মার্কসীয় রাষ্ট্রচিত্তার ইতিহাসে একটি বিশ্ববিখ্যাত রচনা হল মার্কস-এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Manifesto of the Communist Party)। এই ম্যানিফেস্টো সমাপ্ত হয়েছে বিপ্লবের মেহনতি মানুষের কাছে এক উদাত্ত আহ্বানের মাধ্যমে। এই আহ্বানে বলা হয়েছে: “সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ এক হও” (“WORKING MEN OF ALL COUNTRIES, UNITE!”)। ম্যানিফেস্টোর এই বাণীটির মধ্যেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল কথা নিহিত আছে। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে যে ভাবধারাটি পরিব্যাপ্ত আছে তা হল, দেশ ও জাতি নির্বিশেষে সকল দেশের মেহনতি মানুষের ঐক্য ও সংহতির আদর্শ। প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্টদের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গেও ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন: ‘অন্যান্য শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির থেকে কমিউনিস্টদের পার্থক্য শুরু এই ক্ষেত্রে যে: (১) বিভিন্ন দেশের প্রলেতারিয়েতের জাতীয় সংগ্রামসমূহের মধ্যে তারা যাবতীয় জাতিসত্তা নির্বিশেষে সমগ্র প্রলেতারিয়েতের সাধারণ স্বার্থসমূহের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সেগুলিকে সামনে টেনে আনে। (২) বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম বিভিন্ন পর্যায়ের ভিতর দিয়ে বিকশিত হয় এবং তারা সর্বদা ও সর্বত্র সমগ্র আন্দোলনেরই স্বার্থসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে’ (“…I. In the national struggles of the proletarians of the different countries, they point out and bring to the front the common interests of the entire proletariat, independently of all nationality. 2. In the various stages of development which the struggle of the working class against the bourgeoisie has to pass through, the always and everywhere represent the interest as a whole.”)। ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলসের এই বক্তব্যের মাধ্যমে মার্কসবাদীদের আন্তর্জাতিক প্রকৃতি প্রকাশিত হয়েছে।

পৃথিবীর সকল দেশের মেহনতি মানুষের মৌলিক স্বার্থ অভিন্ন। ধনতান্ত্রিক শাসন-শোষণের উৎপাদনই হল শ্রমিক শ্রেণীর মূল স্বার্থ এবং এই স্বার্থ অভিন্ন। এই অভিন্ন স্বার্থের চেতনা ও অনুপ্রেরণা বিশ্বের শ্রমজীবী জনতাকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে। এই উপলব্ধি প্রলেতারী আন্তর্জাতিকতাবাদের বনিয়াদ রচনা করে এবং দুনিয়ার মজুরের কাছে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাকে অপরিহার্য প্রতিপন্ন করে। তা ছাড়া সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের স্বার্থে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম এবং শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সাফল্যের স্বার্থে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা অত্যন্ত জরুরী। মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান এবং পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিক-শ্রেণীর মুক্তির স্বার্থে সমাজতন্ত্র অপরিহার্য। সমাজতন্ত্রের জন্য শ্রমিক-শ্রেণীকেই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শ্রমিকশ্রেণীর রাজনীতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সময় থেকেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা শ্রমিকশ্রেণীর হাতে একটি মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই হাতিয়ার হল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার।

পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশের ধারায় সংঘটিত জাতীয় সংগ্রামসমূহ হল আসলে বুর্জোয়া শ্রেণীসমূহের আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম। এই সংগ্রামে শ্রমিক-শ্রেণীও সামিল হয়। কারণ বুর্জোয়ারা তাদের এই সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত করে। রাজনীতির অঙ্গনে আবির্ভূত হয়ে প্রলেতারিয়েতের সাধারণ শিক্ষা ও রাজনীতিক জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হয়। কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মেহনতি মানুষের সংগ্রাম সমপ্রকৃতিসম্পন্ন ও সুসংহত হয়ে উঠে। সকল দেশের শ্রমজীবী জনতার সংগ্রামের কর্মসূচী অভিন্ন প্রতিপন্ন হয়। এইভাবে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের আন্তর্জাতিক আকৃতি-প্রকৃতি প্রকাশিত হয়। এই কারণে বিশেষ একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্য সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট দেশের বিজয়ী শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকার সমাপ্তি ঘটে না। এই শ্রমিক শ্রেণীর তৎকালীন দায়িত্ব এবং বৈপ্লবিক কর্তব্য হল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামকে সত্বর সফল ও জয়যুক্ত করার জন্য সক্রিয়ভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। এই ধারণার মধ্যেই প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের সারকথা বর্তমান। লেনিনের অভিমত অনুসারে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার এই আদর্শ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধমান সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টিগুলিকে অনুসরণ করতে হবে। সকল দেশের শ্রমিক-শ্রেণীর সংগ্রাম এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক চেহারা ধারণ করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যেকোন একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলেই যাবতীয় জাতীয় পরিচয় বা স্বাতন্ত্র্য অবলুপ্ত হবে এবং সমগ্র দেশবাসী এক দেহে লীন হয়ে একাকার হয়ে যাবে, এ ধারণা যথার্থ নয়। এমন এক অবস্থা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন হল দুনিয়া জুড়ে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সুদৃঢ় বনিয়াদ। তা হলেই বিভিন্ন জাতি একই সত্তায় লীন হয়ে যাবে এবং পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহের যাবতীয় পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য ধুয়ে মুছে যাবে। এইভাবে এক আন্তর্জাতিক সমাজের সৃষ্টি হবে। এবং এই সমাজ হবে সীমাহীন। তবে সুদীর্ঘ এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পরিণতিতে এই আন্তর্জাতিক সমাজ গড়ে উঠবে।

