মার্কসবাদে প্রলেতারিয়েতের গুরুত্ব

মার্কসীয় দর্শনে প্রলেতারিয়েত সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কস-এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ (Manifesto of the Communist Party) শীর্ষক রচনায় একটি শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েত প্রসঙ্গে আলোচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা বার বার প্রলেতারিয়েত কথাটি ব্যবহার করেছেন। শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েতের উদ্ভব ও বিকাশধারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদী শাসন-শোষণ তথা পুঁজিবাদের অবসান এবং সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের অনিবার্যতা বাস্তবায়িত হবে এই প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর নেতৃত্বে। তাদের আরও অভিমত হল যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যথার্থ বিপ্লবী শ্রেণী বলতে এই প্রলেতারিয়েত শ্রেণীকেই বোঝায়। এই শ্রেণী যে সংগ্রামের সামিল হয়, তার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র নিজেদের মুক্তি সাধনের মত সংকীর্ণ নয়। প্রলেতারীয় সংগ্রামের মৌলিক উদ্দেশ্য হল মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান এবং সামগ্রিকভাবে মানব সমাজের মুক্তি। সুতরাং মার্কসবাদী আলোচনায় প্রলেতারিয়েত ও তার ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নেই।

প্রলেতারিয়েতের সংজ্ঞা—এঙ্গেলস

প্রলেতারিয়েত কথাটির অর্থ সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া আবশ্যক। প্রলেতারিয়েত শব্দটির অর্থের একটি বিবর্তন বা বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীটি পুঁজিবাদের বিকাশের শতক হিসাবে পরিচিত। এই শতকের গোড়ার দিকেই প্রথম প্রলেতারিয়েত কথাটির প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে সাধারণভাবে শ্রেণী হিসাবে উপার্জনকারী শ্রমিকদের বোঝানোর জন্য প্রলেতারিয়েত শব্দটি ব্যবহার করা হত না। ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণামূলক গ্রন্থের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস বলেছেন যে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থে তিনি ‘শ্রমিক, শ্রমিক শ্ৰেণী, বিত্তহীন শ্রেণী, প্রলেতারিয়েত’ শব্দগুলি সমার্থকভাবে ও একই বিষয়কে ব্যক্ত করতে ব্যবহার করেছেন। আবার ‘কমিউনিজমের’ মূলনীতি শীর্ষক রচনায় এঙ্গেলস পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রলেতারিয়েতের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে প্রলেতারিয়েত হল একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণী। তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয়ের উপরই এই শ্রেণীর জীবিকা নির্বাহের উপায় পুরোপুরি নির্ভরশীল। এদের জীবিকা পুঁজি থেকে প্রাপ্ত মুনাফার উপর নির্ভরশীল নয়। শ্রমশক্তির চাহিদার উপর প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর ভাল-মন্দ, বাঁচা-মরা সংক্ষেপে সমগ্র অস্তিত্বটাই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। প্রকৃত প্রস্তাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রমিক শ্রেণীই হল প্রলেতারিয়েত বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণী। আবার ম্যানিফেস্টোর ইংরেজী সংস্করণের (১৮৮৮) টীকায়ও এঙ্গেলস প্রলেতারিয়েত কথাটির অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যা অনুসারে আজকালকার মজুরি শ্রমিকেরাই হল প্রলেতারিয়েত। তাদের হাতে উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থাকে না। এই কারণে জীবনধারণের জন্য তারা নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় জীবিকা নির্বাহের জন্য যারা নিজেদের শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হয় তাদেরই প্রলেতারিয়েত বলা হয়।

প্রলেতারিয়েতের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:

প্রলেতারিয়েতের একটা ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আছে। অনেকের মতে ‘প্রলেস’ শব্দটি থেকে প্রলেতারিয়েত শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। ‘প্রলেস’ হল একটি লাতিন শব্দ। এই লাতিন শব্দটির অর্থ হল সন্তান-সন্ততি। রোমান আমলে নাগরিকদের একটি বিশেষ অংশকে প্রলেতারিয়েত বলা হত। এদের নিজস্ব বলতে ছিল কেবল শারীরিক শক্তি ও নিজেদের সন্তান-সন্ততি। নিজেদের সম্পত্তি বলতে এদের আর কিছু ছিল না। রোমান সভ্যতার বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে নাগরিকরা বিত্তবান ও বিত্তহীন— এই দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। রাষ্ট্রকে বিত্তবানরা কর দিত এবং বিত্তহীনরা দিত নিজেদের বাহুবল ও সন্তান-সন্ততি। বিত্তহীন ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের নিযুক্ত করা হত সম্পত্তিবানদের ধন-সম্পত্তি সংরক্ষণের কাজে এবং সৈন্য সামস্তের কাজে।

প্রলেতারিয়েতের আবির্ভাব

প্রলেতারিয়েতের আবির্ভাব ঘটেছে শিল্প-বিপ্লবের ফল হিসাবে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রলেতারিয়েত হল পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার এক অপরিহার্য উপাদান বা অনিবার্য পরিণতি। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী যন্ত্রপাতি সৃষ্টি করেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে এই যন্ত্রপাতির চালকদের বা প্রলেতারিয়েতদের সৃষ্টি করেছে। বুর্জোয়া শ্রেণী আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী হিসাবে যাদের গড়ে তুলেছে, তারাই হল প্রলেতারিয়েত। পুঁজির পরিমাণ ও বুর্জোয়া শ্রেণী যত বাড়তে থাকে প্রলেতারিয়েতের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। তাদের শ্রম শক্তির জন্যই প্রলেতারিয়েতরা বুর্জোয়াদের কাছে গুরুত্ব লাভ করে। প্রলেতারিয়েতের শ্রম-শক্তির ভিত্তিতেই পুঁজিপতিদের পুঁজির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই ধারা যতদিন অব্যাহত থাকে ততদিন পুঁজিপতিদের কাছে প্রলেতারিয়েতের গুরুত্বও অব্যাহত থাকে।

প্রলেতারিয়েতের পণ্য স্বরূপ

জীবনধারণ বা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বুর্জোয়াদের কাছে শ্রম শক্তি বিক্রয় করতে প্রলেতারিয়েতরা বাধ্য থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় অন্যান্য পণ্যের মত প্রলেতারিয়েতও অন্যতম একটি পণ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। যে কোন পণ্যের চাহিদার ও মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। অনুরূপভাবে প্রলেতারিয়েত বা তাদের শ্রম-শক্তির চাহিদা ও মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে। ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন: ‘বুর্জোয়া শ্রেণী অর্থাৎ পুঁজি যে হারে বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ লাভ করে প্রলেতারিয়েত। আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী, মেহনতী মানুষের এই শ্রেণীটি বেঁচে থাকতে পারে, যতক্ষণ তাদের কাজ জোটে। এদের কাজ জোটে ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে বাড়তে থাকে পুঁজি’ (“In proportion as the bourgeoisie ie capital, is developed in the same proportion is the proletariat, the modern working class, developed a class of labourers, who live only so long as they find work, and who find work only so long as their labour increases capital”)। ‘প্রলেতারিয়েতরা নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে বাধ্য হয়। ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রীর মত তারাও পণ্য দ্রব্যের সামিল বলে বিবেচিত হয়। এবং এই কারণে তারা প্রতি-নিয়ত প্রতিযোগিতার যাবতীয় প্রতিকূলতা ও বাজারের সকল ধরনের নামাওঠার অধীন’ (“These labourers, who must sell themselves piecemeal, are a commodity, like every other article of commerce, and consequently exposed to all the vicissitudes of competition, to all the fluctuations of the market.”)।

