ভূমিকা: তিরিশোত্তর কালের জীবনবোধ গড়ে উঠেছে কালের দিক থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এবং ভাবের দিক থেকে তা রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্তি লাভের প্রয়াসী। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই তা নতুন সুরের সাধক। বিশেষভাবে এ সময়ের লেখকরা সচেষ্ট ও সক্রিয় ছিলেন জীবনের অবসাদ, অবক্ষয়, দারিদ্র্য, গ্লানি ও অস্বাভাবিকতাকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে শিল্পায়িত করে প্রকাশ করতে। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তারা সাহিত্যে বাস্তবতার উদ্যোক্তা হলেন।

তিরিশোত্তর উপন্যাসের ক্রমধারা: তিরিশোত্তরকালের লেখকগণ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় যে অভিনবত্ব সঞ্চার করেছিলেন উপন্যাসেও তা বিদ্যমান। বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে তারা ছিলেন বিশিষ্ট। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “একদিকে বিপ্লব ও রূপান্তরের বিশ্ববোধ, অপরদিকে ঘন ঘন জাতীয় আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের নিষ্ফল আলোড়ন। একদিকে ফ্রয়েডের অবচেতন লোকের আবিষ্কার, অপরদিকে, মার্কস-এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নবীন জ্ঞান তিরিশের উপান্তে এ জট পাকানো বাস্তব জীবনে গ্রন্থিমোচনের জন্য দুঃসাধ্য বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার দায় ছিল ঔপন্যাসিকদের”। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সময়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বাস্তবতা দ্রুত বদলে যায়। মানুষের পারিবারিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে শিক্ষার প্রসার ও অর্থনৈতিক সংকট। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এবং অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা সাধারণ মানুষকে যেমন করে তোলে অস্থির তেমনি তাকে করে তোলে অধিকার-সচেতন। এই নতুন সামাজিক বাস্তবতায় নতুন দিগন্ত সন্ধানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে যুক্ত হন নতুন ধারার কয়েকজন লেখক। এঁরা মানুষের মনোলোকের জটিল রহস্য সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছে সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে সমাজের দরিদ্র এবং অবজ্ঞাত মানুষের জীবন। এঁরা হলেন: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন লেখক রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হন। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’-‘পঞ্চগ্রাম’, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নিচে তিরিশোত্তর বাংলা উপন্যাসের ক্রমধারা আলোচনা করা হলো:

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১): তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তিরিশোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তিনি সমকালীন উপন্যাসে সবচেয়ে সমাজসচেতন ছিলেন। তিনি ব্যক্তির উপর সমাজকে স্থান দিয়ে সার্থক সামাজিক উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন। ‘ধাত্রীদেবতা’, গণদেবতা, পঞ্চদেবতা এগুলো তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬): তিরিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে তিনি গতানুগতিক ধারায় নতুন চিন্তার নতুন পথ নিজেই বের করে নিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে বাস্তবতা নিয়ে আসেন। তার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পকুশলতা বাংলা উপন্যাসকে সমৃদ্ধির স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। প্রথম পর্যায়ের উপন্যাসে মানিক ফ্রয়েডের তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), জননী (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) প্রভৃতি। দ্বিতীয় পর্যায়ের উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পদৃষ্টিতে মার্কসীয় দর্শনকে তুলে ধরেছেন। মানুষের আন্তরিক পরিবর্তন সাধনের জন্য যে আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন প্রয়োজন-এ বিশ্বাসে উপনীত হন তিনি। চেতনা ও আঙ্গিকের এ নতুন শিল্পের বহিঃপ্রকাশ ঘটে চিহ্ন, চতুষ্কোণ, দর্পণ, শহরতলী প্রভৃতি উপন্যাসে। তিনি ফ্রয়েড ও মার্কসবাদ তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটিয়ে সাহিত্যের মধ্যে এক অমূল্য কীর্তি স্থাপন করেছিলেন।

বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪): বুদ্ধদেব বসু অতি আধুনিক ধারায় গীতিকাব্যধর্মী উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
তার গদ্যের বৈশিষ্ট্য ছিল সংগীতময়তা ও স্বতঃস্ফূর্ততা। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫৬। তার মধ্যে উপন্যাস ৫০টি। তিনি উপন্যাসে যে ঘাত-প্রতিঘাত ও মানবিক প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করেছেন তাতে কাব্যোচ্ছ্বাসের প্রাধান্য বিদ্যমান। ‘অকর্মণ্য, ‘যেদিন ফুটল কমল’ প্রভৃতি উপন্যাসে তিনি কাব্যপ্রবণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিথিডোর, নির্জন স্বাক্ষর, লাল মেঘ, গোলাপ কেন কালো ইত্যাদি উপন্যাসে তার নতুন জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়।

বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯): বনফুল উপন্যাসের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। বিচিত্র মানুষের চরিত্র চিত্রণে তার দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘কিছুক্ষণ’, ‘পঞ্চপর্ব’, তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০): বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতি চেতনার শিল্পী হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। বাংলা উপন্যাসে তিনি স্বতন্ত্র ও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন। তার উপন্যাসসমূহের মধ্যে ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯), অপরাজিত (১৯৩২), আরণ্যক (১৯৩৯), ইছামতি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

অন্যান্য ঔপন্যাসিক: এ সময়ে উপন্যাস রচনায় আরো যারা বিখ্যাত ছিলেন তাঁরা হলেন জরাসন্ধ, অবধূত, মনোজ বসু, কাজি আবদুল ওদুদ প্রমুখ। তারা রোমান্টিকতা, গণজীবন প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে উপন্যাস রচনা করে খ্যাতিমান হয়েছেন।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বিষয় বৈচিত্র্যের আঙ্গিকের রূপান্তরে, দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে এ সময়ে বাংলা উপন্যাস বিশিষ্ট ও সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছে। এ সময়ের ঔপন্যাসিকরা শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।