উত্তরঃ শাব্দিক অর্থে প্রথা বলতে সংস্কার বুঝায়। কিন্তু আইনের পরিভাষায় প্রথা হচ্ছে একটা সামাজিক রীতিনীতি যা সংশ্লিষ্ট সমাজের লোকজন বংশ পরস্পরায় অনুসরণ করে থাকে। এরূপ স্বীকৃত ও অনুসৃত দীর্ঘকালের আচরণ বিধি প্রথা হিসেবে চালু থাকায় এটা মেনে চলার একটা বাধ্যকরী শক্তি অর্জন করে। প্রথার পরিপন্থী কার্যাবলী সমাজে নিন্দিত হয় এবং সমাজের লোকজন প্রথা ভঙ্গকারীকে পরিহাস করে চলে, তাই প্রথার মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে। অবশ্য সকল প্রথাই স্বাভাবিক ন্যায়নীতির অনুসারী বলা যায় না। যেমন— সতীদাহ প্রথা ও দাস প্রথা ন্যায়-নীতির পরিপন্থী হলেও যুগ যুগ ধরে মানুষ তা মেনে এসেছে।
প্রথা সম্পর্কে বিভিন্ন আইনবিদ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রখ্যাত আইনবিদ্ ওয়েভষ্টারের মতে, দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত আচার-ব্যবহার সম্পর্কিত অলিখিত আইনকে প্রথা বলে। স্যামণ্ড বলেন, “প্রথা বলতে ঐ সকল রীতিনীতির সমষ্টিকে বুঝায়, যা ন্যায় ও জনকল্যাণমূলক নীতির উপর ভিত্তি করে জনগণের বিবেককে প্রভাবিত করে।” অধ্যাপক হল্যাণ্ড প্রথাকে বৈধ আইন বলে অভিহিত করেন। এ্যালেন বলেন যে, “প্রথা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মসমর্থিত আইন।”
বৈধ প্রথার আবশ্যকীয় শর্তঃ একটি প্রথাকে বৈধকরণের জন্য নিম্নলিখিত শর্তগুলি পূরণ করতে হবে-
(১) প্রাচীনত্ব (Antiquity) : একটি বৈধ প্রথার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে প্রাচীনত্ব। অর্থাৎ প্রথাকে অবশ্যই সুপ্রাচীন হতে হবে। স্যামণ্ড, এ্যালেন, প্যাটেনের ন্যায় আইনবিজ্ঞানীগণ প্রাচীনত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। প্রাচীন বলতে কত প্রাচীন হতে হবে সে সম্পর্কে কোন ঐক্যমত নেই। তবে সাধারণ অর্থে ইহা স্মরণাতীত কাল হতে প্রচলিত বুঝায়।
ইংল্যাণ্ডের প্রথার প্রাচীনত্ব প্রমাণের জন্য ১১৮৯ সালকে অর্থাৎ রাজা প্রথম রিচার্ডের সিংহাসনে আরোহণের বর্ষকে মূল ভিত্তি ধরা হয় । অর্থাৎ কোন প্রথা ১১৮৯ সাল হতে যদি প্রচলিত থাকে তবে তাকে প্রাচীন বলা হবে। এর পরে কোন প্রথা চালু হলে সেটা যথেষ্ট প্রচীন বলে বিবেচিত হবে না। তবে এটা উক্ত সময় হতে প্রচলিত আছে এটা বাদীর পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন বিধায় এটা দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত-তা প্রমাণ করলেই যথেষ্ট। সে ক্ষেত্রে বিবাদী যদি তা অস্বীকার করে তবে কোন্ সময় হতে তা প্রচলিত সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব বিবাদীর।
ইংল্যাণ্ডের এই প্রাচীনত্বের বিধি এ দেশে অনুসরণ করা হয় না। কলকাতা হাইকোর্ট অম্বলিকা দাসী বনাম অপর্ণা দাসী (I L R. 45 Cal. 835 ) মামলায় রায় দেন যে, যে সকল প্রথার অস্তিত্ব ১৭৯৩ কিংবা ১৭৯৩ সালের পূর্বে ছিল তাকেই সুপ্রাচীন প্রথা বলা যাবে। কিন্তু বোম্বাই হাইকোর্টের মতে, কোন প্রথা যদি একটানা ২০ বছর যাবত স্বীকৃত হয়ে থাকে তবে তাকে যথেষ্ট প্রাচীন হিসেবে গণ্য করা হবে।
(২) যৌক্তিকতা ( Reasonableness) : স্থানীয় প্রথাকে অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। প্রথার কর্তৃত্ব চূড়ান্ত নয়, ন্যায়নীতি ও জনকল্যাণের সহিত সংগতিপূর্ণ হলেই একটি স্থানীয় প্রথা আইনগত কর্তৃত্ব অর্জন করতে পারে। ১৯৫১ সালে রামাধন লাল বনাম রাধাশ্যাম মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট প্রথার যৌক্তিকতা সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একটি যুক্তিযুক্ত প্রথা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। দুই বা ততোধিক গ্রামের মধ্যে প্রবাহিত নদী বা খালের গভীর স্রোতধারার অনুসরণে সীমা নির্ধারণ করার জন্য প্রচলিত প্রথা অযৌক্তিক নয় বলে আদালত রায় দেয়। অতএব যৌক্তিকতা হচ্ছে বৈধ প্রথার একটি অন্যতম শর্ত।
(৩) বিধিবদ্ধ আইনের পরিপন্থী নয়ঃ কোন প্রথা বিধিবদ্ধ আইন বা কমন ল’ এর মৌলিক বিধিগুলির পরিপন্থী হতে পারে না। এরূপ হলে আদালত তা বাতিল ঘোষণা করতে পারেন। অর্থাৎ বিধিবদ্ধ আইনের পরিপন্থী কোন প্রথাকে আদালত কোনভাবেই আইন বলে গ্রহণ করতে পারে না, কেননা প্রথা কোন বিধিবদ্ধ আইনের কর্তৃত্ব বিনষ্ট করতে পারে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ, দত্তক গ্রহণ ইত্যাদি সকলই প্রচলিত প্রথার প্রতিচ্ছবি।
(৪) নিরবচ্ছিন্নতাঃ একটি প্রথাকে আইনের মর্যাদা পেতে হলে তা অবশ্যই দীর্ঘকাল ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রচলিত থাকতে হবে। বিভিন্ন সময়ে বা খন্ড খন্ড ভাবে প্রচলিত ছিল এমন প্রথা কার্যকরী হবে না প্রথাটি অব্যাহতভাবে কর্তৃত্ব ভোগ করেছে এরূপ প্রমাণ করতে হবে।
(৫) অধিকার হিসেবে অনুসৃতঃ প্রথার সহিত অবশ্যই আইনগত সম্পর্ক থাকতে হবে। অধিকার বা কর্তব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন স্বেচ্ছামূলক রীতি আইনের মর্যাদা পেতে পারে না। ন্যায্য অধিকার হিসাবে প্রথা অনুসৃত হতে হবে। প্রথার অনুসারীগণ বিশ্বাস করবে যে, ইহা শুধু স্বেচ্ছামূলক নয় বরং বাধ্যতামূলকও বটে। কাজেই ইচ্ছামত গ্রহণ করা বা বর্জন করার কোন অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের থাকবে না। অবশ্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ছাড়াই প্রকাশ্যভাবে প্রথা অনুসরণযোগ্য হতে হবে। ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠিত ইন্দর সিংহ বনাম গুরুদয়াল সিংহ (AIR 1967 SC 119) মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট এই মতে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, শুধুমাত্র নিশ্চিত যুক্তিই যথেষ্ট নয়, প্রথা অধিকাররূপে প্রতিপালিত হয় তার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে।
(৬) নৈতিকতা বোধঃ একটি বৈধ প্রথার জন্য নৈতিকতাবোধ অন্যতম উপাদান। নৈতিক আদর্শের পরিপন্থী কোন প্রথা আইনের মর্যাদা পেতে পারে না। উপজাতীয় কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন প্রথা প্রচলিত যে, একজন ধন-সম্পত্তির মালিক’ কোন স্ত্রীলোক অপর একজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করে তার পছন্দমত পুরুষদের সাথে মিলিত হতে নির্দেশ দেয় এবং উৎপাদিত সন্তানদের পিতা হিসেবে সে মহিলা পরিচয় দেয়। এরূপ একটি পরিস্থিতিতে ১৯৫৭ সালে বালুলম্বী বনাম বালকৃষ্ণ (AIR 1957 Mad, 97) মামলায় মাদ্রাজ হাইকোর্ট এরূপ সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, একজন স্ত্রীলোকের সহিত অন্য একজন স্ত্রীলোকের বিবাহ দানের প্রথা নৈতিকতাবোধের সহিত সামঞ্জস্যহীন এবং তাই ইহা নীতিবিরুদ্ধ কাজ।
সুতরাং দেখা যায় যে, উপরোক্ত শর্তগুলি পূরণের মাধ্যমেই প্রচলিত প্রথা আইনের মর্যাদা পেতে পারে। আর্থাৎ সমাজের নিকট যেগুলি প্রথা উপরে বর্ণিত শর্তগুলি পালন সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিকট সেগুলিই আইন। এ প্রসঙ্গে স্যামণ্ডের উক্তি, “ রাষ্ট্রের নিকট যেগুলি আইন, সমাজের নিকট সেগুলি প্রথা।”
বৈধ প্রথার উপাদানসমূহঃ একটি বৈধ প্রথার উপাদানসমূহ নিম্নরূপ-
প্রথমতঃ বৈধ সমাজ হতে সৃষ্ট কিন্তু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং বলবৎ করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ ন্যায়বিচার ও জনগণের সুবিধার্থে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জনগণ প্রথা মেনে চলে।
তৃতীয়তঃ একবার একটি প্রথা প্রতিষ্ঠিত হলে এটা প্রত্যাশিত যে তা আগামীতেও চালু থাকবে এবং এর উপর ভিত্তি করে যে সকল লেনদেন হবে তা বৈধ থাকবে।
Leave a comment