বিশ্বনাথের মতে, প্রহসনের বিষয়বস্তু কবিকল্পিত। সংস্কৃত প্রহসনগুলিতে বিদ্রূপ আছে; তবে সংকীর্ণ প্রহসনে বিদ্রূপের সঙ্গে অশ্লীলতাও থাকে। শুদ্ধ প্রহসন বেশ উন্নত। উভয় দেশের নাট্যতত্ত্ব ও অলংকারতত্ত্বের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, প্রহসন হল একজাতীয় ক্ষুদ্রায়তন নাটক যেখানে হাস্যসৃষ্টি করা হয় এবং এই জাতীয় নাটক নিম্নমানের। বাংলা নাট্যসাহিত্যে সংস্কৃত প্রহসন শব্দটিই গৃহীত হয়েছে।
অবশ্য সংস্কৃত প্রহসনের সঙ্গে বাংলা প্রহসনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাংলা গ্রহসন সব সময় এক অঙ্কে সীমিত এমন বলা যাবে না। শুদ্ধ প্রহসনের বৈশিষ্ট্যও সেখানে প্রায়ই নেই। দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘নাট্যতত্ত্ব বিচার’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন— “পাশ্চাত্ত্যের ফার্স ও সংস্কৃত শুদ্ধ ও সংকীর্ণ প্রহসনের সব লক্ষণগুলিকে মিলিয়ে নিয়ে গ্রহণ বর্জনের সাহায্যে এবং তার সঙ্গে কখনো কখনো লোকনাট্য ও যাত্রার সঙের বৈশিষ্ট্যের একটা মোটামুটি সংস্কার মনে রেখে বাঙালী নাট্যকারদের এ অনেকখানি নূতন ধরনের রচনা। কোনো কোনো নাট্যকার ফরাসী ও ইংরেজি কমেডিরও কিছু কিছু লক্ষণ তাঁদের রচিত প্রহসনে যুক্ত করেছেন। প্রহসন নামটি শ্রুতিমধুর ও বহুকাল প্রচলিত”। অবশ্য বাংলা হাস্যরসাত্মক সমস্ত রচনাকেই যে প্রহসন বলা যাবে এমন নয়। বাংলা প্রহসনকে চারভাগে ভাগ করা যেতে পারে— বিশুদ্ধ প্রহসন, মিশ্র প্রহসন, সামাজিক প্রহসন ও ব্যক্তি ব্যঙ্গাত্মক প্রহসন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘হিতে বিপরীত’; অমৃতলালের ‘ডিসমিস’, ‘তাজ্জব ব্যাপার’, ‘কৃপণের ধন’; দ্বিজেন্দ্রলালের ‘বিরহ’ প্রভৃতি বিশুদ্ধ প্রহসনের অন্তর্গত। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’; দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’, ‘জামাই বারিক’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’; রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ এগুলিকে মিশ্র প্রহসন বলা হয়। সমাজ সমালোচনাত্মক অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের প্রহসনকে সামাজিক প্রহসন এবং ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক প্রহসনকে ব্যক্তি ব্যঙ্গাত্মক প্রহসন বলে। অমৃতলাল বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই জাতীয় কয়েকটি ফার্স লিখেছেন।
Leave a comment