ভূমিকা: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [১৮৩৮-৯৪] বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের একজন ধ্রুপদী শিল্পী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ হতে বাঙালি লেখকের মধ্যে বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। অভিব্যক্তি তখন শাস্ত্রীয় নজির পরিত্যাগ করে প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হতে লাগল। এই সময়ে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে যে-কজন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কে অসীম প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম এবং সেই সময়ই প্রবন্ধ সুনির্দিষ্ট আয়তন লাভ করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই সর্বপ্রথম বাংলা প্রবন্ধের কলা-সৌষ্ঠব ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এক অনমনীয় দৃঢ়তা ও সুসংবদ্ধ সাহিত্যিক সরসতা দান করে একে প্রথম শ্রেণির শিল্পকলার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর সবগুলো প্রবন্ধের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা, চিন্তাশীলতা ও মননশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রথম শ্রেণির প্রবন্ধগুলোতে তাঁর সাহিত্য জ্ঞান ও মনীষার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধমে সাহিত্য কর্মগুলো সরস, স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত হয়েছে যেমন তেমনি নিজস্ব চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তার কারণ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর পরিণত মন ও বয়সের সৃষ্টি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই সর্বপ্রথম বাংলা প্রবন্ধের কলা-সৌষ্ঠব ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এক অনমনীয় দৃঢ়তা ও সুসংবদ্ধ সাহিত্যিক সরসতা দান করে একে প্রথম শ্রেণির শিল্পকলার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর সবগুলো প্রবন্ধের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা, চিন্তাশীলতা ও মননশীলতায় পরিপূর্ণ। প্রথম শ্রেণির প্রবন্ধগুলোতে তাঁর সাহিত্য জ্ঞান ও মনীষার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধমে সাহিত্য কর্মগুলো সরস, স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত হয়েছে যেমন তেমনি নিজস্ব চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তার কারণ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর পরিণত মন ও বয়সের সৃষ্টি। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক ছিলেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সংস্কৃতিক জীবনের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক বিশিষ্ট জীবনাদর্শন স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ও বাঙালি চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন সমাজ, ধর্ম, মনন, দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস সব কিছুকে নিজের কক্ষপথে টেনে এনেছিলেন প্রবন্ধসাহিত্যের মাধ্যমে। প্রামাণ্য তথ্য সমাবেশ ও নিস্পৃহ যুক্তির সুতীক্ষ্ণতায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সর্ববিধ প্রবন্ধই সমুজ্জ্বল হয়েছে। তাঁর সকল প্রবন্ধই বিষয় ও পরিবেশগুণে সুস্পষ্ট ও মননদীপ্ত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহ:

  1. লোকরহস্য (১৮৭৪)
  2.  কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫)
  3. মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত (১৮৮৪)
  4. বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫)
  5.  বিচিত্র প্রবন্ধ (১৮৮৭)
  6.  সাম্য (১৮৭৯)
  7. কৃষ্ণচরিত (১৮৮৬)
  8.  ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৮)

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর প্রবন্ধসাহিত্যকে বিষয়ের দিক থেকে বিচার করলে ঐতিহাসিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, সাহিত্যগতি-প্রকৃতি-তত্ত্ব ও ভাষা বিষয়ক আলোচনা-সমালোচনা, ধর্মচিন্তা প্রভৃতি বিষয়ে বিভক্ত করা যায়। তাঁর সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে আলাদা কোন সংকলন নেই। তবে বিবিধ প্রবন্ধের প্রথমভাগে এ জাতীয় প্রবন্ধগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে।

