ভূমিকাঃ সুষ্ঠু প্রশাসনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতার অবস্থান এবং হস্তান্তর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতা এককেন্দ্রিক বা বিকেন্দ্রিক উভয়ই হতে পারে। এ উভয়কেন্দ্রিক ক্ষমতা দ্বারা প্রশাসন দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। তাই বলা যায়, প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এতদুভয়ই বহু প্রচলিত কথা। প্রশাসনের ইতিহাসের সূচনালগ্নে শুধু কেন্দ্রীয় শাসনই প্রচলিত ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে বৃহৎ রাষ্ট্রের ধারণার পাশাপাশি এর প্রশাসন যন্ত্রও ব্যাপকতা লাভ করে আর তখনই দেখা দেয় বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া সুষ্ঠু ও মজবুত শাসনের স্বার্থে তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। এমনকি শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেই নয় পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও বৃহৎ যৌথ কারবারসমূহে প্রশাসন ও তার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্রশাসন ও তার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ লোক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্যতম।
বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিবন্ধকতাসমূহ (Barriers of Decentralization): যদিও বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জনের জন্য একান্ত অত্যাবশ্যক তথাপি এর প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা দেখা যায় তা অত্যন্ত জটিল ধরনের। এরকম সমস্যা প্রায় সকল বৃহদায়তন সংস্থাসমূহেই পরিলক্ষিত হয়। তারা সরকারিই হোক বা বেসরকারি হোক। এ সকল সমস্যার মধ্যে মোটামুটিভাবে চারটি মূল বিশেষভাবে ফুটে উঠে। নিচে এগুলো আলাদাভাবে আলোচনা করা হলোঃ
(ক) ঐতিহ্যগত প্রভাব (Influence of Tradition): ঐতিহ্যগত প্রভাব বিকেন্দ্রীকরণের পথে সর্বপ্রথম বাধা। স্থুল অর্থে, ঐতিহ্যগত প্রভাব লোক প্রশাসনকে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে সুষ্ঠুভাবে খাপ খাওয়াইবার পথে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। প্রশাসনিক সংগঠন স্থবির নয়, এটি নিয়ত পরিবর্তনশীল। এটি জীবন্ত ও পরিবর্তনশীল বাস্তব সত্তা। তাই প্রশাসনিক সংগঠনের নীতিসমূহ সর্বকালে এবং সর্বস্থানে অপরিবর্তনীয় থাকে না। স্থান ও কালভেদে এর নীতিও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। প্রশাসকগণ যখন সংগঠনের এ পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে পারেন না এবং যখন তারা পুরনো নীতি ও পদ্ধতি আঁকড়িয়ে থাকতে চান, তখন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুষ্ঠু নীতি প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অধ্যাপক ব্রুকস্ অ্যাডামস্ (Brooks Adams) প্রশাসন ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পুরনো রীতি পদ্ধতির ব্যবহারকে বিকেন্দ্রীকরণ নীতির বিরোধী ধারণা করেছেন।
এ বাধা পরিবর্তনের পথে প্রশাসনের পক্ষে অত্যন্ত জটিলতার সৃষ্টি করে বিশেষ করে যখন প্রশাসনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণ একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক ম্যারিয়াম (Prof. Merriam) যথার্থই উক্তি করেছেন যে, “পরিশেষে অত্যধিক কেন্দ্রীকরণ পদ্ধতি নিজেকে ধ্বংস করে এর সকল মহৎ উদ্দেশ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন না হয়ে পারে না।”
(খ) কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা (The Requirements of Central Control and Supervision): দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা। যে কোন প্রশাসনিক সংগঠনকে একটি মূল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং তা হলো প্রশাসন সংক্রান্ত কি কি বিষয় কেন্দ্রীয় দপ্তরের (Central office) এবং কি কি বিষয় আঞ্চলিক অফিসের (Field office) অধীনে থাকবে। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, আঞ্চলিক দপ্তরগুলো কেন্দ্রীয় দপ্তরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে কি না সে ব্যাপারে। কিন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রধান ও সাধারণ পদ্ধতিগুলো হচ্ছে, কেন্দ্রীয় বিধি-বিধান (Central regulations) এবং সিদ্ধান্ত, রিপোর্ট, হিসাব ও নিরীক্ষার অনুমোদন। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের এ সকল পদ্ধতি ছাড়া বিকেন্দ্রীকরণের আরও একটি বিশেষ অসুবিধা আছি।
