লোক সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হল প্রবাদ। ছড়ার সাথে প্রবাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। প্রবাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে “Proverb is a short sentence based on long experience” অর্থাৎ প্রবাদের মধ্যে দিয়ে একটি জাতির সামগ্রিক জীবন চর্যার পরিচয় পাওয়া যায়।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, সমাজে বসবাস কালে তারা যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ করে, তার মধ্যে দিয়ে যে তীব্র সম্পর্কের জানান দেয় তাই প্রবাদের আকারে ধরা পড়ে।
প্রবাদের অভিধানিক অর্থ পরস্পর কথোপকথন, পরস্পরাগত বাক্য, কিংবদন্তী, জনশ্রুতি। ইংরেজীর প্রতিশব্দ রূপে ‘প্রবাদ’ শব্দটি বহুদিন থেকে প্রচলিত আছে। বাংলা প্রবাদ বাক্যসংক্ষিপ্ত রচনা কিন্তু পূর্ণবাক্য। যার মধ্যে কর্তা কর্ম অসমাপিকা ক্রিয়া সবই বর্তমান।
প্রবাদ বাক্য কি বা কাকে বলে :-
প্রবাদ বাক্য কি এ সম্পর্কে পাশ্চাত্য মনীষী Bacon বলেছিলেন-
“The genius wit and spirit of a nation are discovered be their proverbs,”
W.C. Hazlitt প্রবাদ কি তার সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো :
“An expression or combination words conveying a truth to the mind by a figure, periphrases, antithesis or hyperbole”
আরও পড়ুন :- ধাঁধা কাকে বলে? প্রশ্ন উত্তর সহ?
“প্রকৃতপক্ষে সমাজ যাহা আচরণ করে এবং সামাজিক মানুষ প্রাত্যহিক জীবন আচরনের ভিতর দিয়া যে অভিজ্ঞতা লাভ করে তাহাদের মধ্যে যাহা নিজেদের অভিজ্ঞতার দিক দিয়া নিতান্ত তিক্ত, প্রধানত ; তাহা দ্বারাই প্রবাদ রচিত হইয়া থাকে। প্রবাদ মধুর বচন নহে, তাহা সংসার সংগ্রামে ক্ষত বিক্ষত মানুষের কঠোর অভিজ্ঞতার অভিব্যাক্তি মাত্র।”
প্রবাদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত এক ধরনের উক্তি পাওয়া যায় যাকে বচন বা প্রবচন বলে। যার অর্থ কথন, ভাষণ, অনুশাসন বা আদেশ এই প্রবচন প্রবাদের মতই পূর্ণ বাক্য।
প্রবাদের শ্রেনীবিভাগ :-
প্রবাদকে সাধারণত দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে –
১ – লোকিক প্রবাদ। এবং
প্রবাদের বৈশিষ্ট্য :-
১ – প্রবাদ সংক্ষিপ্ত আকারে হয়।
২ – গদ্য ও পদ্য উভয়ই প্রবাদের অবলম্বন।
৩ – প্রবাদ রস ও সাহিত্য গুন বৈশিষ্ট্য হয়।
৪ – প্রবাদ সামাজিক সম্পর্কে অন্বিত।
প্রবাদ বাক্য তালিকা :-
বাংলা প্রবাদ বাক্যের তালিকা ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে আশা করি ভালো লাগবে।
অতি সন্ন্যাসীতে গাজর নষ্ট — কোনও ব্যাপারে অনেক লোকের কর্তৃত্ব থাকলে কাজ পন্ড হয়।
অতি লোভে তাঁতী নষ্ট — বেশি লোভ করলে নিজেরই ক্ষতি হয়।
এক ঢিলে দুই পাখি মারা — এক সঙ্গে দুটো উদ্দেশ্য সাধন করা।
মরা হাতি লাখ টাকা — গুণী লোক অসুস্থ হয়ে পড়লেও সবার শ্রদ্ধেয়।
অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ — খারাপ উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজেকে ভালো বলে প্রচার করার চেষ্টা করা।
আপন বাঁচলে বাপের নাম — সব সময় নিজেকে বাঁচিয়ে চলা।
আপন আচরি ধর্ম অপরে শেখায় — অপরকে উপদেশ দেবার আগে নিজে পালন করা।
আরও পড়ুন :- লোককথা কাকে বলে? এর উদাহরণ?
