দেবপালের মৃত্যুর পর পালবংশের গৌরবরবি সাময়িকভাবে অস্তমিত হয়েছিল। পরবর্তী পালরাজাদের দুর্বলতা ও অকর্মণ্যতা ক্রমেই পাল সাম্রাজ্যকে পতনের মুখে ঠেলে দেয়। দেবপালের পরবর্তী রাজা ছিলেন শুরপাল। তাঁর তৃতীয় রাজ্যবর্ষের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যাওয়ায় বোঝা গেছে যে, শুরপাল ছিলেন দেবপালের পুত্র। এই তাম্রশাসনটি আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত মনে করা হত যে, শূরপাল ও বিগ্রহপাল একই ব্যক্তি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, শূরপালের পর বিগ্রহপাল সিংহাসনে বসেন। এই বিগ্রহপাল ছিলেন দেবপালের ভ্রাতুষ্পুত্র। পালবংশের সিংহাসনে আরোহণের এই নীতি পরিবর্তনের কারণ হিসেবে অনেকে অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্ভাবনার কথা বলে থাকে। যাইহোক্, বিগ্রহপাল ছিলেন দুর্বলচিত্ত, শান্তিপ্রিয় ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। স্বল্পকাল রাজত্ব করেই তিনি নিজপুত্র নারায়ণ পালকে সিংহাসনে বসিয়ে ধর্মকর্মে মন দেন। নারায়ণ পাল দীর্ঘ ৫৭ বৎসর (৮৬০-৯১৭ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্ব করেন। কিন্তু তিনিও ছিলেন দুর্বল ধরনের শাসক। পালরাজাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় পালদের বংশগত শত্রু প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটগণ। রাষ্ট্রকুটরাজ অমোঘবর্ষ অঙ্গ-বঙ্গ-মগধের শাসককে পরাস্ত করেছিলেন বলে লেখ থেকে জানা যায়। প্রতিহাররাজ ভোজের কাছেও পালরাজ পরাজিত হন। ভোজের পুত্র মহেন্দ্রপালের একাধিক লেখ পাটনা, গয়া ও উত্তরবঙ্গে পাওয়া গেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মগধ এবং উত্তরবঙ্গের কিছু অংশেও প্রতিহাররাজদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। কামরূপ ও উড়িষ্যার শাসকগণও পাল-অধীনতা মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। নারায়ণ পালের রাজত্বকাল এইরূপ দুর্যোগের মধ্যেই শেষ হয়। পরবর্তী রাজা রাজ্যপাল ও দ্বিতীয় গোপালের কয়েকটি লেখ মগধ ও উত্তর-বাংলায় পাওয়া গেছে। এ থেকে মনে হয় যে, তাঁরা হৃত রাজ্যবংশের কিছু অন্তত উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সম্ভবত, মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচনা হলে প্রতিহার শক্তি দুর্বল হয়ে যায় ও পালরাজাগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। কিন্তু বুন্দেলখণ্ডের চান্দেল্লগণের ও কলচুরিগণের আক্রমণে বাংলা আবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময়ে বা তার পূর্বে কম্বোজগণও পালরাজ্য আক্রমণ করে। উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় কম্বোজ অধিকার স্থাপিত হয়। মগধের সামান্য অংশে পালশক্তি কোনোরকমে টিকে থাকে।

পালবংশের পুনরুজ্জীবন—প্রথম মহীপাল :

দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী মহীপাল যখন সিংহাসনে বসেন (৯৭৭ খ্রিঃ) তখন পাল সাম্রাজ্য মগধের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। পাল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা ও তাকে পূর্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মহীপালের অন্যতম কৃতিত্ব। মহীপালের রাজত্বকালের বহু লেখ আমরা পেয়েছি। যেমন—বাঘাউরা মূর্তিলেখ, নারায়ণপুর মূর্তিলেখ, বেলোয়া তাম্রশাসন, সারনাথ লেখ, বানগড় তাম্রশাসন, ইমাদপুর লেখ, তেত্রাবন লেখ ইত্যাদি।

বানগড় ও বেলোয়া তাম্রশাসনে মহীপালকে তাঁর পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য কৃতিত্ব দান করা হয়েছে। এখানে ‘পিতৃরাজ্য’ বলতে সমগ্র বঙ্গকেই বোঝানো হয়েছে বলে ড. মজুমদার মতপ্রকাশ করেছেন। সমগ্র বঙ্গ জয় করুন বা না করুন, চন্দ্র রাজাদের পরাস্ত করে উত্তর বাংলা ও পূর্ব-বাংলা যে তিনি নিজ কর্তৃত্বাধীনে এনেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। পূর্ববঙ্গের ওপর তাঁর আধিপত্যের প্রমাণ দেয় কুমিল্লা জেলায় প্রাপ্ত বাঘাউরা লেখ’। এই লেখ থেকে জানা যায় যে, মহীপাল তাঁর তৃতীয় রাজ্যবর্ষে সমতটে একটি বিষ্ণুমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবার ভৌগোলিক দিক থেকে, মহীপালের পক্ষে আগে উত্তর-বাংলা জয় না করে পূর্ব-বাংলা জয় করা সম্ভব ছিল না। ‘বেলোয়া তাম্রশাসন’ থেকে জানা যায় যে, পঞ্চম রাজ্যবর্যের ঠিক পূর্বে বা ওই বৎসরই বরেন্দ্র তাঁর অধিকারভুক্ত হয়। পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গও তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল কিনা—তা বিতর্কের বিষয়। কারণ এই অঞ্চলগুলির ওপর তাঁর অধিকারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মহীপালের দ্বারভাঙা, কুরকিহার, ইমাদপুর, তেত্রাবন ইত্যাদি লেখর প্রাপ্তিদেশ প্রমাণ করে যে, বিহারের বেশ কিছু অংশ তাঁর রাজ্যাধীন ছিল। ‘সারানাথ লেখ’ থেকে জানা যায় যে, বেনারস পর্যন্ত তাঁর রাজ্যসীমা বিস্তৃত ছিল।

মহীপালের রাজত্বকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল, চোল সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের পূর্ব ভারত অভিযান। ‘তিরুমলয় লেখ’ থেকে এই অভিযান প্রসঙ্গে জানা যায়। অভিযানটি সংঘটিত হয়েছিল ১০২১-‘২৩ খ্রিস্টাব্দে। উৎকল জয় করে মেদিনীপুরের দণ্ডভুক্তির মধ্যে দিয়ে চোলসেনা বাংলায় প্রবেশ করে। “তিরুমলয় লেখা থেকে জানা যায় যে, বাংলায় তখন একাধিক রাজা রাজত্ব করতেন। কারণ চোলবাহিনী দণ্ডভুক্তির শাসক ধর্মপালকে, উত্তর রাঢ়ের রাজা বনশুরকে ও বাংলার রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেছিল। ড. সরকারের মতে, এই রাজাগণের কেউ ছিলেন মহীপালের বশীভূত মিত্র, কেউ বা তার সামন্ত। মহীপালও রাজেন্দ্রর সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হন, মতান্তরে পলায়ন করেন। তবে চোলরাজ উত্তর-পূর্ব ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের কোনো প্রচেষ্টা করেননি। লেখ অনুযায়ী এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গাজল সংগ্রহ, যার দ্বারা রাজেন্দ্র তাঁর নতুন রাজধানীকে পবিত্র করবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। এই অভিযানে সফল হবার পর তিনি ‘গঙ্গাইকোও’বা ‘গঙ্গাবিজেতা’ উপাধি নেন। যাইহোক্, এই কারণেই চোল অভিযানের ফলে গুরুতর কোনো ক্ষতি মহীপালের হয়নি। তবে রাজত্বের শেষদিকে কলচুরিরাজ গাঙ্গেয় দেবের হাতে মহীপালের পরাজয় ঘটে। লেখ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ‘গোহরবা লিপি’ থেকে অনুমিত হয় যে, গাঙ্গেয়দেব অঙ্গরাজকে (মহীপাল) পরাস্ত করেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে চোলদের ওপর মহীপাল তাঁর অধিকার হারান। কারণ বৈহাকির রচনা থেকে অনুমিত হয় যে, ১০৩৪ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী কলচুরিরাজের অধীনস্থ ছিল।