অন্যান্য শ্রমিকগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের পার্থক্য

শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েতের আবির্ভাবের গোড়ার দিকে শ্রমিক গোষ্ঠী, শহরের কারিগর বা কৃষি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের বড় একটা পার্থক্য করা হত না। অর্থাৎ অন্যান্য শ্রমিকদের সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের পার্থক্য ছিল সামান্যই। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েত নিজের চরিত্রগুণে বিশেষ প্রকৃতিযুক্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীন কৃষক ও কারিগরদের হাতে অল্পবিস্তর উৎপাদনের হাতিয়ার ছিল। তারা বহুলাংশে নিজেদের জন্য শ্রম করত। কিন্তু প্রলেতারিয়েত হিসাবে পরিচিত শ্রমজীবী গোষ্ঠীর হাতে উৎপাদনের কোন উপকরণ ছিল না। প্রলেতারিয়েতরা পরিশ্রম করতে বাধ্য হত নিজেদের জন্য নয়। তাদের পরিশ্রম করতে হত অপরের লাভের জন্য, অর্থাৎ পুঁজির মালিকদের মুনাফা লাভের জন্য। প্রলেতারিয়েত বিক্রয় করে নিজের শ্রম-শক্তিকে, অর্থাৎ নিজেকে। এক ধরনের পণ্যের মতই সে নিজেকে বিক্রী করে এবং তার বিনিময়ে সে মজুরি গ্রহণ করে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যখন ব্যাপক ভিত্তিতে যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন শুরু হল তখনই এক শ্রেণীর মেহনতী মানুষের সৃষ্টি হল। এরাই হল প্রলেতারিয়েত। তারা তাদের দেহটিকেই পণ্য হিসাবে বাজারে নিয়ে আসে। তারা চাকরির সন্ধানে প্রতিযোগিতার এক আবর্তে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলে। এই প্রতিযোগিতার সম্পূর্ণ প্রকাশ প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের অভিমত হল, এ হল সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হল বাঁচার জন্য, অস্তিত্বের স্বার্থে, সমস্ত কিছুর উদ্দেশ্যে। এই যুদ্ধই হল আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের প্রধান বিষয়।

প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীই সর্বাধিক শোষিত-পীড়িত

প্রলেতারিয়েতই সমাজের একমাত্র শোষিত শ্রেণী নয়। সমাজে অন্যান্য অত্যাচারিত শ্রেণীও আছে। কিন্তু এই সমস্ত শ্রেণীর সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের একটা মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে শোষণের প্রকৃতি প্রসঙ্গেই এই পার্থক্যটি মৌলিক। পুঁজিবাদের বিকাশের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী আবির্ভাব ঘটে আধুনিক শ্রমিক শ্রেণী বা প্রলেতারিয়েতের। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রলেতারিয়েতের শ্রম-শক্তি পণ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। জীবনধারণের জন্য প্রলেতারিয়েতকে নিজের শ্রম-শক্তি বিক্রয় করতে হয়। এরাই পুঁজিবাদী শোষণের যাঁতাকলে সর্বাধিক পিষ্ট হয়। সমাজের অন্য কোন শ্রেণীর উপর এমনভাবে শোষণ-পীড়ন চলে না। প্রতিনিয়তই প্রলেতারিয়েতরা তাদের উপর শোষণটি ও শোষণের চরিত্রটা অনুভব করে। এই কারণে শ্রেণী হিসাবে একমাত্র প্রলেতারিয়েতরাই শোষণের মূল ভিত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হয়। ক্রমশ তারা এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে শোষণের উৎস হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সুতরাং শোষণ-মুক্তির জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন অপরিহার্য। তাই তারা শোষণের মূল ভিত্তির, উৎপাদনের উদ্দেশ্যেই সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম হয় সামগ্রিক ও তীব্রতর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যান্য শ্রেণীও থাকে। সমাজের এই সমস্ত শ্রেণীও সংগ্রাম করে। তবে অন্যান্য শ্রেণীর সংগ্রামের উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরেই নিজেদের অবস্থার সাধ্যমত উন্নতি সাধন।

