[1] ব্রিটিশ শাসনের রক্ষা-প্রাচীর: পলাশির যুদ্ধ (১৭৫৭ খ্রি.) এবং বক্সারের যুদ্ধে (১৭৬৪ খ্রি.) জয়লাভের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এরপর ভারতে দ্রুত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটে ও তারা ভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর তারা ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের সমর্থক গােষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। অনুগত এই দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শাসনকে বারংবার রক্ষা-প্রাচীরের মতাে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।

[2] ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য: ব্রিটিশদের প্রতি কোনাে কোনাে দেশীয় রাজ্যের ক্ষোভ থাকলেও নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়ােজনে তারা প্রকাশ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখাত। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারতদর্শনকে বয়কট করে। কিন্তু দেশীয় রাজ্যগুলি তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর ভারতদর্শনকে অর্থবহ করে তােলে। এই রাজ্যগুলি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা ভুলে গিয়ে বিদেশি ইংরেজদের তাঁবেদারি করেছে। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি রাজ্যগুলির আনুগত্য অটুট রাখার জন্য সরকার দেশীয় রাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংস্কারের কোনাে তাগিদ দেখায়নি।

[3] মহাবিদ্রোহ প্রতিরােধে ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রায় সর্বত্র ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবিরােধী মহাবিদ্রোহ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এসময় ভারতের কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের শাসক তাদের সেনা সরবরাহ করে ইংরেজ সরকারকে মহাবিদ্রোহ দমন করতে যথেষ্ট সহায়তা করে। ব্রিটিশ সরকারের বিপদের কালে পাঞ্জাবের সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে সরকারের সুবিধা করে দেয়।

[4] জাতীয় আন্দোলন দমনে উদ্যোগ: কার্জনের পরবর্তী শাসক লর্ড মিন্টো (১৯০৫-১০ খ্রি.) দেশীয় রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ-ভারতে ঘটে চলা রাজনৈতিক পরিবর্তন থেকে আলাদা রেখে উদীয়মান জাতীয়তাবাদের প্রভাব থেকে সেখানকার মানুষদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। ভারতের ব্রিটিশবিরােধী বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য সরকারের পাশে দাঁড়ায় এবং আন্দোলন দমনে সরকারকে সহায়তা করে। বঙ্গভঙ্গ- বিরােধী স্বদেশি অন্দোলন (১৯০৫-১১ খ্রি.), অসহযােগ আন্দোলন (১৯২০-২২ খ্রি.) প্রভৃতির সময় দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের রাজ্যে ব্রিটিশবিরােধী কর্মকাণ্ড প্রতিরােধ করে। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, “.. জাতীয়তাবাদী চ্যালেঞ্জ যখন উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন এইসব ব্রিটিশভক্ত রাজপুরুষেরাই ব্রিটিশের সবচাইতে বিশ্বস্ত মিত্র ছিলেন।”

[5] সরকারকে সহায়তা: যুদ্ধের সময় দেশীয় রাজ্যগুলির কাছ থেকে সহায়তালাভের স্বার্থেই সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার নীতি গ্রহণ করে। ফলে দেশীয় রাজ্যগুলিও সরকারের যুদ্ধ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করে এবং সামরিক-সহায়তা দিয়ে তাদের খুশি করার চেষ্টা করে। হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশ যুদ্ধ তহবিলে ২৫ লক্ষ পাউন্ড দান করেন। গােয়ালিয়রের রাজা বেশ কিছু সেনা ও একটি হাসপাতাল, জাহাজ দিয়ে ব্রিটিশদের সহায়তা করে। তুর্কিদের কাছ থেকে ব্রিটিশরা হাইফা দখল করার সময় যােধপুরের অশ্বারােহী সেনারা ইংরেজদের যথেষ্ট সহায়তা করে।

[6] ১৯৩৭-এর নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া: জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য পায়। এর ফলে কংগ্রেস ইতিপূর্বে দেশীয় রাজ্যগুলিতে হস্তক্ষেপ না করার যে নীতি ঘােষণা করেছিল, তা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে বাতিল করা হয়। অল ইন্ডিয়া স্টেটস পিপলস কনফারেন্স দেশীয় রাজ্যগুলিতে যে গণ আন্দোলন শুরু করে কংগ্রেস তাতে সমর্থন জানায়। এতে দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। বৃহৎ দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশদের সহায়তায় দৃঢ় হাতে আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নিলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশীয় রাজ্যগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে নিজেদের রাজ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।

[7] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সরকারকে সহায়তা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারকে সহায়তা করে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। জয়পুরের মহারাজা ইংরেজদের পক্ষে জয়পুর সেনাদলের নেতৃত্ব দেন। বার্মার যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে বুন্দির মহারাজা ইংরেজদের কাছ থেকে মিলিটারি ক্রস পদক লাভ করেন।