বাংলা গদ্য সাহিত্যের চলিতরীতির পথিকৃৎ হিসেবে প্রমথ চৌধুরীর [১৮৬৮-১৯৪৬] পরিচয় সর্বজন স্বীকৃত। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, সাধু ভাষায় নয়, মৌখিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করতে হবে। তাঁর এ ঘোষণায় প্রতিক্রিয়া হয়েছিল গুরুতর। কিন্তু তাতে বীরবল পিছিয়ে যাননি, তিনি আরো জোরের সঙ্গে মৌখিক ভাষার সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যদিও তাঁর ভাষা সর্বজনীনতা লাভ করেনি; তবু আধুনিক বাংলা গদ্যের সারাদেহে তাঁর প্রবর্তিত চলিত রীতির জয়ের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।

বীরবলই প্রথম চলিত রীতিকে সাহিত্যের জগতে রাজকীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি বাংলা গদ্যকে জীবনীশক্তি দিয়েছেন, যা কথ্যরীতির অবশ্যম্ভাবী লক্ষণ। তাঁর আশ্চর্য উজ্জ্বল গদ্য রচনায় যে আদর্শ ফুটে উঠেছে তা কেবল বিষয়কেন্দ্রিক নয়… কেন্দ্রিক। তাঁর লেখার প্রধান আকর্ষণ তাঁর লেখা পড়লেই মনে হয় সেখানে আর কিছু না থাক মৌলিকতার অভাব নেই। তাঁর যেমন নতুন কিছু বলার আছে, তেমনি নতুন ঢং এ বলার চেষ্টাও আছে।

প্রমথ চৌধুরীর ভাষাদর্শের বৈশিষ্ট্যের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় তিনি কথ্যরীতির পরিশীলিত রূপ নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন। ক্রিয়াপদের কথ্যরূপ, খণ্ড খণ্ড বাক্যাংশ, যুগল ক্রিয়াপদ, অঙ্কের বিভিন্ন অর্থাভাস, বাক্যের আকঙ্কিক বিভাগ বাগভণিতি, বাগবৈদগ্ধা ও ভাষার গাঢ়বন্ধতা, কথ্য বাংলার ফ্রেজ ও ইডিয়ম, পদবিন্যাসের কথ্য ভঙ্গিমূলক রীতি-সবকিছুই তাঁর গদ্যরীতিতে দেখা গিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রবর্তিত গদ্যরীতি বীরবলি গদ্যরীতি নামে প্রখ্যাত।

নতুনত্বের লোভে অনেকে নির্বিচারে অনেক সংস্কৃত শব্দকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন; অথচ যেগুলো ঠিক খাপখায়নি। এ বিষয়ে বীরবলের প্রস্তাব যথোপযুক্ত বিচারের পর গুটিকতককে মুক্তি দিতে হবে। তার ফলে বাংলা ভাষার মধ্যে খানিকটা নির্মলতা আসবে। প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ভাষার সেসব শব্দ গ্রহণ করা যায় যা বাংলা ভাষার সাথে খাপখেয়ে যেতে পারে- “যে কথাটা নিতান্ত না হলে নয়, সেটি যেখান থেকে পার নিয়ে এস, যদি নিজের ভাষার ভিতর তাকে খাপখাওয়াতে পার। কিন্তু তার বেশি ভিক্ষে, ধার কিংবা চুরি করে এনো না।”

নতুনত্বের লোভে অনেকে নির্বিচারে অনেক সংস্কৃত শব্দকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রবেশ করিয়েছেন; অথচ যেগুলো ঠিক খাপখায়নি। এ বিষয়ে বীরবলের প্রস্তাব যথোপযুক্ত বিচারের পর গুটিকতককে মুক্তি দিতে হবে। তার ফলে বাংলা ভাষার মধ্যে খানিকটা নির্মলতা আসবে। প্রয়োজন হলে সংস্কৃত ভাষার সেসব শব্দ গ্রহণ করা যায় যা বাংলা ভাষার সাথে খাপখেয়ে যেতে পারে- “যে কথাটা নিতান্ত না হলে নয়, সেটি যেখান থেকে পার নিয়ে এস, যদি নিজের ভাষার ভিতর তাকে খাপখাওয়াতে পার। কিন্তু তার বেশি ভিক্ষে, ধার কিংবা চুরি করে এনো না।”

বিদগ্ধ ভাষাশিল্পী প্রমথ চৌধুরী ভাষার বহিরঙ্গ প্রসাধনে নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। সংহত, পরিপাটি ক্ষিপ্রলঘু তীক্ষ্ণ। পরিচ্ছন্ন মিতভাষী শাণিত গদ্য রচনায় তিনি আধুনিক বাঙালিকে দীক্ষিত করেছেন। তাঁর গদ্যরীতি ও রচনারীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য মিতভাষিতা ও হীরক কাঠিন্য। প্রাচীন ভারতে মিতভাষণের কদর ছিল। বীরবল মিতভাষণের এই ঐতিহ্যকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিলেন। অল্প কথায় অনেক ভাব প্রকাশের দুরূহ ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর সুচিন্তনীয় মতামত,

“অনেকখানি ভাব মরে একটুখানি ভাষায় পরিণত না হলে রসগ্রাহী লোকের নিকট তা মুখরোচক হয় না। এই ধারণাটি যদি আমাদের মনে স্থান পেত, তা হলে আমরা সিকি পয়সার ভাবে আত্মহারা হয়ে কলার অমূল্য আত্মসংযম হতে ভ্রষ্ট হতুম না।” (বঙ্গসাহিত্যের নবযুগ)

প্রমথ চৌধুরীর চলিতরীতিতে আছে হীরক কাঠিন্য, হীরার ধার ও ঝলক। বস্তুত এটাই তাঁর অনিষ্ট, “ভাষার এখন শাণিয়ে ধার বার করা আবশ্যক, ভার বাড়ানো নয়।” (কথার কথা) শ্লেষ (পায়), বিষম (এপিগ্রাম) ও বিরোধাভাস (প্যারাডক্স) অলংকার ব্যবহারের দ্বারা বীরবল ভাষায় এনেছিলেন হীরার ধার আর ঝলক। সমালোচক অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়ে বলেছেন,

“তাঁর (প্রমথ চৌধুরী) গদ্যরীতিতে আছে সংহতি ও প্রসাদগুণ (ব্রেভিটি ও ক্ল্যারিটি), তাঁর মন ছিল স্বচ্ছ, বুদ্ধিদীপ্ত, মনন-আলোকিত। সাবেক বা হাল আমলের কোনো ঝাঁকুনি বা কুয়াশা তাঁর মনকে ঘোলাটে করতে পারেনি। তাই প্রসাদগুণ (ক্ল্যারিটি) বীরবলি ভাষার অন্যতম প্রধান গুণ।” (বীরবলি গদ্যরীতি: বীরবল ও বাংলা সাহিত্য)

বীরবল বাংলা গদ্যকে দিয়েছিলেন জীবনীশক্তি কিন্তু কবিত্বশক্তির অভাববশত গদ্যকে স্থায়ী শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেননি। প্রমথ চৌধুরীর ভাষার যে বৈশিষ্ট্য তা তাঁর নিজস্ব চলিত বাংলা ভাষার সাহিত্যরূপের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়; যে কারণে পরবর্তীকালে বীরবলি রীতির অন্ধ অনুসরণ হয়নি। বীরবলি রচনায় শ্লেষ-কথক বিষম-বিরোধাভাস, ব্যঙ্গোক্তি -অনুপ্রাসের প্রাচুর্য গদ্যকে সুখপাঠ্য করেছে বটে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সেই গাম্ভীর্য ও কমনীয়তা, লাবণ্য ও দার্জ,
যা উৎকৃষ্ট গদ্যের তর্কাতীত লক্ষণ।

চল্লিশ বছর যাবৎ বীরবল চলিতরীতির চর্চা করেছিলেন এবং গদ্যকে দিয়েছিলেন জীবনীশক্তি। সাধু ও চলিত ভাষার তর্কে তাঁর জয়ের চিহ্ন বাংলা গদ্যের সর্বত্র বর্তমান। তাঁর রচনারীতির প্রবাদও বাংলা সাহিত্যে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বাংলা কথ্যরীতির উৎকর্ষ সাধনে বীরবলের প্রভাব স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও অস্বীকার করতে পারেননি। এ কারণে বীরবলের ভাষারীতির গ্রহণযোগ্য অস্বীকার করার উপায় নেই।