প্রলেতারিয়েতের চিন্তা-ভাবনার স্বাতন্ত্র্য

প্রলেতারিয়েতের মত সমাজের অন্যান্য শ্রেণীও দাসত্ব বন্ধনে বাঁধা থাকে। অন্যান্য শ্রেণীও অল্প-বিস্তর শোষিত ও নির্যাতিত হয়। কিন্তু সমাজের অপরাপর অত্যাচারিত শ্রেণীর সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। শোষণের স্বরূপ এবং শোষণের অবসান বা পরিবর্তন প্রসঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীর চিন্তা-ভাবনা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে এই পার্থক্য প্রতিপন্ন হয়। দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ সমাজের অন্যান্য অত্যাচারিত শ্রেণীর চিন্তা চেতনা ও আগ্রহ-উদ্দেশ্য এক ধরনের। এবং এ ক্ষেত্রে প্রলেতারিয়েতের ধ্যান-ধারণা অন্য ধরনের। অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণীর কাছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন চিন্তা-ভাবনার বাইরে। কারণ তাদের আশা ও বিশ্বাস হল যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই তারা অত্যাচার ও শোষণের মাত্রা হ্রাস করতে এবং নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু প্রলেতারিয়েতের জীবনের অভিজ্ঞতা পৃথক প্রকৃতির। প্রলেতারিয়েতের উপলব্ধি অনুসারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ব্যতিরেকে দাসত্ব শৃঙ্খল মোচন বা শোষণ মুক্তি একেবারে অসম্ভব। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দাসত্ব-শৃঙ্খলকে ভেঙ্গে ফেলা যাবে না।

প্রলেতারিয়েতের প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণী

প্রকৃত প্রস্তাবে শোষণের মাত্রার পরিবর্তে শোষণের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য অত্যাচারিত শ্রেণীর সঙ্গে প্রলেতারিয়েতের পার্থক্য স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। প্রলেতারিয়েতকে জীবনধারণের জন্য নিজেকে, নিজের শ্রম-শক্তিকে বিক্রী করতে হয়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদনের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েতের প্রবল ক্ষোভ থাকে। কিন্তু স্বাধীন কৃষক, কারিগর, পেটি বুর্জোয়া প্রভৃতি অন্যান্য শোষিত-নির্যাতিত শ্রেণীর মানুষদের পণ্য উৎপাদনের বিরুদ্ধে সে রকম বিষোদ্গার করতে দেখা যায় না। কারণ এ ব্যাপারে তাদের তেমন একটা ক্ষোভ থাকে। স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসাবে এদের উদ্দেশ্য আলাদা। পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বাজারের যে সমস্ত শর্তের অস্তিত্বের জন্য এই সমস্ত শ্রেণীর উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী, অতিমাত্রায় প্রতিকূল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়, সেই সমস্ত শর্তের অপসারণের ব্যাপারেই এদের আগ্রহ দেখা যায়। সুতরাং পুঁজিবাদের উৎপাদনের ব্যাপারে কেবলমাত্র প্রলেতারিয়েতদেরই আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। তারাই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধনের জন্য মরণ-পণ সংগ্রামের সামিল হয়। ম্যানিফেস্টোতে মার্কস এঙ্গেলস বলেছেন: ‘প্রলেতারিয় আন্দোলন হল বিপুল সংখ্যাধিক্যের স্বার্থে বিশাল সংখ্যাধিক্যের স্বাধীন আত্মসচেতন আন্দোলন। আধুনিক সমাজে প্রলেতারিয়েত হল নিম্নতম স্তর; তাকে যদি নড়তে হয়, উঠে দাঁড়াতে হয়, তা হলে উপরে চাপানো সরকারী সমাজের সমগ্র স্তরটিকে শূন্যে নিক্ষিপ্ত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই (“The proletarian movement is the self conscious, independent movement of the immense majority, in the interest of the immense majority. The proletariat, the lowest stratum of our present society, cannot stir, cannot rise itself up, without the whole superincumbent strata of official society being spring into the air.” ম্যানিফেস্টোতে মার্কস এঙ্গেলস আরও বলেছেন যে, ‘আজকের দিনে যে সমস্ত শ্রেণী বুর্জোয়াদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একমাত্র প্রলেতারিয়েতই হল সত্যিকারের একটি বিপ্লবী শ্রেণী। অন্যান্য শ্রেণীগুলি আধুনিক যন্ত্রশিল্পের সামনে ক্ষয় পেতে পেতে অবশেষে অবলুপ্ত হয়; প্রলেতারিয়েত হল সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও আবশ্যিক সৃষ্টি (“Of all the classes that stand face to face with the bourgeoisie today, the proletariat alone is a really revolutionary class. The other classes decay and finally disappear in the face of modern industry; the proletariat is its special and essential product.”)।

ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বিষয়টিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত, ছোটখাট হস্ত শিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর, কৃষক, এরা সকলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশ হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বটাকে অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই কারণে এরা বিপ্লবী নয়, রক্ষণশীল। বরং বলতে গেলে এরা প্রতিক্রিয়াশীলও। কারণ এরা ইতিহাসের চাকাকে পিছনে ঘোরাবার চেষ্টা করে। আবার দৈবাৎ যদি বা তারা বিপ্লবীও হয়, তা হয় কেবলমাত্র প্রলেতারিয়েত হিসাবে তাদের আসন্ন রূপান্তরের কারণে। এবং এইভাবে তারা তাদের বর্তমান স্বার্থ নয়, ভবিষ্যৎ স্বার্থ রক্ষা করে; নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে তারা প্রলেতারিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েতের বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে তার বিপ্লবী ভূমিকা বিকশিত হয়ে উঠেছে। একটি বিপ্লবী শ্রেণী হিসাবে প্রলেতারিয়েতের বিকাশের সমগ্র ধারাটি কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস এই স্তরগুলি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। 

বিকাশের প্রথম স্তর: ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছেন যে ‘বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের ভিতর দিয়ে প্রলেতারিয়েতকে যেতে হয়। জন্ম মুহূর্ত থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এদের সংগ্রাম শুরু হয়। (“The proletariat goes through various stages of development with its birth begins its struggle with the bourgeoisie.”)। প্রলেতারিয়েতের বিকাশের প্রথম স্তরটি সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের অভিমত অনুসারে, ‘প্রথমে লড়াইটা চালায় বিশেষ বিশেষ শ্রমিকরা আলাদাভাবে। তারপর লড়াইয়ের সামিল হয় এক একটি কারখানার সকল মেহনতী মানুষ। তারপর অভিন্ন অঞ্চলের অভিন্ন পেশার অন্তর্ভুক্ত সকল শ্রমিক লড়াই করতে থাকে। এই লড়াই হল তাদের প্রত্যক্ষ শোষণকারী বিশেষ বুর্জোয়াটির বিরুদ্ধে। এই পর্যায়ে প্রলেতারিয়েতের আক্রমণের লক্ষ্য উৎপাদনের বুর্জোয়া ব্যবস্থাটা নয়, এই আক্রমণের লক্ষ্য হল উৎপাদনের উপকরণ। আমদানি করা যে সমস্ত জিনিস তাদের মেহনতের প্রতিযোগী প্রতিপন্ন হয়, তারা সেগুলিকে ধ্বংস করে, যন্ত্রপাতিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়, কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এই পর্যায়ে শ্রমজীবী মানুষেরা হল সমগ্র দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক অসংহত জনতামাত্র। এবং তারা নিজেদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় টুকরো টুকরো বা ছত্রভঙ্গ।’ ‘এই পর্যায়ে প্রলেতারিয়েতরা নিজেদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে না, লড়াই করে শত্রুর শত্রু – নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ, জমিদার, শিল্পবহির্ভূত বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এই অবস্থায় সমগ্র ঐতিহাসিক আন্দোলনটি কেন্দ্রীভূত থাকে বুর্জোয়াদের হাতেই; এইভাবে অর্জিত প্রতিটি বিজয়ই হল বুর্জোয়াদের বিজয়’।

প্রলেতারিয়েতের বিকাশের প্রথম স্তরে শ্রমজীবী মানুষেরা ছিল অসংগঠিত, ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত। তাদের সকল দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা এই উপলব্ধি তখনও তাদের হয়নি। তখনও তারা তাদের মূল শত্রুকে চিনতে পারেনি। তাদের বিবেচনায় তাদের দুঃখ-দারিদ্র্যের কারণ হল মেসিন বা যন্ত্রপাতি। এই কারণে তারা আক্রমণ করে উৎপাদনের আধুনিক যন্ত্রপাতিকে। তারা মেসিন ভাঙ্গার আন্দোলন শুরু করে। এই পর্যায়ে তারা বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করে না। এই পর্যায়ে বুর্জোয়ারাই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কায়েম করে।

বিকাশের দ্বিতীয় স্তর: ম্যানিফেস্টোতে প্রলেতারিয়েতের বিকাশের দ্বিতীয় স্তরটি সম্পর্কেও বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। কিন্তু যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রলেতারিয়েত শ্রেণী শুধু যে সংখ্যায় বাড়ে তা নয়; তারা বৃহত্তর সমষ্টিতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে, তাদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তারা সেই শক্তি আরও বেশী করে অনুভব করতে থাকে (“But with the development of industry the proletariat not only increases in number, it becomes concentrated in greater masses, its strength grows and it feels that strength more.”)। যন্ত্রপাতির অবিরাম উন্নতি ঘটতে থাকে ক্রমশ আরও দ্রুত তালে। শ্রমিকদের জীবিকা আরও বেশী করে বিপন্ন হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত শ্রমিক ও ব্যক্তিগত বুর্জোয়ার ভিতরকার সংঘাতসমূহ ক্রমশ বেশী করে দুটি শ্রেণীর মধ্যে সংগ্রামের স্বরূপ লাভ করে। তারপর বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা মিলিত সমিতি (ট্রেড ইউনিয়ন) গঠন করতে শুরু করে। তারা জোট বাঁধে মজুরির হার বজায় রাখার উদ্দেশ্যে। মাঝে মাঝে সংঘটিত এই সমস্ত আকস্মিক বিদ্রোহের আগেভাগে প্রস্তুতির স্বার্থে তারা স্থায়ী সমিতি গড়ে তোলে। এখানে ওখানে সংঘাত অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়।’ ‘শ্রমিকরা মাঝে-মধ্যে জয়লাভ করে। কিন্তু এই জয় শুধু সাময়িককালের জন্য। তাদের সংগ্রামের যথার্থ লাভটি আশু ফলাফলের মধ্যে নেই, আছে শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান ঐক্যের মধ্যে’ (“Now and then the workers are victorious, but only for a time. The real fruit of their battles lies, not in the immediate result, but in the ever-expanding union of the workers.”)। আধুনিক শিল্পের সৃষ্টি ও উন্নতি যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তারফলে এই ঐক্য আরও বৃদ্ধি পায়। অভিন্ন প্রকৃতির অসংখ্য আঞ্চলিক লড়াইকে শ্রেণীসমূহের এক জাতীয় সংগ্রামে কেন্দ্রীভূত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ঠিক এই সংযোগটিরই। ‘কিন্তু প্রতিটি শ্রেণী-সংগ্রামই হল একটি রাজনীতিক সংগ্রাম’ (“But every class-struggle is a political struggle.”)।

