এখানে আলোচনায় গল্প, উপন্যাস, নাটকের সাহিত্যিক সমৃদ্ধি বা রীতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা উহা রেখে, বাংলা সাহিত্যের যে আর একটা দিক রয়েছে—প্রবন্ধ ও নিবন্ধের দিক, তার বিভিন্ন রূপ পরিচয়ের দিক তাই আমাদের আলোচ্য। কিন্তু আলোচনার আরম্ভে একটা কথা প্রথমেই বলে নেওয়া যেতে পারে। কাব্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতির ক্ষেত্রে একটা লাক্ষণিক পরিচয় মোটামুটি আমরা ঠিক করে নিয়েছি। কিন্তু প্রবন্ধ বা রচনাসাহিত্য বলতে সাহিত্যের ‘চণ্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাই কিছুই বাদ পড়ে না। আচার্য শশিভূষণ দাশগুপ্তের কথায়, ‘গুরুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্বালোচনা, দুর্দান্ত ঐতিহাসিক গবেষণা, রাজনৈতিক মসীযুদ্ধ আর সমাজনৈতিক ঘোঁট, সাহিত্যিক বিতর্ক এবং সমালোচনা, যার গদ্যছন্দে লেখকের আত্মপ্রকাশ, ইহাদের সকলকেই আমরা রচনা-সাহিত্যের শ্রীক্ষেত্রে একেবারে এক করে দিয়েছি মোটের উপরে গল্প, উপন্যাস এবং নাটক ব্যতীত গদ্যরীতিতে আর যাহা কিছু লিখিত হয়, তাহাই ‘রচনা-সাহিত্য’ নামে অভিহিত।’ সংস্কৃতের মতোই বাংলায় ‘রচনা’ শব্দটি বহুল অর্থেই ব্যবহৃত হয়। শয্যা-রচনা থেকে মাল্য-রচনা এবং কবিতা-উপন্যাস-নাটক ও প্রবন্ধ রচনা সবক্ষেত্রেই ‘রচনা’ কথাটি প্রযুক্ত হয়। কিন্তু শব্দটির একটি যোগারূঢ় অর্থ রয়েছে। পরিপার্টিরূপে সাজিয়ে গুছিয়ে ভাষা, ভাব ও পরিচ্ছন্ন চিন্তার সহযোগে যে-সব গদ্য লেখা হয় তাকেই আমরা রচনা বলি। ইংরেজি essay শব্দের প্রতিশব্দরূপে শিক্ষার্থী মহলে ও পাঠ্যপুস্তকে এই শব্দেরই প্রয়োগ বেশি। আর অর্থে প্রবন্ধ ও রচনা প্রায় সমার্থক। আবার একটু পার্থক্যও আছে। ‘রচনা’ শব্দটির মধ্যে একটা সৃষ্টি বা নব-নির্মাণের কথাও অনুস্যুত হয়ে আছে। এই সৃষ্টি, নব-নির্মাণ বা নির্মিতি নিয়ে যে বিশেষত্বমণ্ডিত গদ্য তা সাহিত্যের অঙ্গীভূত এবং এই গুণ রচনার মধ্যে সংক্রমিত হলে তা আর তখন নিছক ‘রচনা’ থাকে না, হয়ে ওঠে রচনা-সাহিত্য। সঠিকভাবে প্রথমটির অর্থ যদি হয় তত্ত্বনিষ্ঠ রচনা, তাহলে দ্বিতীয়টি ভাবনিষ্ঠ রচনা-সাহিত্য। মোটাদাগে এই তত্ত্বনিষ্ঠ রচনাসমূহকেই বলা হয় প্রবন্ধ।
‘প্রবন্ধ’ শব্দটির পাশাপাশি ‘নিবন্ধ’, ‘সন্দর্ভ’ প্রভৃতি শব্দ সংস্কৃত সাহিত্যে ও প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রন্থের বৃত্তি বা টীকা অর্থে ‘নিবন্ধে’র ব্যবহার সংস্কৃত সাহিত্যে ছিল। এ ভিন্ন সাধারণত ‘নিবন্ধ’ শব্দটি সংস্কৃত অলঙ্কার গ্রন্থে বন্ধন মুক্ত রচনা অর্থেও গ্রহণ করা হয় এবং এই সাধারণ অর্থে ‘প্রবন্ধ’ ও ‘নিবন্ধ’ শব্দ দুটি অনেক স্থলেই সমার্থক রূপে ব্যবহৃত। বাংলা সাহিত্যে ‘নিবন্ধ’ শব্দটিকে সাধারণত দীর্ঘ প্রবন্ধ বা দীর্ঘ প্রস্তাব অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ‘সন্দর্ভ’ কথাটির অর্থ হল সম্যকরূপে গ্রন্থন, রচনা বা সংগ্রহ। শব্দের সঙ্গে শব্দের, অর্থের সঙ্গে অর্থের ও শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্যক প্রকারে অন্বিত হওয়াকেই সন্দৰ্ভ বলা যায়। আর এই অর্থে ‘সন্দর্ভ’ শব্দ ‘প্রবন্ধ’ ও ‘নিবন্ধে’র ন্যায় পরস্পরের গুঢ়ান্বয়ই ‘সন্দর্ভে’রও বৈশিষ্ট্য। সংগ্রহ অর্থে ‘সন্দর্ভ’ কথাটির ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে বর্তমানেও প্রচলিত। যেমন, ‘রচনা-সন্দৰ্ভ’, ‘সাহিত্য-সন্দর্ভ’ ইত্যাদি। রচনা বিশেষের গূঢ় অর্থ-প্রকাশক রূপেও ‘সন্দর্ভ’ কথাটির প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে দেখা গেছে। উনিশ শতকের গদ্য-সাহিত্যে এই শব্দগুলি বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই শতকের প্রথম দিকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ নবযুগের মনীষীবৃন্দ সাহিত্যিক গদ্যে তাদের ব্যাখ্যানমূলক, বিতর্কমূলক এবং বর্ণনামূলক রচনার ক্ষেত্রে ‘প্রস্তাব’ শব্দটির বহুল প্রয়োগ করেছেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কিন্তু এই জাতীয় গদ্য রচনাকে ‘প্রবন্ধ’ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়েছে।
বস্তুগত, তথ্যপ্রধান ও তত্ত্বকেন্দ্রিক গদ্য রচনাকে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ যে নামেই বিশেষিত করা হোক, মূলত মনন প্রধান যুক্তি-নিষ্ঠ এই গদ্য রচনাকেই সাধারণভাবে প্রবন্ধ নামে চিহ্নিত করা হয়। আচার্য অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “নিবন্ধমূলক গদ্য রচনাকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। একটি তত্ত্বাশ্রয়ী প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ। অর্থাৎ যে গদ্যরচনায় যুক্তির বিশেষ বন্ধন আছে তার মধ্যে তত্ত্ব ও তথ্য নিজগুণেই প্রাধান্য লাভ করে। আর একটি হল রসাশ্রয়ী গদ্য রচনা, যা নিবন্ধ হলেও প্রবন্ধ নয়। এই জাতীয় গদ্য রচনায় লেখকের ব্যক্তিসত্ত্বার প্রাধান্য। এখানে তিনি রসস্রষ্টা, রূপদক্ষ এবং কল্পনাপ্রবণ। বাংলায় আমরা তত্ত্বাশ্রয়ী গদ্য-রচনাকে বলতে পারি প্রবন্ধ সাহিত্য এবং রসাশ্রয়ী গদ্য রচনাকে বলা যাবে রচনাসাহিত্য, অর্থাৎ ব্যক্তিগত নিবন্ধ।’ ইংরাজিতেও রচনার দুটি রূপ স্বীকৃত হয়েছে, প্রথমটি formal objective, impersonal essay. একে treatise, discourse-ও বলা যেতে পারে। আর দ্বিতীয়টি informal subjective, personal essay. আচার্য শশিভূষণ দাশগুপ্ত অনুসরণে প্রথমটি যদি হয় রচনা তাহলে দ্বিতীয়টি রচনা-সাহিত্য। আচার্য অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় এই রচনা-সাহিত্যকেও ‘নিবন্ধ’ রূপে পরিচিহ্নিত করতে চেয়েছেন। আচার্য দাশগুপ্ত অনুসরণে আমরা এই ব্যক্তিগত রচনাকে নিবন্ধ-সাহিত্যও বলতে পারি। তাহলে ‘নিবন্ধ’ কথাটিকে একবার প্রবন্ধের কোটাভুক্ত আর একবার রসাশ্রয়ী রচনাসাহিত্যের কোটাভুক্ত করার বিভ্রাস্তিতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না।
এখন এই প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সন্দর্ভ, যাকে সাধারণভাবে বাংলায় ‘প্রবন্ধ’ নামেই চিহ্নিত করা হয়, সেই প্রবন্ধ নিয়েই প্রথম আলোচনা করা যাক।
Leave a comment