প্রশ্নঃ 
প্রশাসনিক স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা বলতে কি বুঝ? 

ভূমিকাঃ সাম্প্রতিককালে লোক প্রশাসনে যে সকল ধারণা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে, এগুলোর মধ্যে ‘ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব’-এর ধারণা নিঃসন্দেহে অন্যতম। তবে এখানে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বলতে মূলতঃ প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বকেই বুঝানো হয়েছে। শিল্পায়ন, শহরায়ন, অর্থনৈতিক মন্দা এবং যুদ্ধ প্রভৃতি কারণে প্রশাসনের ভূমিকার দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। জনগণও আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের অধিকতর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। যেসব বিষয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেসরকারি খাতে ন্যস্ত ছিল, বর্তমানে তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং সরকারের এ নিয়ন্ত্রণ পরিধি দিন দিন বেড়েই চলছে। জনকল্যাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমিক সম্পর্ক, কৃষি উৎপাদন, বিনিয়োগ ব্যবস্থা, জনসেবা প্রদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান আজ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশাসনিক সংস্থার কর্তৃত্ব ও স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতাও বেড়ে চলেছে।

ক্ষমতা বা প্রশাসনিক ক্ষমতা (Power or Administrative Power): বর্তমানে ‘ক্ষমতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন্দ্রীয় ধারণায় পরিণত হয়েছে। তবে ক্ষমতা শব্দটি মূলতঃ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। সাধারণত ক্ষমতার ধারণাকে তিনটি অর্থে ব্যবহার করা যায়। যথাঃ

প্রথমত, সাধারণ অর্থে, ক্ষমতা হলো দক্ষতা বা সামর্থ্য।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্ষমতাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে ক্ষমতা বলতে একটি বিশেষ ধরনের দক্ষতাকে বুঝায়, যার সাহায্যে কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তিকে তার মতানুযায়ী কোন কাজ করতে বাধ্য করতে পারে।

তৃতীয়ত, কোন ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজে বাধ্য করতে পারে। এ ক্ষমতাকে বল প্রয়োগের ক্ষমতা বলা চলে।

কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতা বলতে সরকারি নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক সংস্থার নিকট অর্পিত ক্ষমতাকে বুঝায়। প্রশাসনিক সংস্থার ক্ষমতার উৎস প্রধানত দু’টি, যথাঃ আইন এবং আইন, রীতিনীতি ও প্রথার অনুমোদনসাপেক্ষে স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা।

প্রশাসনিক স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা (Administrative Discretion): সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার উৎস প্রধানত দু’টি—আইন এবং স্ববিবেচনা। আইনের বিধানের মাধ্যমে স্পষ্ট করে প্রশাসনিক সংস্থার কার্য, কার্যপরিধি ও সীমাবদ্ধতা বর্ণনা করা হয়। কিন্তু প্ৰশাসনে এমন অনেক বিষয় বা সমস্যা দেখা দিতে পারে যার সম্পর্কে কোন স্পষ্ট বিধান নেই বা যদিও এরূপ কোন আইন প্রণয়ন করাও হয় তা অনমনীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য প্রশাসনিক কার্যকে অকেজো বা নিষ্ক্রিয় করে তোলে। কাজেই এরূপ পরিস্থিতিতে প্রশাসকদেরকে প্রশাসনিক সংস্থাকে এরূপ ধরনের ন্যায়সঙ্গত স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রদান করতে হবে, যেন তাঁরা পরিস্থিতি মোতাবেক সঠিক কার্যপন্থা অবলম্বন করতে পারেন।

স্ববিবেচনা বলতে অতি সাধারণ পন্থা বলা যায় যে, বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা থেকে একটি কার্যপন্থা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা এবং সেভাবে কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা। একজন প্রশাসক কাজটি কোনভাবে করবেন তা স্বয়ং নির্ধারণ করার ক্ষমতাই হলো স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা। ফিফনার (Pfiffner)-এর মতে, “আইন সংস্থার নীতি ও কর্মসূচির উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমিত থেকে প্রশাসকরা ব্যক্তিগত বিচার বুদ্ধি প্রয়োগের দ্বারা বিকল্প প্রস্তাবের মধ্য থেকে এটি বেছে নেয়ার ব্যাপারে যে স্বাতন্ত্র্য ভোগ করেন সেটাই হলো স্ববিবেচনা। প্রশাসকে এ স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা যদি প্রত্যাহার করা হয় তাহলে সরকারি কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই সর্বোত্তম পন্থা বেছে নিতে পারবেন না এবং সেভাবে কার্যও সম্পাদন করতে পারবেন না। আর যদি এ ক্ষমতা বলবৎ থাকে এবং তা যদি স্বেচ্ছাচারের সাথে ব্যবহার করা হয় তাহলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাংবিধানিক সরকারের মূল ভিত্তি ক্ষুণ্ন হবে। সে জন্য এ দু’য়ের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমতা বিধান করতে হবে। প্রশাসনিক স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা অবশ্যই থাকতে হবে, তবে তা লাগামহীন হতে দেয়া উচিত নয়। গণতান্ত্রিক দেশে এরূপ ক্ষমতা যুক্তিসঙ্গত আইনের অনুশাসনের ভিত্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

বস্তুত স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা চূড়ান্ত বা স্বেচ্ছাচার ক্ষমতা বুঝায় না এবং অন্যায় ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ করা বুঝায় না। লর্ড হালসবেরির মতে, “স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা আইন ও ন্যায়বিচারের যুক্তিতে প্রয়োগ করা উচিত; কোন ব্যক্তিগত মতামতের মাধ্যমে নয়। আইনের মাধ্যমে, কৌতুকের মাধ্যমে নয়। রবসন (Robson ) বলেছেন, “স্ববিবেচনা খুব কদাচিৎ একটি চূড়ান্ত ক্ষমতা, এ ক্ষমতা সবসময়ই সীমিত এবং ক্ষমতা ন্যায় ও সততার সাথে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। 

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, প্রশাসনিক স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা আইন, নিয়মকানুন, আইনের যথাবিহিত প্রণালী (Due Process of Law) এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা দ্বারা সীমাবদ্ধ।