পুঁজিবাদের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে পরিচালিত শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম এক সুদীর্ঘ গতিধারার অন্তর্ভুক্ত। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সুদীর্ঘ গতিপথে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। পারি-কমিউনের সময় পর্যন্ত প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা শ্রমজীবী জনতার আন্তর্জাতিক সংহতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনও কোন একটি দেশের মেহনতি মানুষের সংগ্রামের প্রতি পৃথিবীর অপরাপর দেশের শ্রমিক-শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন ঘোষণার পর্যায়ে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা পৌঁছায়নি। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের পর দুনিয়ায় মেহনতি মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতির অভূতপূর্ব অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়। এই সময় পৃথিবীর প্রথম নবজাত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী জনতা হুংকার ছাড়ল ‘রাশিয়ার উপর থেকে হাত উঠাও”। কারণ ঐ সময় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী বিভিন্ন রাষ্ট্র চক্রান্তমূলক অভিযান শুরু করেছিল। এবং তার বিরুদ্ধেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এইভাবে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা এক নতুন মাত্রা লাভ করে এবং বিকশিত হয়।

মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের পার্থক্যের কথাও বলা হয়। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মধ্যে জাতিতে জাতিতে মিলনের পরিবর্তে সংঘাতের কথাই নিহিত আছে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ হল পরজীবী শোষক-শ্রেণীসমূহের স্বার্থ ও মতাদর্শের ধারক ও বাহক। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যেই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিকশিত রূপের অভিব্যক্তি ঘটে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাতিগত অত্যাচারের ন্যায্যতা স্বীকার করার ব্যবস্থা করা হয়। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ হল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এক কূটকৌশল। এর উদ্দেশ্য হল শ্রমজীবী জনতার মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতার সৃষ্টি করা এবং তাদের দুর্বল করে দেওয়া।

প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ হল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিরোধী। লেনিন বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের কথা বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ ও প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা হল দু’টি পরস্পর-বিরোধী শত্রুভাবাপন্ন ধারণা – ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার দুই শত্রুশিবিরের মতই। মার্কসবাদে জাতির জনগণের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে জাতি সম্পর্কিত সমস্যাটির বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। প্রলেতারিয়েতরা একটি জাতির উপর অন্য একটি জাতির শোষণ পীড়নের বিরোধিতা করে এবং অন্য জাতির উপর নিজের নির্যাতনেরও বিরোধিতা করে।

শ্রমজীবী জনতাই হল যথার্থ দেশপ্রেমিক। তারাই হল দেশ ও জাতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। মেহনতি মানুষের দেশপ্রেমের মধ্যে জাতি-বিদ্বেষ থাকে না। তারা সকল জাতির মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারকে স্বীকার ও সমর্থন করে। এই কারণে শ্রমিক শ্রেণীর দেশপ্রেমই হল প্রকৃত দেশপ্রেম। এবং প্রকৃত দেশপ্রেমের সঙ্গে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন বিরোধ নেই, বরং উভয়ের মধ্যে নিবিড় বন্ধন বর্তমান। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণীর জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন সংঘাত নেই, বরং সংযোগ আছে। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরোধী, কিন্তু বিভিন্ন জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করে থাকে। তবে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদে প্রলেতারিয়েতের মুক্তির সংগ্রামকে ও আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় সংহতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এতদসত্ত্বেও প্রলেতারীয় জাতীয়তাবাদে জাতীয় স্বার্থকে অবহেলা করা হয় না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ নিজেদের দেশের এবং অন্য সকল দেশের জনসাধারণের স্বার্থকে উপেক্ষা করে না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদ অনুসারে জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষের অবসান এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থির সম্প্রীতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অপরিহার্য শর্ত হল বভিন্ন জাতির স্বাধীনতা ও অবাধ বিকাশকে সুনিশ্চিত করা।

মার্কস-এঙ্গেলসের দেহাবসানের পর লেনিন নতুন যুগে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কালোপযোগী ব্যাখ্যা দেন। ‘সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ এক হও’ মার্কস-এঙ্গেলসেরই এই আহ্বানকে একটু বাড়িয়ে তিনি বললেন, ‘সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ ও নিপীড়িত জাতিসমূহ এক হও’। লেনিনের অভিমত অনুসারে পুঁজি হল একটি জবরদস্ত আন্তর্জাতিক শক্তি। এই শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সফল করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রমিক-সম্প্রীতি ও শ্রমিক-সৌভ্রাতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শ্রমজীবী জনতার স্বার্থেই দরকার হল বিভিন্ন দেশ ও জাতির মেহনতি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, সম্প্রীতি ও সম্ভাব। লেনিনের মতানুসারে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতাবাদের সারমর্ম হল বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে সকল দেশের শ্রমজীবী জনতার জাতীয় বাহিনীসমূহের পারস্পরিক সাহায্য-সমর্থন। তাছাড়া মেহনতি মানুষের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের অন্যতম অংশ হল স্ব-স্ব দেশে প্রগতিশীল বিপ্লবের জন্য সংগ্রামের সামিল হওয়া।