বঙ্কিমের সাহিত্য চিন্তার স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ গ্রন্থের সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধে। তাঁর সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো হলো ‘উত্তরচরিত্র’, ‘গীতিকাব্য’, ‘অনুকরণ,’ ‘শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা’, ‘ধর্ম ও সাহিত্য’ ‘চিত্তশুদ্ধি’ ‘বাঙ্গালা ভাষা’ এবং ‘বাংলার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’। এসব প্রবন্ধ আলোচনা করলেই বঙ্কিমের সাহিত্য ভাবনার স্বরূপ আলোচনা করা সহজ হবে। ‘উত্তরচরিত্র’ বঙ্কিমচন্দ্রের সংস্কৃত সাহিত্যের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনুসরণে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। রামায়ণে সীতার ট্র্যাজিক পরিণতি দেখা যায়। ভবভূতি রামায়ণ কাহিনিকে নতুন রূপ দিয়ে সীতা-রামের মিলন ঘটিয়েছেন সংস্কৃত নাটক উত্তরচরিত বা রাম চরিত্রে। বঙ্কিমচন্দ্র ভবভূতির এ মিলনাত্মক নাটক নিয়ে পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ‘উত্তরচরিত্র’ প্রবন্ধে। এ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে, কিন্তু নীতিজ্ঞানের যা উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সে উদ্দেশ্য।” সাহিত্য সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্রের এ উক্তির মাঝে প্রাচীন সাহিত্যতাত্ত্বিক হোরেসের কথার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। হোরেস এবং বঙ্কিম উভয়েই ছিলেন উপযোগিতাবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক।

‘গীতিকাব্য’ প্রবন্ধে বঙ্কিম গীতিকাব্যের লক্ষণ, স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। সংক্ষিপ্ত হলেও এ প্রবন্ধের মধ্যে স্কিমচন্দ্রের সূক্ষ্ম চিন্তা ও গভীর মনন ধর্মের পরিচয় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে তাঁর সাহিত্য চিন্তার মৌলিকতা কোনক্রমেই অস্বীকার করা যায় না। তিনি তাঁর সাহিত্যচিন্তা প্রকাশ করতে গিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের তুলনা করেছেন। গীতিকাব্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি এ প্রবন্ধে বলেছেন:

“অতএব গীতের যে উদ্দেশ্য যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটনমাত্র তাহার উদ্দেশ্য, সে কাব্যই গীতিকাব্য।”

‘শকুন্তলা মিরন্দা ও দেসদিমোনা’ বঙ্কিমের একটি উল্লেখযোগ্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকের নায়িকার সাথে শ্রেক্সপীয়ারের দুটি নাটকের দুই নায়িকার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তিনি তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলো খুঁজে বের করেছেন। তিনটি নাটকের তিনটি নায়িকা চরিত্রের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য এক অপূর্ব ভঙ্গিতে এ প্রবন্ধে পর্যালোচিত হয়েছে। এ প্রবন্ধের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “শকুন্তলা অর্ধেক মিরন্দা, অর্ধেক দেসদিমোনা। পরিনীতা শকুন্তলা দেসদিমোনার অনুরুপিনী, অপরিনীতা শকুন্তলা মিরন্দার অনুরূপিনী।”

‘ধর্ম ও সাহিত্য’ বঙ্কিমের অন্যতম সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধ। তাঁর চিন্তার মূলকথা ছিল শিল্প। তিনি শিল্পকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। ধর্ম সম্পর্কে বঙ্কিমের বিশেষ চিন্তা কাজ করেছে। ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে তিনি বলেছেন,” সাহিত্য ধর্ম ছাড়া নহে। কেননা সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য তাহা ধর্ম। যদি এমন কোনো সাহিত্য থাকে যে, তাহা অসত্যমূলক ও অধর্মময়, তবে তাহা পাঠে দুরাত্মা বা বিগত রুচি পাঠক ভিন্ন উপকৃত হয় না।” তিনি এখানে সাহিত্যের চেয়ে ধর্মকে বড়ো করে দেখেছেন। তিনি সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, সাহিত্যের মধ্য দিয়েই সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে হবে তবে ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়।

‘চিত্তশুদ্ধি’ প্রবন্ধে বঙ্কিম ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। তার সাহিত্যতত্ত্বের বিশেষ আদর্শ হলো চিত্তশুদ্ধি। তিনি মনে করেন, সাহিত্যের মাঝে সর্ব মানবিক উপাদান এবং ধর্মের পার্থক্য থাকে। তিনি প্রথম জীবনে নাস্তিক থাকলেও শেষ জীবনে প্রবল ধর্মীয় পদ্ধতিতে আস্তিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, হিন্দু ধর্মের সার হচ্ছে চিত্তশুদ্ধি। তিনি আবার বলেছেন চিত্তশুদ্ধ ধর্মের সার। যার মাঝে চিত্তশুদ্ধি আছে, সে হলো যে কোনো ধর্মের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। যার চিত্তশুদ্ধি নেই সে ধার্মিক নয়। সুতরাং চিত্তশুদ্ধিই ধর্ম। তিনি মনে করেন, চিত্তশুদ্ধি হলো সংযম। সংযম মানে লালসা, বাসনা প্রভৃতি ইন্দ্রিয় কামনা থেকে বিরত থেকে ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি যথাযথভাবে পূরণ করেন।

‘বাঙ্গালা ভাষা’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, রচনার প্রথম ও প্রধান গুণ হলো সরলতা ও প্রাঞ্জলতা। এজন্য তিনি লেখার মধ্যে যে কোনো ভাষার শব্দ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন- “বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে, যতটুকু বলিবার কথা সবটুকু বলিবে-তজ্জন্য ইংরেজি, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য বন্য যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।”

‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধেও বঙ্কিমের উপযোগিতাবাদী সাহিত্যচিন্তা প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রবন্ধে তিনি নব্য লেখকদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

১. যশের জন্য লিখিবেন না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনা আপনি আসিবে।
২. টাকার জন্য লিখিবেন না।
৩. লোকরঞ্জনের জন্য সাহিত্য লিখা উচিত নহে।
৪. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্য জাতির কিছু মঙ্গল করিতে পারিবেন। সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারিবেন তবে অবশ্যই লিখিবেন।
৫. সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। কাজেই রচনার সময়ে ধর্ম বিরুদ্ধ না করাই উত্তম।
৬. সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার হইল সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারিবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।

‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’ প্রবন্ধটিতে বঙ্কিমের অভিনব সমালোচনা শক্তির স্বাক্ষর বর্তমান। তিনি একদিকে যেমন বাঙালি কবি স্বভাবের সার্থক স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন তেমনি কবি বিদ্যাপতি জয়দেবসহ বাংলা গীতিকাব্যের রসাস্বাদন জাত প্রতিক্রিয়ার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্কিমের সমাজ সচেতন মনের পরিচয়ও ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’ প্রবন্ধটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত। বিদ্যাপতি ও জয়দেব এ দুই কবির স্বভাবের তুলনামূলক আলোচনা বঙ্কিমচন্দ্র অতি নিপুণভাবে পরিবেশন করেছেন, সেখানে তার সাহিত্যতত্ত্বের চেয়ে সাহিত্য সমালোচনা বড়ো হয়ে উঠেছে।

‘উত্তরচরিত’ সংস্কৃত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন। রামচরিত উত্তরচরিত্র রূপে উপস্থাপন করেন সংস্কৃত নাটকের লেখক ভবভূতি তাঁর ‘উত্তর চরিতে’। রামায়ণে সীতার ট্র্যাজিক পরিণতি ঘটে, পরিণামে সে পাতালে চলে যায়। ভবভূতি একে মিলনাত্মক রূপ দেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভবভূতির এই গ্রন্থটিকে তাঁর উত্তরচরিত প্রবন্ধে আদ্য প্রান্ত বিশ্লেষণ করে সাহিত্যতত্ত্বমূলক কিছু তত্ত্ব কথা প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি বলতে চেয়েছেন কাব্য মানুষের চিত্তরঞ্জন ও চিত্তশুদ্ধি ঘটাবে। সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য শিল্প সৃষ্টি হলেও এর উপযোগিতা থাকতে হবে। কবিরা জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা। সৌন্দর্য সৃষ্টি কবির প্রধান উদ্দেশ্য হলেও এর মাধ্যমে উন্নতভাবনার পথে নিয়ে যাবেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ভাষায়-

“কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য। কাব্যের গৌণ উদ্দেশ্য মনুষ্যের চিত্তোৎকর্ষ সাধন-চিত্তশুদ্ধিজনন। কবিরা জগতের মহান শিক্ষাদাতা- কিন্তু নীতি ব্যাখ্যার দ্বারা তাঁহারা শিক্ষা দেন না।… তাঁহারা সৌন্দর্যের চরমোৎকর্ষ সৃজনের দ্বারা জগতের চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। এই সৌন্দর্য্যের চরমোৎকর্ষের সৃষ্টি কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য।”

