ভূমিকাঃ সুষ্ঠু প্রশাসনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতার অবস্থান এবং হস্তান্তর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতা এককেন্দ্রিক বা বিকেন্দ্রিক উভয়ই হতে পারে। এ উভয়কেন্দ্রিক ক্ষমতা দ্বারা প্রশাসন দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। তাই বলা যায়, প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এতদুভয়ই বহু প্রচলিত কথা। প্রশাসনের ইতিহাসের সূচনালগ্নে শুধু কেন্দ্রীয় শাসনই প্রচলিত ছিল । কিন্তু যুগের পরিবর্তনে বৃহৎ রাষ্ট্রের ধারণার পাশাপাশি এর প্রশাসন যন্ত্রও ব্যাপকতা লাভ করে আর তখনই দেখা দেয় বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া সুষ্ঠু ও মজবুত শাসনের স্বার্থে তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। এমনকি শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেই নয় পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও বৃহৎ যৌথ কারবারসমূহে প্রশাসন ও তার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্রশাসন ও তার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ লোক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্যতম।
বিকেন্দ্রীকরণের কুফল বা অসুবিধাসমূহ (Disadvantages of Decentralization): প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের যেমন কিছু সুবিধা রয়েছে তেমনি এর আবার কতকগুলো অনস্বীকার্য অসুবিধা বা কুফলও রয়েছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলোঃ
১। নীতি নির্ধারণ ও রক্ষায় বাধার সৃষ্টি করেঃ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সামগ্রিকভাবে জাতীয় নীতি নির্ধারণ ও রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা করবে। সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য যে সমরূপতা এবং ঐক্য প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ তা বিনষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে যেখানে সরকারের নীতি দেশকে সামগ্রিকভাবে প্রভাবিত করে সেখানে বিকেন্দ্রীকরণের নীতি জটিল প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে।
২। দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়ঃ বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীৰ্ণ হয়। কর্মচারীগণ কেবলমাত্র স্থানীয় এলাকাসমূহে নিজেদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। এর ফলে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহ সংকীর্ণ রূপ পরিগ্রহ করবে এবং সামগ্রিক জাতীয় কল্যাণ বাধাপ্রাপ্ত হবে।
৩। কারিগরি বিদ্যা ও কর্ম বিশ্লেষণের পথে বাধাস্বরূপঃ বিকেন্দ্রীকরণের অর্থ হলো প্রশাসনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক এককে বিভক্ত করে শাসনকার্য পরিচালনা করা। এ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক এককগুলো প্রায়ই কারিগরিবিদ্যা এবং কর্ম-বিশ্লেষণীকরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য যে কোন সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য কারিগরি জ্ঞান ও কর্ম-বিশ্লেষীকরণের মাধ্যমে দক্ষতা আনয়ন করা অত্যাবশ্যক।
৪। সীমা নির্ধারণ করা কঠিনঃ বিকেন্দ্রীকরণ প্রশাসন ব্যবস্থায় আঞ্চলিক এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা একটি বড় সমস্যা। কর্মের দিক হতে কোন আঞ্চলিক এলাকার অপর একটি আঞ্চলিক এলাকা হতে সম্পূর্ণ পৃথক হতে পারে। সমস্যার দিক হতে বিভিন্ন আঞ্চলিক এলাকার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে।
৫। ব্যয়ভার বৃদ্ধি করেঃ বিকেন্দ্রীকরণ নীতি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা প্রশাসনের ব্যয়ভার বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলবে। সঠিক ও যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য আঞ্চলিক ক্ষেত্রে দপ্তরসমূহ এবং কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাতে জাতীয় অর্থের উপর চাপ বৃদ্ধি পায়৷
৬। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভিন্নতা দেখা যায়ঃ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব বিভিন্ন বিভাগের উপর অর্পিত থাকে বিধায় নিয়মকানুন, রীতিনীতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা রকম বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তদুপরি সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে প্রশাসনিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৭। ক্ষতির সম্ভাবনা বেশিঃ অনেক সময় প্রশাসনকে এমন জরুরি অবস্থার মোকাবিলা করতে হয় যখন জরুরি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন আঞ্চলিক দপ্তর বা কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গেলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বিধায় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তটি একমাত্র কাম্য বলে প্রতীয়মান হয়।
৮। কর্মচারী অযোগ্যতা ও অদক্ষতার পরিচয় দেয়ঃ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মচারীগণ অনেকটা অযোগ্যতা ও অদক্ষতার পরিচয় দান করে। এ সকল নিম্নতম কর্মচারীগণ অনেক সময় বিচক্ষণতার সাথে কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহারও নিম্নতম কর্মচারীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়।
পরিশেষঃ উপরোক্ত আলোচনা হতে এটি স্পষ্ট যে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সুফল ও কুফল উভয় বিদ্যমান। প্রশাসন ব্যবস্থার সম্পূর্ণটি কেন্দ্রীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ কোনটাই এককভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। উভয় ব্যবস্থাতেই সুবিধা-অসুবিধা দুই ই রয়েছে। কাজেই সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য যা সর্বাপেক্ষা ভাল ফলাফল দিতে পারে তা হচ্ছে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের যথাযথ সমন্বয় ও সংযোজন।
Leave a comment