(গ) স্থানীয় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের প্রভাব (Influence of Local Pressure Groups): বিকেন্দ্রীকরণের অপর উল্লেখযোগ্য সমস্যা স্থানীয় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহের প্রভাব ও প্রতিপত্তি। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী একটি সুসংগঠিত প্রচেষ্টা যা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া সরকারি নীতিসমূহকে প্রভাবিত করে থাকে। আইনসভার বাহিরে অবস্থান করে তারা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যে শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অতি দুর্বল এবং যাতে আঞ্চলিক সংস্থার কর্মচারীদের উপর অত্যধিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়োজিত থাকে সে শাসনব্যবস্থায় সরকারি নীতিসমূহ স্থানীয় জনগণ কর্তৃক অযাচিতভাবে প্রভাবিত হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিরাজমান থাকে। তাদের প্রভাব অনেক সময় এত সুদৃঢ় হতে পারে যে, এর ফলে জাতীয় নীতি পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়। স্থানীয় এলাকার কর্মচারিগণ দুটি প্রধান কারণে স্থানীয় চাপ ও প্রভাব এড়াতে পারে না। কারণগুলো নিম্নরূপঃ
প্রথমত, স্থানীয় কর্মচারিগণ যতই ক্ষমতাশীল হোক না কেন তারা অধস্তন কর্মচারী এবং তদনুসারে তারা ভাতা পেয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, অবশ্যম্ভাবীরূপে যে কোন স্থানীয় কর্মচারীর সম্মান ও পদমর্যাদা কেন্দ্রে নিয়োজিত কর্মচারী অপেক্ষা কম হবে যার দায়িত্ব অধিকতর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। কিন্তু যদি স্থানীয় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী এক বৃহৎ এলাকার জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে এর প্রভাব অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত।
(ঘ) বিভিন্ন বিকেন্দ্রিক সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় (Coordinating the Various Decentralized Units): বিকেন্দ্রিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই বিকেন্দ্রীকরণের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। প্রশাসন ব্যবস্থার আঞ্চলিক দপ্তরগুলোকে অবশ্যই একত্রিত করে তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যে ঐক্য আনয়ন করা একান্ত জরুরি। অধ্যাপক ওয়াল্ডো তাই বলেন যে, “যে কোন বৃহদায়তন সংগঠনে তার বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে এনমভাবে পারস্পরিক ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক যাতে সমগ্র সংগঠনটি একটি ইউনিটরূপে কাজ করে, আর এটি প্রশাসনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।” (In any large organization the equitable balancing of all divisions of the enterprise in such a way that the whole will operate as a unit becomes the central concern or administration.) সমন্বয় সাধনের এ কাজ এককেন্দ্রিক সংস্থায় অতি সহজেই লাভ করা যায়। কারণ এ সংস্থা যেহেতু একটি ক্ষুদ্র এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে কাজেই এতে ঘন ঘন যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। তাছাড়া কর্মচারীদের মধ্যেও যোগাযোগ রক্ষিত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, বিকেন্দ্রিক সংস্থায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক প্রশাসনের মধ্যে সহজে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। বিশেষত আঞ্চলিক দপ্তরসমূহ যখন কেন্দ্রীয় দপ্তর হতে অনেক দূরে অবস্থান করে তখন এ সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এতে প্রশাসন ব্যবস্থায় জটিলতা বৃদ্ধি পায় এবং সামগ্রিক জাতীয় নীতি রক্ষা করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাতে বিকেন্দ্রিক সংস্থাসমূহে সমন্বয় সাধনের নিমিত্ত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
অতএব, সুষ্ঠু বিকেন্দ্রীকরণের জন্য উপরোল্লিখিত সমস্যাসমূহ দূরীভূত করা একান্ত আবশ্যক। এরূপ সমস্যাগুলো যখন অন্তর্হিত হবে তখনই কেবল যথাযথ, অর্থবহ ও কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণের নীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
Leave a comment