প্রবন্ধ রচনা

প্রবন্ধ রচনা

‘প্রবন্ধ’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে। প্রবন্ধ’ শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ হলাে ‘প্রকৃষ্ট রূপে বন্ধন’ । এই। বন্ধন ভাবের বন্ধন, ভাষার বন্ধন, চিন্তার বন্ধন। প্রকৃতপক্ষে, এই বন্ধন সুশৃঙ্খল, সুচিন্তিত ও সাহিত্যিক ভাবের বন্ধন । বিমূর্ত শৈল্পিক। ভাবকে ভাষায় মূর্ত করে, নাতিদীর্ঘ ও সুবিন্যস্ত মৌলিক গদ্য রচনাকে প্রবন্ধ বলে ।

অর্থাৎ কোনাে মননশীল ভাব, বিষয়, তথ্য বা তত্ত্ব উপযুক্ত ভাষার মাধ্যমে ধারাবাহিক বর্ণনায় উপস্থাপিত হয়ে শিল্পরূপ লাভ করলে তাকে প্রবন্ধ বলে। রচনা’ শব্দটির অর্থ নির্মাণ বা সৃষ্টি। রচনা সৃষ্টিশীল কর্ম। যেমন- কাব্য রচনা, উপন্যাস রচনা, প্রবন্ধ রচনা প্রভৃতি। সাধারণত যে লেখায় বিষয়ভিত্তিক নতুন কিছু পর্যায়ক্রমে পরিস্ফুট হয় তাকে রচনা বলে ।

রচনা সৃজনকালে সৃজনকারীকে সংযত, যৌক্তিক এবং সচেতন থাকতে হয়। এতে বিষয়ের উপস্থাপনা, চিন্তার ধারাবাহিকতা, সংযত বর্ণনা, ভাষার প্রাঞ্জলতা, সামঞ্জস্যতা ও যুক্তির সুশৃঙ্খল প্রয়ােগ থাকে। আর প্রবন্ধ রচনা হলাে চিন্তা, কল্পনা ও বুদ্ধির ত্রয়ী প্রয়াসে ভাব ও ভাষাকে উৎকৃষ্ট রূপে বন্ধন করা। প্রবন্ধ মননশীল, যুক্তিধর্মী, অনুভূতিপ্রধান, আবেগধর্মী, বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা অন্তরঙ্গ চিন্তাধৰ্মীসহ বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

এক্ষেত্রে রচয়িতার শিল্পশৈলীতে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। অন্যভাবে বলতে গেলে, যে ধরনের লেখায় তথ্যের প্রাধান্য থাকে যার ফলে অজ্ঞাত তথ্যাদি পাঠক জানতে পারে তা-ই প্রবন্ধ পদবাচ্য বলে গণ্য ।

তবে গদ্যসাহিত্যের অন্তর্গত হলেও তথ্যবহুল রচনা হলেই তাকে প্রবন্ধ সাহিত্যরূপে বিচেনা করা যাবে না, যদি-না লেখাটি সাহিত্য পদবাচ্য হয়। সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ বা গুণ হলাে সৃজনশীলতা। লেখকের সৃজনীশক্তির কোনাে পরিচয় যদি রচনায় পরিস্ফুটিত না হয় তেমন রচনাকে প্রবন্ধ সাহিত্য বলা যাবে না ।

অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সাহিত্যের চিরন্তন উদ্দেশ্য হলাে সৌন্দর্য সৃষ্টি ও আনন্দদান; প্রবন্ধেরও সেই একই উদ্দেশ্য। তাই বলা যায়, কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে আশ্রয় করে লেখক কোনাে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যে আত্মসচেতন নাতিদীর্ঘ সাহিত্য রূপ সৃষ্টি করেন। তাকেই প্রবন্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। প্রবন্ধের দুটি প্রধান শ্রেণিবিভাগ বিদ্যমান । তন্ময় প্রবন্ধ আর মন্ময় প্রবন্ধ ।

বিষয়বস্তুর প্রাধান্য স্বীকার করে যে সকল বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ লিখিত হয় সেগুলােকে তন্ময় প্রবন্ধ বলে । এ জাতীয় রচনায় লেখকের পাণ্ডিত্য, বুদ্ধি ও জ্ঞানের পরিচয়ই মুখ্য হয়ে দেখা দেয় । অপরদিকে, যে শ্রেণির রচনায় লেখকের মেধাশক্তি অপেক্ষা ব্যক্তি হৃদয়ই প্রধান হয়ে ওঠে তাকে মন্ময় প্রবন্ধ বলে। এ জাতীয় রচনায় লেখকের ভাবাবেগই বেশি প্রাধান্য পায়।

