[1] মুদ্রাসংকট: ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। তারা ভারতীয় অর্থসম্পদও যুদ্ধে ব্যাপক পরিমাণে কাজে লাগায়। ফলে ভারতের অর্থনীতিতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য ব্রিটেন থেকে ভারতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আমদানির প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে স্বর্ণ রপ্তানির ওপর নানা বিধিনিষেধ থাকায় যে পরিমাণ সােনা ভারতের প্রাপ্য ছিল ব্রিটেন তা ভারতে পাঠায়নি। এদিকে মুদ্রা তৈরির জন্য রুপাের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এসময় ভারতে রুপাের জোগান হ্রাস পায়। ফলে মুদ্রা উৎপাদন ব্যাহত হয়। এভাবে যুদ্ধের কারণে ভারতে মুদ্রাব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়।

[2] রুপাের মূল্যবৃদ্ধি: মুদ্রা তৈরির জন্য যুদ্ধের পর রুপাের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পেলে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে রুপাের মূল্যও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের বাজারে এক আউন্স রুপাের দাম ছিল ২৫-২৭ পেন্স। এই দাম ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ৫৮ পেন্স ছাড়িয়ে যায়। ভারত সরকারকে মুদ্রা তৈরির জন্য ১৯১৬ থেকে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ রুপাে উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়।

[3] রুপাের মুদ্রা তৈরিতে লােকসান: রুপাের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে রুপাের মুদ্রার বাহ্যিক মূল্য (Face Value) রুপাের মুদ্রার ধাতুর মূল্যের চেয়ে কমে যায়। অর্থাৎ টাকা গলিয়ে রুপাে বিক্রি করলে রুপাের টাকার বাহ্যিক মূল্যের চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যায়। ফলে রুপাের টাকা তৈরি করলে সরকারের লােকসান হয়।

[4] বাণিজ্যে মন্দা: যুদ্ধের পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে মন্দা দেখা দিলে সারা পৃথিবীতেই দামস্তর নেমে যায়। এই মন্দার ফলে ভারতেও রপ্তানি মূল্য হ্রাস পায়। রপ্তানি মূল্য যেখানে ১৯১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩৩০ কোটি টাকা, সেখানে ১৯২০-২১ খ্রিস্টাব্দে এই মূল্য কমে দাঁড়ায় ২৫৮ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে।

[5] মুদ্রা সংকট দূরীকরণে পদক্ষেপ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে রুপাের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং এর ফলে দেশে মুদ্রা ব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দেয় তা মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এগুলি হল一

  • [i] ভারত থেকে রুপাের মুদ্রা ও রুপাের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়। 

  • [ii] রুপাের মুদ্রা গলিয়ে মূল্যবান ধাতু হিসেবে রুপাে বিক্রি করা বেআইনি বলে ঘােষিত হয়। 

  • [iii] কয়েক ধরনের কাগজের মুদ্রা চালু করা হয় এবং কাগজের মুদ্রার প্রচলন বাড়ানাে হয়। 

  • [iv] মুদ্রা তৈরির ক্ষেত্রে রুপাের ব্যবহার কমিয়ে নিকেলের খুচরাে পয়সা চালু করা হয়। 

  • [v] আমেরিকা ও কানাডা থেকে সােনা কিনে এনে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করে মুদ্রার চাহিদা মেটানাের চেষ্টা করা হয়। 

  • [vi] রিজার্ভ-বিহীন নােট চালুর উর্ধ্বসীমা ১৪ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২০ কোটি টাকা করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের মুদ্রাব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দেয়, তা দূর করার উদ্দেশ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার ব্যাবিংটন স্মিথের সভাপতিত্বে ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটি’ নামে এক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মুদ্রাব্যবস্থার অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার উদ্দেশ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন

[1] কমিটির সুপারিশ: মুদ্রা সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটি সুপারিশ করে যে—

  • [i] টাকাকে স্টার্লিং-এর সঙ্গে যুক্ত না করে সরাসরি সােনার সঙ্গে যুক্ত করা হােক। 

  • [ii] টাকাকে ২ সিলিং মূল্যের সােনার সমান মূল্য বলে ধরে নেওয়া হােক। 

  • [iii] ব্রিটিশ স্বর্ণমুদ্রাকে ১০ টাকার সমান মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হােক। 

  • [iv] সােনা আমদানি ও রপ্তানির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হােক। 

  • [v] স্বর্ণমুদ্রা তৈরির জন্য বােম্বাইতে টাকশাল তৈরি করা হােক।

[2] পরবর্তী পদক্ষেপ: যুদ্ধের প্রভাবে ভারতের অর্থনৈতিক বাজার চরম অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। ব্যাবিংটন স্মিথ কমিটির সুপারিশ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে। এই পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রার সরবরাহ সংকোচন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুদ্রা সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়।