প্রবন্ধকার আবুল ফজলের পরিচয়
প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞান মনস্ক বিয়ষচেতনা বাংলাদেশের প্রবন্ধ ধারায় আবুল ফজলকে [১৯০৩-৮৩] বিশিষ্ট চিহ্নিত করেছে। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ বা ‘শিখাগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, আবুল হোসেন ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ বা ‘শিখাগোষ্ঠীর’ লেখকেরা ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’- এই আদর্শকে ধারণ করে বিভিন্ন সংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রক্ষণশীলকে মুক্ত বিচার বুদ্ধি ও বিজ্ঞান মনস্ক চেতনার দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ ও ভালো-মন্দ যাচাই করেছেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখকেরা বাঙালি মুসলমান সমাজের পশ্চাৎপদতা নিয়ে ভেবেছেন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেছেন। আবুল ফজল তাঁর প্রবন্ধগুলোতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়কে আশ্রয় দিয়ে বাঙালি সমাজ ও মানস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলার মুসলমান সমাজে যে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা বিরাজমান ছিল, সেসব দূরীকরণই ছিল এ আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ধর্মবিশ্বাস, পর্দাপ্রথা, সুদ গ্রহণ, নৃত্যগীত ইত্যাদি সম্পর্কে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতেন। সাহিত্য সমাজের বিভিন্ন সভায় পঠিত এবং শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটত। আবুল ফজলের প্রবন্ধসমূহের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তার প্রবন্ধসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, এগুলো হলো সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ বা জীবন।
বিভিন্ন সময়ে তিনি সাহিত্য সম্পর্কিত নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে বিভিন্নমুখী চিন্তারাজি কয়েকটি প্রবন্ধে মূর্ত হয়ে উঠেছে। অবশ্যই আবুল ফজল সাহিত্যের তত্ত্ব বা তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মৌলিক কোনো চিন্তাধারার পরিচয় দেননি। সাহিত্য সম্পর্কে বড়ো কোনো সাহিত্যিক বা সাহিত্য সমালোচক সাধারণত যে সব মতামত পোষণ করে থাকেন সেই সবই নতুন করে তিনি স্মরণ করেছেন দেশের সাহিত্য-সমস্যার মুখোমুখী হতে গিয়ে।
এ ধরনের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘সাহিত্যের সংকট’ অন্যতম। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা যায়। কেননা পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষার ওপর চলেছে এক উৎপাত- যে ভাষা হচ্ছে • সাহিত্যিকদের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলেছেন,
“যে আবেগ ও প্রেরণা মহৎ রচনার প্রাণ, যা সাহিত্য-শিল্পীকে রচনায় করে তোলে উদ্বুদ্ধ, যা নিয়ে আসে এক অনির্বচনীয় তন্ময়তা তা আজ অনুপস্থিত-দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য সেই আবেগ ও প্রেরণা আজ রুদ্ধগতি।”
এ ধরনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হলো ‘সাহিত্যে ঐতিহ্য’। এ প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, অতীত ও বর্তমানের ভাবধারা, চিন্তা-চেতনা, রীতি-নীতি, ভাষাসহ বিভিন্ন উপাদান যা স্মরণীয় ও পরীক্ষিত, তাই ঐতিহ্য। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে সকল উপাদান ধারাবাহিকভাবে প্রচলিত পরীক্ষিত, চলিত পরীক্ষিত, তাই শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহ্য’।
লেখকের প্রবন্ধসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংস্কৃতি। আর এ ধরনের একটি অন্যতম প্রবন্ধ ‘সংস্কৃতি’। ‘সংস্কৃতি’ নামক প্রবন্ধে লেখক সংস্কৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণপূর্বক সংস্কৃতির বিকাশের পথ, সংস্কৃতি জীবনের সহায়ক বিষয, এর অন্তরায় এবং সংস্কৃতিবানের পরিচয় প্রদান করেছেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক যে সকল প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে ‘সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার সম্পর্ক, সংস্কৃতি তথা শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার প্রভাব, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তার ভূমিকা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক যে সকল প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে ‘লেখকের স্বাধীনতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন এই তিনভাগে আবুল ফজলের প্রবন্ধগুলো বিভক্ত হয়ে থাকলেও যেহেতু সাহিত্য বা জীবন কোনোটাই সংস্কৃতি থেকে পৃথক নয়, সে জন্য সংস্কৃতি প্রসঙ্গেও সাহিত্যের কথা ও জীবনের কথা বারে বারেই এসে গেছে। আর এই ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘লেখকের স্বাধীনতা’। এই প্রবন্ধে লেখক স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা ও এর প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেছেন।
লেখকের প্রবন্ধের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জীবন বা সমাজ, রাষ্ট্র। এ সবের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হলো ‘মানবতন্ত্র’। মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে লেখক মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন আমাদের জাতীয় জীবনের বা সমাজজীবনের নিয়ন্ত্রণকারী মূল শক্তিটি ধর্ম হতে পারে না। এই প্রবন্ধে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় তিনি প্রকাশ করেছেন বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের যে ধর্ম তা মানবতার চেয়ে বড়ো নয়। কেন লেখক ধর্মের চেয়ে মানবতাকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়।
তাঁর রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানবতাবোধ। আর তাঁর মানবতাবোধের ভিন্নতর পরিচয় পাওয়া যায় মানব-কল্যাণ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে তিনি মানব-কল্যাণের স্বরূপ নির্ণয়ের মাধ্যমে এর সাথে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের সম্পর্ক, মানব-কল্যাণে ধর্মীয় প্রভাব ও মানব-কল্যাণের সাথে পারলৌকিক সম্পর্ক বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন।
তাঁর রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানবতাবোধ। আর মানবতাবোধের সোচ্চার জয়গানে পরিপূর্ণ ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রবন্ধটি। পাকিস্তানকে ‘ই ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করা হলে আবুল ফজল ‘সমকাল’ পত্রিকায় এই প্রবন্ধটি লেখেন। এই প্রবন্ধে এই দিকে যেমন তাঁর অসাধারণ মনীষার পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি একজন দুঃসাহসী সত্য-উচ্চারণকারী শিল্পীর প্রকাশ লক্ষ করা গেছে। এ প্রবন্ধে তিনি ধর্মের ভিত্তিতে আধুনিক যুগের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে যে সকল
প্রতিবন্ধকতা ও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় তার পরিচয় দিয়েছেন।
‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লেখক বিজ্ঞানের জয় যাত্রার ফলে সৃষ্ট তথাকথিত যান্ত্রিক সভ্যতার সংকটের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে সভ্যতার স্বরূপ, সভ্যতার সংকট, এই সংকটের কারণ প্রভৃতি বিষয়ে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন।
পরিশেষে আমরা বরতে পারি যে, আবুল ফজল তাঁর অসাধারণ জ্ঞানগর্ব বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ফলে তিনি সৃজনশীল ও মননশীল একজন লেখক হিসেবে স্বীকৃত।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment