ভুমিকা: একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন নিঃসন্দেহে এক আন্তর্জাতিক প্রবাহ। বিশ্বায়ন পরিবহণ, যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ও বিস্তার ঘটিয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রসমূহের ভৌগােলিক ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে। ইনটারনেট, রেডিয়ানে, টেলিভিশন, টেলিফোন, উপগ্রহ ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ইনটারনেট ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে কীভাবে তথ্য প্রযুক্তি সবাইকে রাষ্ট্রের ধারণায় পরিবর্তন এনেছে, বর্তমানে তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে সার্বভৌমিকতার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত বিপ্লব সনাতনী জাতি-রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী ধরনের ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে, তা আলােচ্য বিষয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় বিপ্লবের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্ব আজ প্রায় নেই বললেই চলে। মহাকাশে পাঠানাে কৃত্রিম যােগাযােগ উপগ্রহ ব্যবস্থার মাধ্যমে মোবাইল ফোন, ইনটারনেট ব্যবস্থা আজ আরও উন্নত। নিঃসন্দেহে যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি বিশ্বায়নের একটি ইতিবাচক দিক।
অভ্যন্তরীণ শাস্তি শৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রগুলিকে বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা রক্ষা করতে হয়। প্রতিটি রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী যেমন তার অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করে তেমনি বিদেশি রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে। দেশের ভৌগােলিক অখণ্ডতাকে রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে সামরিক বাহিনী। কিন্তু আজ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির কাছে সামরিক শক্তি দুর্ভেদ্য নয়। এই যুগে যে-কোনাে রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সীমারেখা অতিক্রম করা আণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির কাছে অত্যন্ত সহজ। বর্তমানে আণবিক শক্তির অধিকারী নয় এমন রাষ্ট্রগুলিকে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র (Inter-Continental Ballistic Missiles) এবং পারমাণবিক অস্ত্রের (Nuclear Weapons) অধিকারী রাষ্ট্রগুলি অতি সহজেই ভীতি প্রদর্শন করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বহু কাজ করিয়ে নেয়।
কাজেই বলা যায় যে, বিশ্বায়ন রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা খর্ব করেছে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত বিপ্লব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উন্নতির ফলে বিশ্বের যে-কোনাে প্রান্তে প্রচার পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এর ফলে সকল রাষ্ট্রের মধ্যে ভৌগােলিক ব্যবধান ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। এককথায় বলা যায়, প্রযুক্তিগত বিপ্লব ভূখণ্ডীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও তার সার্বভৌমিকতার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে।
দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে দরকষাকষির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলি কিছু পরিমাণে স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণও কার্যকর করতে পারে। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে এবং বর্তমানে একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলি স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নীতি অনুসরণ করতে পারছে না। উন্নত রাষ্ট্রসমূহ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে কাঠামােগত পুনর্বিন্যাস সাধন করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশসমূহ যে কাঠামােগত পুনর্বিন্যাসে হাত দেয় তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস, লক-আউট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বিপজ্জনক কার্যে নিয়ােগ, পেনশন না দেওয়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় হ্রাস ও বিলগ্নিকরণ এবং ভরতুকি প্রদান বন্ধ করা প্রভৃতি চরম জনবিরােধী নীতি গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হয়। এইভাবে কাঠামােগত পুনর্বিন্যাসের ফলে দারিদ্র্য, বেকারি এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলস্বরূপ, জনজীবনে বিশেষভাবে অনগ্রসর ও দুর্বল শ্রেণির মানুষের দুঃখদুর্দশা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বলা যায় যে, বিশ্বায়নের ফলে কাঠামােগত পুনর্বিন্যাসে বাধ্য হওয়া রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুন্ন হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, নয়া উদারনীতিবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের সম্প্রসারণকে অপ্রতিরােধ্য করে গড়ে তােলার জন্য সর্বাপেক্ষা কম শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্লোগান দিয়েছিলেন। তাদের মতে, বিশ্বের রাষ্ট্র ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থার মধ্যবর্তী স্থানে কোনাে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রয়ােজন নেই। জাতিপুঞ্জের পূর্বতন মহাসচিব কোফি আন্নান বলেছিলেন, বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযােগিতার শক্তিগুলি কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারিত হতে চলেছে। তার পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা যেমন হ্রাস পেলেও তার সম্পূর্ণ অবসান ঘটতে পারে না তেমনি বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকেও রাষ্ট্রগুলি বেরিয়ে আসতে পারে না। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থে বিশ্বায়নকে কাজে লাগানােই হবে কার্যকর পদক্ষেপ।
Leave a comment