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোন অলৌকিক বিশ্বাসহীন সুন্দর কাহিনি বা রচনাকে সুন্দর বা সার্থক সাহিত্য কর্ম বলে মনে করতেন না। সার্থক সাহিত্য কর্ম তাই যা সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠকের চিত্তশুদ্ধি সাধন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্ম ও দর্শনচিন্তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৯২) এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮) গ্রন্থে। প্রথম জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র পাশ্চাত্য দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বিশেষভাবে দার্শনিক জেরেমি বেস্থাম ও অগাস্ট কোঁতের মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। পরিণত বয়সে তিনি যখন হিন্দু দর্শন সম্পর্কে গভীর অনুশীলনে প্রবৃত্ত হন তখনো অনেক পরিমাণে বেস্থাম ও কোঁতের প্রভাবেই তাঁর চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মানুষের সর্ববিধ গুণের সামঞ্জস্যপূর্ণ মনুষ্যত্বের উপলব্ধিই ধর্মসাধনার লক্ষ্য-বঙ্কিমচন্দ্র এরকম বিশ্বাস পোষণ করতেন।

বঙ্কিমচন্দ্র ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে কৃষ্ণকে পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রতীক চরিত্ররূপে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে স্বাধীন যুক্তির দ্বারা তিনি কৃষ্ণচরিত্রের অলৌকিক অংশ পরিবর্জন করে চরিত্রটিকে আপন আদর্শের প্রতিভূরূপে মহত্তর মানুষরূপে চিহ্নিত করেছেন। ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের প্রতিপাদ্য-মানুষের শক্তি বা বৃত্তিগুলোর অনুশীলন, ফুরণ ও
চরিতার্থতায় মনুষ্যত্বলাভ সম্ভব হয়। এই মনুষ্যত্বই মানুষের ধর্ম।

সমালোচনামূলক প্রবন্ধসমূহ: বঙ্কিমচন্দ্র ‘রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন চরিত্র ও কবিত্ব’, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্র’, ‘সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনী’ নামক প্রবন্ধও তিনি রচনা করেছেন। তাঁর এজাতীয় প্রবন্ধগুলোর প্রতিটিই চিন্তার মৌলিকতা, রসবোধের সুগভীরতা এবং প্রকাশভঙ্গির সারল্য ও সরসতায় সমুদ্দীপ্ত হয়েছে।

উপসংহার: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাংলা সাহিত্যে ‘সাহিত্যসম্রাট’ বলা হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সমালোচক ও সাহিত্যতাত্ত্বিক। তার আগে সাহিত্য সমালোচনা হলেও, আমরা তাঁর মাঝেই যথার্থ সমালোচনার চিন্ত াচেতনা, তাত্ত্বিকতা ইত্যাদি দেখতে পায়। তিনি এমন একজন লেখক যার প্রধান অভিপ্রায় হলো-শিল্পসৃষ্টি এবং মানবকল্যাণ। তাঁর এ চিন্তার সূত্র ধরেই তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে বিচিত্র বিষয়সম্ভার। বাংলা গদ্যভাষা প্রথম সৃজনশীল প্রতিভার স্পর্শ লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই। তাঁর হাতে বাংলা গদ্যসাহিত্য যে ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ পূর্ণতা লাভ করে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থভাবেই নির্দেশ করেছেন, ‘ইহার স্থূল প্রয়োজনাত্মক উচ্চারণ শ্লথতার মধ্যে শ্লেষ ব্যঙ্গ তির্যক ভাষণের তীক্ষ্ণতা, পরিহাস রসিকতার চমক, আবেগময় ভাবমুগ্ধতা, গীতিকবিতার সুর উচ্ছাস, জীবনপর্যালোচনার অন্তরঙ্গ অন্তর্মুখিতা, ক্ষোভ অনুযোগ আশা নৈরাশ্যের সম্মিলিত ঐকতান মানবকণ্ঠের সমগ্র সুর গ্রাম, অনুভূতির সর্বসঞ্চারী ভাবসমষ্টি আপনাদের যথাযথ বাক ছন্দটি খুঁজিয়া পাইয়াছে।”

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।