মহীপালের রাজত্বকালে গজনির শাসন সুলতান মামুদ একাধিকবার আক্রমণ করে উত্তর ভারতকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। উত্তর ভারতের রাজারা মুসলমান আক্রমণের বিরুদ্ধে এক শক্তিজোট গড়ে তুলেছিলেন। সেই শক্তিজোটে যোগ না দেবার জন্য মহীপাল অনেক ঐতিহাসিকের দ্বারা সমালোচিত হয়েছেন। আর. ডি. বন্দ্যোপাধ্যায়, আর, পি, চন্দ প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ একথাও বলেছেন যে, উত্তর বিহার জয় করার পর সম্রাট অশোকের মতো মহীপাল ধর্মীয় ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এ মত সত্য হোক বা না হোক্, মহীপালের পক্ষে ওই শান্তিজোটে যোগ না-দেবার যথেষ্ট উপযুক্ত কারণ ছিল। প্রথমত, পৈত্রিক রাজ্য উদ্ধার করাই ছিল তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। দ্বিতীয়ত, চোল ও কলচুরি আক্রমণের সম্মুখীন হতে গিয়ে তাঁকে সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে হয়েছিল। তৃতীয়ত, বাংলা ও বিহার ছিল মুসলিম আক্রমণ-সীমার বহির্ভূত। তাই নিজ রাজ্যের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মোকাবিলা করার পরিবর্তে বহুদূরবর্তী মুসলিম আক্রমণ প্রতিরোধে শক্তিক্ষয় না-করে মহীপাল সুবিবেচনার কাজই করেছিলেন।

মহীপালের রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্মও তার পূর্বগৌরব ফিরে পায়। তিনি বহু সংঘ, বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি স্থাপন করেছিলেন, সারানাথের বিহারগুলির সংস্কারসাধন করেছিলেন। তাঁর সময়ে বহু বৌদ্ধপণ্ডিতের আগমন ঘটেছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তিলোপা, জ্ঞানশ্রীমিত্র প্রমুখ।

মহীপাল যে কেবলমাত্র রাজ্য-সংগঠক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন সুশাসক ও অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শহর, পুষ্করিণী প্রভৃতি আজও তাঁর জনপ্রিয়তার পরিচয় বহন করে আছে। রংপুর জেলার মহীগঞ্জ, চোগরা জেলার মহীপুর ইত্যাদি স্থান, দিনাজপুরের মহীপাল দিঘি, মুর্শিদাবাদের (মহীপাল নির্মিত) সাগরদিঘি ইত্যাদি তাঁর কৃতিত্বের নমুনা। এমনকি তাঁর নামে বাংলাদেশে বহু লোকগাথা পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল। মহীপাল সবদিক থেকেই পাল সাম্রাজ্যকে সুসংবদ্ধ করে এক নবজীবন দান করেছিলেন।

মহীপালের পরবর্তী নৃপতিগণ :

প্রথম মহীপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী নয়পাল দীর্ঘদিন কলচুরিরাজ কর্ণের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। লেখ থেকে জানা যায় যে, নয়পাল কলচুরি সেনাবাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন। পরিশেষে অতীশ দীপঙ্করের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। তবে পরবর্তী রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালের সময়ে পুনরায় এই বিবাদ শুরু হয়। ‘রামচরিত থেকে জানা যায় যে, এবারেও পালরাজ জয়ী হন। তবে তিনি নিজকন্যা যৌবনশ্রীর সাথে কর্ণের বিবাহ দিয়ে স্থায়ীভাবে শান্তি স্থাপন করেন। কলচুরিরাজ ব্যতীত ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের নেতৃত্বে চালুক্যগণও পাল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। ত্রিপুরাতে এক স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এমনকি মগধের বিভিন্ন অংশের ওপরেও তাঁদের অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এইভাবে নয়পাল ও বিগ্রহপালের আমলে (১০৩৮-১০৭০ খ্রিঃ) পাল অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে।

পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’। তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালেই নানাদিক থেকে পাল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। বৈদেশিক শক্তির আক্রমণে অভ্যন্তরীণ প্রশাসন ভেঙে পড়ে। সেই সুযোগে সামন্ত রাজাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। তৃতীয় বিগ্রহপালের তিন পুত্র মহীপাল, শুরপাল ও রাজ্যপালের মধ্যে দ্বিতীয় মহীপাল সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন অযোগ্য ও কুচক্রী শাসক। তাঁর কুশাসনে কয়েকজন সামন্ত বিদ্রোহী হয়। মহীপাল সন্দেহ করেন যে, তাঁর ভ্রাতাদ্বয়ও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। ফলে মন্ত্রীদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে তিনি তাদের কারারুদ্ধ করেন। তারপর প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি না থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহীদের মুখোমুখি হন। পরিণামে বিদ্রোহীদের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। দিব্যোকের নেতৃত্বে ‘কৈবর্ত’ নামক বিদ্রোহীরা বরেন্দ্রে স্বাধীন শাসন প্রবর্তন করে।