বিকাশের দ্বিতীয় স্তরে প্রলেতারিয়েত সংগ্রাম করে তাদের বিশেষ বিশেষ কিছু স্বার্থের জন্য। উদাহরণ হিসাবে ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি, কাজের সময়, তাদের ভোটাধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। প্রলেতারিয়েতের বিকাশের এই স্তরটি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই পর্যায়েও শ্রমিক শ্রেণী ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে। এইভাবে তারা শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হয়, নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলে। ট্রেড ইউনিয়ন হল শ্রমিক ঐক্য সৃষ্টির, শ্রমিক-সংহতি গড়ে তোলার এবং শ্রমিক-স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের স্কুল বিশেষ। কিন্তু মূল বিষয় হল এই যে এই পর্যায়েও বুর্জোয়াদের ধনতান্ত্রিক শোষণ অব্যাহত থাকে। তবে প্রলেতারিয়েতের বিকাশের এই দ্বিতীয় স্তরটি অনেক বেশী কেন্দ্রীভূত, সংগঠিত ও সংঘর্ষময়।

বিকাশের তৃতীয় স্তর: ম্যানিফেস্টোতে প্রলেতারিয়েতের বিকাশের তৃতীয় স্তরটি সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ‘সামগ্রিক বিচারে পুরাতন সমাজের শ্রেণীসমূহের ভিতরকার সংঘাত প্রলেতারিয়েতের বিকাশকে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে (“Altogether collisions between the classes of the old society further, in many ways the course of development of the proletariat.”)। এই সমস্ত সংঘাতে বুর্জোয়ারা বাধ্য হয় প্রলেতারিয়েতের কাছে আবেদন জানাতে, তাদের কাছে সাহায্য চাইতে এবং এইভাবে রাজনীতির অঙ্গনে তাদের টেনে আনতে। সুতরাং বুর্জোয়ারা নিজেই তাঁদের রাজনীতিক ও সাধারণ শিক্ষার উপাদানসমূহ প্রলেতারিয়েতকে জোগাতে থাকে; অন্যভাবে বলতে গেলে, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করার অস্ত্রসমূহ প্রলেতারিয়েতের হাতে তারাই তুলে দেয়’ (“The bourgeoisie itself, therefore, supplies the proletariat with its own elements of political and general education, in other words, it furnishes the proletariat with weapons for fighting the bourgeoisie.”)

‘শিল্পের অধিকতর অগ্রগতির ফলে শাসকশ্রেণীগুলির ভিতর থেকে সম্পূর্ণ এক একটি অংশ প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। অথবা অন্তত তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ে। এরাও আবার প্রলেতারিয়েতকে চেতনা ও প্রগতির নতুন নতুন উপাদান জোগায়।’ অবশেষে শ্রেণী-সংগ্রাম চূড়ান্ত মুহূর্তের নিকটবর্তী হয়। এই সময় শাসকশ্রেণী একটা ছোট অংশও নিজেকে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে এবং বিপ্লবী শ্রেণীর সঙ্গে হাত মেলায়। অর্থাৎ বুর্জোয়াদেরই একটা অংশ প্রলেতারিয়েতের পক্ষে চলে যায়। বিশেষত বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের সেই অংশটি যারা ঐতিহাসিক আন্দোলনকে তত্ত্বের দিক থেকে সামগ্রিকভাবে অনুধাবন করার পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে।’

মার্কস-এঙ্গেলসের মতানুসারে ‘বুর্জোয়াদের প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম সারাংশের বিচারে না হলেও, আকারের দিক থেকে প্রথমে একটি জাতীয় সংগ্রাম’ (“Through not in substance, yet in form, the struggle of the proletariat with the bourgeoisie is at first a natural struggle.”) | ম্যানিফেস্টোতে তাঁরা আরও বলেছেন যে, আধুনিক সমাজের অভ্যন্তরে অল্পবিস্তর প্রচ্ছন্নভাবে গৃহযুদ্ধ চলেছে। একটি পর্যায়ে উপনীত হয়ে এই যুদ্ধ প্রকাশ্য বিপ্লবের রূপ ধারণ করে। তখন বলপূর্বক বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ সাধিত হয় এবং প্রলেতারিয়েতের আধিপত্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়’ (“…we traced more or less civil war, raging within existing society, up to the point where that war breaks out into open revolution, and where the violent overthrow of the bourgeoisie lays the foundation for the ways of the proletariat.”) বুর্জোয়ারা ভাবনা-চিন্তা না করেই যন্ত্রশিল্পের অগ্রগতি অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে চলে। এর ফলে শ্রমজীবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা-হেতু বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে সংঘবদ্ধতা-হেতু বিপ্লবী ঐক্য গড়ে উঠে। অর্থাৎ আধুনিক শিল্পের অবাধ অগ্রগতি বুর্জোয়াদের পায়ের তলা থেকে ঠিক সেই ভিত্তিটাই কেড়ে নেয়, যার উপর দাঁড়িয়ে তারা উৎপাদন করে এবং উৎপন্নকে কুক্ষিগত করে। সুতরাং সর্বোপরি বুর্জোয়ারা সৃষ্টি করে তাদেরই সমাধিখনকদের। তাদের পতন এবং প্রলেতারিয়েতের বিজয় দুই-ই সমানভাবে অবশ্যম্ভাবী’ (“The development of Modern Industry, therefore, cuts from under its very foundation on which the bourgeoisie produces and appropriates production. What the bourgeoisie, therefore, produces, above all, is its own gravediggers. Its fall and the victory of the proletariat are equally inevitable.”)

প্রকৃত প্রস্তাবে প্রলেতারিয়েতের বিকাশের তৃতীয় পর্যায় হল তাৎপর্যপূর্ণ। এই পর্যায়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর পতন ঘটে এবং প্রলেতারিয়েতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রেণী-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে মেহনতী মানুষদের এই সত্য অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না যে বুর্জোয়াদের শাসনাধীনে শোষণ থেকে শ্রমজীবী জনতার সর্বাঙ্গীণ ও স্থায়ী মুক্তি নিতান্তই অসম্ভব। সুতরাং বুর্জোয়া ব্যবস্থ । উচ্ছেদ সাধন অপরিহার্য। এবং তখনই প্রলেতারিয়েতের একাধিপত্য সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সংগঠন সম্ভব। বস্তুত শ্রমজীবী জনতার শ্রেণীচেতনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রলেতারিয়েতের এক রূপান্তর পরিলক্ষিত হয়। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রলেতারিয়েতের এই রূপান্তর হল ‘class in itself’ থেকে ‘class for itself’। বিকাশের এই স্তরে প্রলেতারিয়েতরা উপলব্ধি করতে পারে যে তাদের পক্ষে এক মহান কর্তব্য হল রাজনীতিক ক্ষমতা জয় করা। শ্রমিক শ্রেণী সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে তাদের মুক্তি জয় করে নিতে হবে তাদের নিজেদেরই। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা রাজনীতিক ক্ষমতা অধিকারের জন্য শ্রেণী হিসাবে শ্রমিকদের সক্রিয় হতে হবে।

প্রলেতারিয়েতের বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়

প্রলেতারিয়েতের বিজয় ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রলেতারিয়েতের বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবের এই পর্যায়ে প্রথম ধাপের কাজ হল নিজেদের শাসক শ্রেণীর স্তরে উন্নীত করা। এরই সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য কাজগুলি হল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সাফল্যকে সুনিশ্চিত করা ও সমাজতান্ত্রিক পরিকাঠামোর নির্মাণকার্যকে জয়যুক্ত করা। এবং এইভাবে সমাজতন্ত্রের বিকাশের মাধ্যমে অবশেষে শ্রেণীহীন সমাজ বা সাম্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। সুতরাং ম্যানিফেস্টোতে মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে কেবলমাত্র প্রলেতারিয়েতের বিকাশের সাধারণ পর্যায় ও প্রকারগুলি পর্যালোচনা করেননি, সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা প্রলেতারিয়েতের বিকাশের বাঞ্ছিত লক্ষ্য এবং ধারাটিকে সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত করেছেন।