বাংলায় মন্ময় প্রবন্ধকে চারুকথনও বলা হয়ে থাকে । অবশ্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে রচনা ও প্রবন্ধ একই অর্থ বহন করে। প্রবন্ধ’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Essay’। কথাটির আরেকটি অর্থ হলাে চেষ্টা করা বা উদ্যোগ গ্রহণ করা। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে সেই অর্থ একটু বিশিষ্টতর অর্থাৎ, কোনাে ভাব বা বিষয় সম্বন্ধে নিজের বক্তব্য লিখে প্রকাশের চেষ্টা করা। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কেবল একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে মনের ভাব বা বক্তব্য প্রকাশ করে ।

সেদিক থেকে বিচার করে ইংরেজি Composition বলতে যা বুঝায় তা রচনার ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হতে পারে । Composition অর্থ ‘লেখা’ বা ‘লিখন । অর্থাৎ রচনা বা প্রবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী কোনাে বিষয় সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ব্যক্ত করতে পারে। এতে তার বক্তব্য গুছিয়ে উপস্থাপন করার দক্ষতা জন্মে, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি, ভাষা ব্যবহারের সুদক্ষতাসহ যথার্থ শব্দ প্রয়ােগ, উপমা, অলংকার ইত্যাদি ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা সচেতন হয়ে ওঠে।

প্রবন্ধ রচনায় ভাব ও ভাষা দুটিই সমান প্রয়ােজনীয়। ভাব দ্বারা শিক্ষার্থীর রচনার মৌলিকত্বের প্রমাণ হয় এবং ভাষা দ্বারা তার ভাষাজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। সুতরাং ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষাজ্ঞান ও মৌলিক চিন্তাধারার বিকাশের পরীক্ষাই যে রচনা লিখনের একমাত্র উদ্দেশ্য একথা তাদের ভুললে চলবে না।

একসময় শিক্ষার্থীগণ বিশেষ ধরনের কয়েকটি রচনা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাশ করার চেষ্টা করত। কিন্তু ইদানীং সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে যে সমস্ত বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা লিখতে দেওয়া হয়, এগুলাে প্রায়ই মুখস্থের আওতায় পড়ে না। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের রচনা মুখস্থ করবার চেষ্টা না করে স্বকীয়ভাবে লিখবার চর্চা ও চেষ্টা করা উচিত। তাহলে তারা ভাষা প্রয়ােগের সম্পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে পারবে । ‘

প্রবন্ধের অঙ্গ বিভাজন

প্রবন্ধের কাঠামাে প্রধান তিনটি অংশে বিভক্ত।

১.  ভূমিকা 

২.  মূল অংশ

৩. উপসংহার 

    ভূমিকা ; প্রবন্ধ বা রচনার প্রারম্ভিক অংশ হলাে ভূমিকা। এটি রচনার প্রবেশদ্বার। একে সূচনা, উপক্রমণিকা, প্রস্তাবনা, আরম্ভ উপস্থাপন মুখবন্ধ সত্রপাত বা প্রাক-কথনও বলা চলে। এতে যে বিষয় সম্বন্ধে রচনা লেখা হবে তার আভাস এবং সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদানের চেষ্টা করা হয়। ভূমিকা হৃদয়গ্রাহী হলে পাঠক পুরাে প্রবন্ধ পাঠে আকর্ষিত হয় । তবে ভূমিকা সংক্ষিপ্ত হওয়াবাঞ্ছনীয়।

    মূল অংশ : ভূমিকার পরে প্রবন্ধের মূল বিষয়ের আলােচনা আরম্ভ হয়। বিষয়বস্তু বা মূল বক্তব্য রচনার প্রধান অংশ । মূল বক্তব্য পরিবেশনের পূর্বে বিষয়টিকে প্রয়ােজনীয় অনুচ্ছেদে ভাগ করে নিতে হয়। এতে বিষয় সম্বন্ধে বক্তব্যের পারম্পর্য ঠিক থাকে। অনুচ্ছেদগুলাের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংগতিপূর্ণ উদাহরণ, উপমা, উদ্ধৃতি মূল অংশে প্রয়ােগ করা যায়। এভাবে আলােচনার বিস্তার ঘটিয়ে মূলভাবটি সিদ্ধান্তমূলক সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিতে হয় ।

    উপসংহার : সিদ্ধান্তমূলক সমাপ্তির অংশ প্রবন্ধের উপসংহার । একে পরিশেষ, পরিণাম, নিষ্পত্তি, নির্বাহ, অবসান বা সারসংক্ষেপও বলা চলে। প্রবন্ধের ভাববস্তু ভূমিকার উৎসদ্বার থেকে ক্রমবিকাশের ধারা বহন করে উপসংহারে এসে একটি ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে সমাপ্তির ছেদ রেখা টানে। উপসংহারে লেখকের নিজস্ব অভিমতের অথবা আশা-আকাক্ষার সার্থক প্রতিফলন ঘটে ।

    প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ 

    বিচিত্র বিষয় অনুসারে প্রবন্ধ বা রচনাকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায় ।

    ১. বর্ণনামূলক প্রবন্ধ
    ২. ঘটনামূলক প্রবন্ধ
    ৩. চিন্তামূলক প্রবন্ধ

      বর্ণনামূলক প্রবন্ধ : বর্ণনামূলক প্রবন্ধ সাধারণত স্থান, কাল, বস্তু, ব্যক্তিগত স্মৃতি, অনুভূতি ইত্যাদি বিষয়ে বিরচিত হয়ে থাকে । বর্ণনার সাহায্যে কোনাে বস্তু বা দৃশ্যকে স্থূলভাবে ফুটিয়ে না তুলে বরং বিশেষ ঘটনা, ধারণা এমনকি ভাবাবেগকেও দৃষ্টিগ্রাহ্য। করে বক্তব্যকে হৃদয়গ্রাহী করে তােলার জন্য ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে কাজে লাগানাে হয়। ধান, পাট, শরৎকাল, কাগজ, টেলিভিশন,
      বনভােজন, শৈশবস্মৃতি ইত্যাদি রচনা এই শ্রেণির পর্যায়ভুক্ত।

      ঘটনামূলক প্রবন্ধ : সাধারণত দিবস, ঘটনা, উৎসব, জীবনকাহিনি প্রভৃতি বিষয়ে ঘটনামূলক প্রবন্ধ রচিত হয়। যেমন বিজয়দিবস, মুক্তিযুদ্ধ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নববর্ষ ইত্যাদি।

      চিন্তামূলক প্রবন্ধ : চিন্তামূলক প্রবন্ধ রচিত হয় চিন্তা ও অভিমতের ভিত্তিতে । তত্ত্ব, তথ্য, ধ্যানধারণা, চেতনা প্রভৃতি এর আওতাভুক্ত । চিন্তাশীল বা মননশীল প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের ভূমিকাই প্রধান। শিষ্টাচার, সত্যবাদিতা, সময়ের মূল্য, শ্রমের মর্যাদা, চরিত্র, অধ্যবসায়, পরিবেশ দূষণ, বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও তার প্রতিকার প্রভৃতি চিন্তামূলক প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত।

      প্রবন্ধ রচনায় দক্ষতা অর্জনের উপায় প্রবন্ধ লেখার নৈপুণ্য বা দক্ষতা অর্জনের উত্তম উপায় হলাে নিয়মিত অনুশীলন ।

      প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিধিগুলাে মেনে চলা উচিত : 

      ১. প্রবন্ধ রচনা যথাসম্ভব প্রাঞ্জল এবং আকর্ষণীয় হওয়া বাঞ্ছনীয় । অর্থাৎ প্রবন্ধের ভাষা সহজ-সরল ও বক্তব্য সুস্পষ্ট হওয়া উচিত।

      ২. প্রবন্ধ লেখার সময় নিজের স্বকীয়তা যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে মনােযােগী হতে হবে । 

      ৩. প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক । তাই প্রবন্ধের মর্মবস্তু, যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব, বিচার-বিশ্লেষণ প্রভৃতি বিষয়ানুগ, প্রাসঙ্গিক, সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে ।

      ৪. এক একটি সূত্র বিস্তৃত করে এক একটি অনুচ্ছেদে লিখতে হবে। তবে একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে ।

      ৫. ভাষারীতিতে যেন সাধু ও চলিত একত্রে মিশে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে । 

      ৬. প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্তসহ প্রবন্ধের বক্তব্যকে আরও জোরালাে ও আবেদনশীল করতে প্রবাদ-প্রবচন, উদ্ধৃতি ইত্যাদির সন্নিবেশ  ঘটাতে হবে ।

      ৭. নিজস্ব অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, চিন্তাশক্তি, পঠন-পাঠন, ভাষাগত দক্ষতা ও উপস্থাপন কৌশল প্রভৃতি প্রয়ােগ করে প্রবন্ধকে যথাসম্ভ পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে হবে । 

      ৮. নির্ভুল বানান ও অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরিতে সচেতনতাসহ রচনা যেন অতিশয় দীর্ঘ বা অতি সংক্ষিপ্ত না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে ।