রবীন্দ্রনাথের মতাে কিংবা নজরুল ইসলামের মতাে মহৎ মানুষকে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল যে পত্রিকার দ্বারা সেটি হল শনিবারের চিঠি। তবে এই পত্রিকার পাতাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়।

এটি হল তৎকালীন সময়ের একটি শক্তিশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। পরে, এটি মাসিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হতে থাকে। শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক হিসেবে নীরদচন্দ্র চৌধুরির নাম থাকলেও এটির প্রকৃত পরিচালক ছিলেন সজনীকান্ত দাস এবং এর তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন মােহিতলাল মজুমদার।

সমালােচনা ও বিরােধিতা করাই ছিল শনিবারের চিঠি পত্রিকাটির প্রধান শক্তি। কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথের সমালােচনাও অনেক সময়ে এই পত্রিকার পাতাতে স্থান পেত। বলা ভালাে, সেগুলি সমালােচনার পরিবর্তে হয়ে উঠেছে কুৎসা। আর এই প্রবণতাকেই পুঁজি করে শনিবারের চিঠি পত্রিকাটি কালের যাত্রায় অনেকদিন ধরে টিকেছিল। এই পত্রিকাতে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরি, মােহিতলাল মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখােপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট সাহিত্যিক ব্যক্তি।

প্রথম যুগের বাংলা সাময়িকপত্র সংবাদকে ভিত্তি করে প্রকাশিত হলেও ক্রমে ক্রমে সাহিত্যধর্মী সাময়িকপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই পর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকপত্র হল ভারতী।

ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশের মাধ্যমরূপে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকা। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতী পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানস কন্যা এই পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব বিভিন্ন সময়ে যাঁরা অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেছেন, তারা হলেন স্বর্ণকুমারী দেবী, হিরন্ময়ী দেবী, সরলা দেবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমােহন মুখােপাধ্যায় প্রমুখ। এই পত্রিকা প্রকাশের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান এবং উৎসাহ ছিল রবীন্দ্রনাথের নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এই পত্রিকার গুরুত্বগুলি হল :

  • মাতৃভাষার গুরুত্বের আলােচনা, জ্ঞানচর্চা, ভাবস্ফৃর্তি- এগুলিই ছিল এই পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

  • পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যাতেই ছােটোগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, রসরচনা প্রভৃতি নানান ধরনের সাহিত্যকীর্তি প্রকাশিত হত।

  • গ্রন্থ সমালােচনা এবং সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও এই পত্রিকা একটি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য’-এর যে সমালােচনা রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন, তা ভারতী’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে বাংলা পত্র-পত্রিকাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সাময়িক পত্রিকা হল সাধনা।

১২৯৮ বঙ্গাব্দের (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ) অগ্রহায়ণ মাসে সাধনা পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। যদিও পত্রিকাটির সব্যসাচীর ভূমিকায় ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩২এ একটি চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন—“সাধনা আমার হাতে কুঠারের মতাে, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্যছেদন করবার জন্যে একে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না—একে আমি বরাবর আমার হাতে রেখে দেব।” এই পত্রিকার গুরুত্বগুলি হল :

  • সাধনা পত্রিকায় প্রকাশিত বিষয়বস্তুর পরিধি ছিল ব্যাপক। সাহিত্য, সংগীত, শিল্প, দর্শন, রাজনীতি সব ধরনের রচনাই সাধনা পত্রিকায় সমান গুরুত্বে স্থান করে নিত।

  • শাস্ত্রীয় আলােচনা থেকে সাময়িকপত্রকে মুক্তি দিয়ে তাকে বুদ্ধিনির্ভর পথে পরিচালনা করবার অন্যতম পথিকৃৎ ছিল এই পত্রিকা।

  • ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে হিন্দু সমাজের নানান মতপার্থক্য এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। চন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের প্রত্যুত্তর এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

  • রবীন্দ্রনাথের ‘যুরােপযাত্রীর ডায়ারি’, ‘খােকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ‘দালিয়া প্রভৃতি গল্প, শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কৃতজ্ঞতা উপন্যাস এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

কলকাতা ও ঢাকার বাইরে বাংলা সাহিত্যচর্চায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল যে পত্রিকাগুলি, তাদের মধ্যে প্রবাসী পত্রিকা অন্যতম।

কলকাতার সিটি কলেজের অধ্যাপক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এলাহাবাদে প্রবাসী জীবনযাপন করার সময় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেছিলেন একটি উচ্চাঙ্গের মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রবাসী। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে পত্রিকাটি কলকাতায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই পত্রিকার গুরুত্বগুলি হল :

  • বাংলাদেশের বাইরে প্রবাসী বাঙালিদের কথা মাথায় রেখে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ায় এতে সর্বভারতীয় আবেদন খুব সহজেই অনুভব করা যায়।

  • রাজনীতি, সমাজনীতি বা সংগীত থেকে শুরু করে চিত্রকলা, এমনকি ভাস্কর্য পর্যন্ত নানা বিষয়ের আলােচনা অত্যন্ত অনায়াসেই এই পত্রিকার পাতাতে জায়গা করে নিত।

  • কেবল আলােচনা নয়, দেশি-বিদেশি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের, যেমন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবি বর্মার চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের ছবি এই পত্রিকাতে মুদ্রিত হত।

  • প্রবাসী পত্রিকার লেখকগােষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ জ্ঞানতপস্বী ব্যক্তিত্ব। ফলে, তাদের রচনাসম্ভারে প্রবাসী হয়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক পত্রিকা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা উপন্যাস এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।