সবুরে মেওয়া ফলে — ধৈর্য ধরে থাকলে ফল পাওয়া যায়।
ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া — প্রধান উদ্যোক্তাকে বাদ দিয়ে কাজ সিদ্ধি করার চেষ্টা।
চোরের মায়ের বড় গলা — কোনও অপরাধ করে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার চেষ্টা।
এক মাঘে শীত যায় না — একবার বিপদ কেটেছে বলে বার বার কাটবে এমন নয়।
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই — দুই অসাধু ব্যক্তির মধ্যে ঘনিষ্টতা থাকে।
ডুবে ডুবে জল খাওয়া — গোপনে কার্য সিদ্ধির চেষ্টা।
দশে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ — সবাই মিলে মিশে কাজ করলে ফল না পেলেও ক্ষতি নেই।
অতি দর্পে লঙ্কা হত্যা —বেশি গর্ব সর্বনাশের কারণ।
কাজের বেলায় কাজী কাজ ফুরালেই পাঞ্জি — স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তোষামোদ করা এবং স্বার্থ সিদ্ধি হয়ে গেলে আর কোনও সম্পর্ক না রাখা।
গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল — কিছু পাওয়ার আগেই ভোগের কল্পনা করা।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে — বিপদের সময় হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়া কিন্তু বিপদ কাটলে বুদ্ধি খোলে।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও খান ডানে — অবস্থার উন্নতি হলেও নিজের কাজ নিজেকেই যেখানে করতে হয়।
গেঁয়ো যোগী ভিক্ষা পায় না — অতি পরিচিত লোক গুণী হলেও উপযুক্ত মর্যাদা পায় না।
জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ — যার ওপরে নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই তাকে অসন্তুষ্ট করা।
ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আর্কাড়া — অন্যের দয়া করে দেওয়া জিনিসের দোষ গুণ বিচার না করা।
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় — কোন কাজে যিনি একবার ঠকেছেন, সেই কাজ আবার করতে ভয় পান।
সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে — যার যে বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে সেই সেটা ভাল বোঝে।
হাতে পাঁজি মঙ্গলবার — প্রত্যক্ষভাবে জানার উপায় থাকলে অনুমানের ওপর নির্ভর না করা।
লাভের গুড় পিঁপড়ের খায় — অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন অকাজে নষ্ট হয়।
ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় — অসৎ সংখ্যাই বেশি।
সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না — ভালো কথায় কাজ হয় না।
কানা গরু বামুনকে দান — অপ্রয়োজনীয় (অকেজো) জিনিস দান করে নাম কেনা।
রাম না জন্মাতেই রামায়ণ — কোনও কিছুর সূচনা হবার আগেই তাঁর প্রচার।
ধান ভানতে শিবের গীত — অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করা।
ধর্মের ঢাক আপনিই বাজে — যা সত্য তা একদিন প্রকাশ পাবেই।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকা — কোন খারাপ কাজকে গোপন করার জন্য অন্য কোনও ভালো কাজের ভাগ করা।
পেটে খেলে পিঠে সয় — লাভের সম্ভাবনা থাকলে কষ্ঠও সহ্য করা যায়।
ঢিল মারলেই পাটকেল খেতে হয় — অন্যের ক্ষতির চেষ্টা করলে নিজেরও ক্ষতি হয়।
দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো — খারাপ কিছু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
নেই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো — একেবারে কিছুই না পাওয়া অপেক্ষা সামান্য কিছু পাওয়াও ভালো।
পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে — অসুবিধাজনক পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলা।
নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা — নিজের দোষের জন্য অন্যকে দায়ী করা।
কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ — একই কাজে কেউ লাভবান হওয়া এবং কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া।
উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে — একের দোষ অন্যের ওপরে চাপানো।
চেনা বামুনের পৈতের দরকার হয় না — অতি পরিচিত লোকের অন্য কোনও পরিচয়ের দরকার হয় না।
খাচ্ছিল তাঁতী তাঁত বুনে কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে — যে যেই কাজের অনুপযুক্ত সে সেই কাজ করতে গেলে ফল বিপরীতই হয়।
দশ চক্রে ভগবান ভূত — চাপে পরে অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেওয়া বা সত্যকেও মিথ্যা করা।
বামুন গেল ঘর তো লাঙ্গল তুলে ধর — মালিকের অনুপস্থিতিতে কাজে ফাঁকি দেওয়া।
কনের ঘরের পিসী, বরের ঘরের মাসী — যে ভালো মানুষ সেজে একের বিরুদ্ধে অন্যকে প্ররোচনা দেয়।
Leave a comment