রামপাল (১০৭৭-১১৩০ খ্রিঃ) :

সামন্তদের বিদ্রোহজনিত অস্থিরতার সুযোগে শুরপাল ও রামপাল কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা সম্ভবত মগধে গিয়ে পাল শাসনের সূচনা করেন। প্রথমে সিংহাসনে বসেন শুরপাল। তারপর রাজা হন রামপাল। এদিকে দিব্যোকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদ্দোক ও পুত্র ভীম যথাক্রমে বরেন্দ্রের সিংহাসনে বসেন। ভীম ছিলেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল শাসক। এই সময়ে রামপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। এ কাজে তিনি তাঁর সামন্ত রাজাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ‘রামচরিত’ থেকে আমরা জানতে পারি যে, তিনি ভূমি ও ধনসম্পদের লোভ দেখিয়ে তাদের বশীভূত করেন। তারপর তাদের সাহায্যে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। এ বিষয়ে প্রধান সহায় ছিলেন তাঁর মাতুল রাষ্ট্রকুটরাজ অঙ্গপতি মোহন। তিনি তাঁর দুই পুত্র মহামাগুলিক কাহুরদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মহাপ্রতিহার শিবরাজকে সাথে নিয়ে রামপালের পক্ষে যোগ দেন। অন্যান্য সামন্তদের একটি তালিকা রামচরিতে প্রদত্ত হয়েছে। সেখানে নিম্নলিখিত রাজাদের নাম পাওয়া যায়-

(১) মগধ ও পিথীর রাজা ভীমযশ।(২) কোটাটবীর রাজা বীরগুণ। অধ্যাপক মজুমদার-এর মতে, পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কয়েক মাইল পূর্বে অবস্থিত কোটেশ্বর গ্রামই কোটাটবী। (৩) দণ্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ।দণ্ডভুক্তি হল মেদিনীপুরের দাঁতন। (৪) দেবগ্রাম সংযুক্ত বালবলভীরাজ বিক্রম। (৫) আটবিক সামন্ত চূড়ামণি অপারমন্দাররাজ লক্ষ্মীশুর। অপারমন্দার হল হুগলি জেলার গড় মান্দারণ। (৬) কুবুবটির শূরপাল। কুবুবটি সাঁওতাল পরগনার নয়াদুমকার উত্তরে অবস্থিত। (৭) তৈলকম্পরাজ রুদ্রশিখর। তৈলকম্প হল ধানবাদ-পুরুলিয়ার তেলকুপি। (৮) উচ্ছলরাজ ভাস্কর। পঞ্চানন মণ্ডলের মতে, উচ্ছল হল বর্ধমান জেলার উচালন গ্রাম। (৯) ঢেক্করীরাজ প্রতাপসিংহ। ঢেক্করিকে বর্ধমান জেলার ঢেকুরি গ্রামের সাথে শনাক্ত করা যায়। (১০) কয়ঙ্গল মণ্ডলের অধিপতি নর-সিংহার্জুন। কয়ঙ্গল অর্থাৎ কজঙ্গল হল রাজমহলের দক্ষিণে অবস্থিত কাঁখজোল। (১১) সঙ্কটগ্রামের রাজা চণ্ডার্জুন। (১২) নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ। অনেকের মতে, ইনি সেনবংশীয় বিজয়সেন। তা যদি হয়, তবে নিদ্রাবলী রাঢ় যা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও অবস্থিত ছিল। (১৩) কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপার্বণ। কৌশাম্বী সম্ভবত বগুরা জেলার কুশুম্বী। (১৪) পদুবন্ধা মণ্ডলের রাজা সোম। ড. সরকারের মতে, পদুবন্ধা হল বর্তমান পাবনা। এ ছাড়াও আরও অনেক সামন্ত রাজা রামপালের সাথে যোগদান করেন বলে ‘রামচরিতে’ বলা হয়েছে।

উল্লিখিত রাজাদের অধিকাংশই বসতিস্থান ছিল দক্ষিণ বিহার ও দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ। একমাত্র কৌশাম্বী ছাড়া বরেন্দ্রের কোনো সামন্ত রাজা রামপালের পক্ষে যোগ দেননি। যাইহোক্, এই সামন্ত রাজাদের সাথে মিলিত হয়ে রামপাল বরেন্দ্রী উদ্ধারে যাত্রা করেন। প্রথমে রাষ্ট্রকুট শিবরাজ গঙ্গা পার হয়ে বরেন্দ্রী আক্রমণ করেন। তিনি কিছুটা সাফল্য লাভ করলে রামপাল সেনাবাহিনীর বৃহৎ অংশ-সহ গঙ্গার উত্তরতীরে অবতীর্ণ হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। হস্তীপৃষ্ঠে যুদ্ধরত অবস্থায় ভীম বন্দি হন। কিন্তু এর পরেও ভীমের মিত্র হরি প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান। পরিশেষে রামপাল কৌশলে তাদের সপক্ষে আনেন। ‘রামচরিত’ থেকে জানতে পারা যায় যে, বহুদিন পর পিতৃভূমি উদ্ধার করে রামপাল প্রথমেই সেখানে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যত্নবান হন। তিনি প্রজাদের করভার লাঘব করেন, কৃষির উন্নতি ঘটান এবং গঙ্গা ও করতোয়ার সঙ্গমস্থলে রামাবতীতে রাজধানী স্থাপন করেন।

পিতৃরাজ্য উদ্ধারের পর রামপাল নিকটবর্তী রাজ্যগুলি জয় করতে সচেষ্ট হন। ‘রামচরিতে’ বলা হয়েছে যে, পূর্বাঞ্চলের বর্মনরাজ নিজের নিরাপত্তার জন্য উৎকৃষ্ট হস্তী ও রথ উপহার দিয়ে রামপালকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। এই বর্মনরাজকে হরিবর্মনের সাথে শনাক্ত করা যায়। রামপাল কামরূপ ও জয় করেন বলে ‘রামচরিত’ থেকে জানা যায়। এই সময়ে কামরূপের রাজা ছিলেন ধর্মপাল। রামপাল উড়িষ্যা জয়েও প্রবৃত্ত হন। একই উদ্দেশ্যে পূর্বগঙ্গরাজ অনন্তবর্মন চোড় গঙ্গ ও উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। এই সময়ে কুলোত্তুঙ্গ চোল গঙ্গরাজ্যে অভিযান চালালে তা রামপালের পক্ষে সহায়ক হয়। সম্ভবত গঙ্গদের বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য তিনি কুলোত্তুঙ্গের সঙ্গে বশ্যতামূলক সন্ধি স্থাপন করেন। কারণ তামিলকাব্য ‘কলিঙ্গত্তু পরণি-তে বলা হয়েছে যে, বঙ্গ, বঙ্গাল, মগধের নৃপতি কুলোত্তুঙ্গকে কর দিতেন। এইভাবে রামপাল কলিঙ্গ পর্যন্ত জয় করেন। এ ছাড়া বারাণসী অঞ্চলে রাজত্বকারী প্রতিবেশী গাহড়বাল শক্তির সঙ্গেও তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষে কখনো রামপাল, কখনো গাহড়বালরাজ গোবিন্দচন্দ্র জয়ী হতে থাকেন। পরিশেষে রামপাল গাহড়বালদের প্রতিহত করতে সমর্থ হন। তবে তিনি মিথিলার নান্যদেবকে প্রতিহত করতে পারেননি। মিথিলা তাঁর হস্তচ্যুত হয়েছিল।

‘চণ্ডীমৌ লিপি’ অনুযায়ী রামপাল ৪২ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ‘রামচরিত’ থেকে জানা যায় যে, পরম শুভানুধ্যায়ী মাতুল রাষ্ট্রকুটরাজ মোহনের মৃত্যুতে তিনি গভীর শোকগ্রস্ত হন ও গঙ্গার জলে প্রাণ বিসর্জন দেন।

নির্বাসনে জীবন শুরু করেও অসীম মনোবলের দ্বারা রামপাল পাল সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। খণ্ডবিখণ্ড ও অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ সাম্রাজ্যকে গ্রথিত করে তিনি কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। তিনিই ছিলেন পালবংশের শেষ দক্ষ নৃপতি। তাই ড. মজুমদার (R. C. Majumdar) তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “The reign of Rampal was the fickering of the lamp before its final extinction.” তবে সহজাত ত্রুটি ও অন্তর্দৃষ্টির অভাবহেতু রামপাল তাঁর কাজকে স্থায়িত্ব দিতে পারেননি। সামন্তদের শক্তি কমানোর কোনো চেষ্টা তিনি করেননি বা কার্যকরী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনও করেননি। তাই তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পাল সাম্রাজ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে।