মার্কসীয় দর্শন অনুসারে মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় প্রতিটি যুগে ধারণাকে আধিপত্য করতে -দেখা যায়। চিরকালই দেখা গেছে যে এই সমস্ত ধারণাগুলি হল সমকালীন শাসকশ্রেণীরই ধারণা। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে’ মার্কস-এঙ্গেলস বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, “চিত্তার ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বৈষয়িক উৎপাদনের পরিবর্তনের মাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানসিক সৃষ্টির প্রকৃতিতেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রত্যেক যুগের প্রাধান্যকারী ধারণাগুলি চিরকালই হল সেই যুগের শাসক শ্রেণীরই ধারণা’ (“The ruling ideas of each age have ever been the ideas of its ruling class.”)। মার্কস-এঙ্গেলস আরও বলেছেন যে, ‘মানুষের বৈষয়িক অস্তিত্বের অবস্থাদি, তার সামাজিক সম্পর্কসমূহ ও তার সামাজিক জীবনের পরিবর্তন ঘটে। এই সমস্ত প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ সংক্ষেপে মানুষের চেতনার পরিবর্তন ঘটে। মার্কস-এঙ্গেলসের অভিমত অনুসারে এটা অনুধাবন করার জন্য গভীর অন্তর্দৃষ্টি অনাবশ্যক।

মার্কসীয় ধারণা অনুসারে সমাজেই সব সময়ে একটি মূল কাঠামো থাকে। এই কাঠামোটি হল সংশ্লিষ্ট সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় একটি নির্দিষ্ট স্তরের আর্থনীতিক ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থার বিকাশ ও সংরক্ষণের স্বার্থে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ উপরি-কাঠামো গড়ে উঠে। এই উপরি-কাঠামো হল রাজনীতি, আইন, ধর্ম, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি প্রভৃতির এক উপরিকাঠামো। সমাজে নির্দিষ্ট কোন একটি যুগে নির্দিষ্ট একটি আর্থনীতিক মূল কাঠামো বিদ্যমান ও সক্রিয় থাকে। সেই নির্দিষ্ট কোন একটি যুগে সবদিক থেকে সঙ্গতিপূর্ণ একটি উপরি-কাঠামোর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। তাই এই উপরি-কাঠামো কোন শাশ্বত বা চিরন্তন বিষয় নয়। আর্থনীতিক মূল কাঠামোর পতন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপরি-কাঠামোর ভাঙ্গন দেখা দেয়। সুতরাং রাজনীতি, ধ্যান-ধারণা, ধর্ম-দর্শন প্রভৃতি কোন স্থায়ী বিষয় নয়। এগুলি পরিবর্তনশীল।

মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় এক একটি পর্যায়ে এক এক ধরনের আর্থনীতিক কাঠামো ও উৎপাদন সম্পর্ক বর্তমান থাকে। সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক কাঠামো ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে এক-একটি শ্রেণী আর্থনীতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব কায়েম করার সুযোগ পায়। এক সংশ্লিষ্ট শ্রেণী শাসকশ্রেণী হিসাবে পরিচিতি পায় ও সমাজে প্রভুত্বের অধিকারী হয়। এই সময়ে যে উপরিকাঠামো গড়ে উঠে তার কাজ হল বিদ্যমান শাসক শ্রেণীর স্বার্থের সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন। সমকালীন আর্থনীতিক কাঠামো বা ভিত্তি থেকেই সৃষ্টি হয় বিশেষ বিশেষ মতাদর্শ, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা প্রভৃতি। সংশ্লিষ্ট আর্থনীতিক কাঠামোর সংরক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণী হল নিবেদিত প্রাণ। এই কারণে উপরি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা প্রভৃতি শাসকশ্রেণীর স্বার্থেরই ধারক ও বাহক হিসাবে ভূমিকা পালন করে। প্রকৃত প্রস্তাবে শ্রেণীবিভক্ত ও শোষণভিত্তিক প্রত্যেক সমাজেই এক শ্রেষ্ঠতাবাদী মতাদর্শের অস্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। সমকালীন সমাজে প্রাধান্যকারী এই মতাদর্শটি সংখ্যাবিশিষ্ট মানুষের উপর মুষ্টিমেয় মানুষের শাসন-শোষণকে বিবিধ তাত্ত্বিক যুক্তিজালের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। দাস সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে শ্রেণীবিভক্ত ও শোষণমূলক সকল সমাজব্যবস্থাতেই এই ধারা বা প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। তবে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাতেই এর প্রাবল্য অধিক।

সমাজবিকাশের ধারায় প্রথম শ্রেণীবিভক্ত ও শোষণভিত্তিক সমাজ হল দাস-সমাজ। দাস মালিকদের স্বৈরী ক্ষমতার অবশিষ্টাংশকে তুলে ধরার জন্য অগাসটিন রাষ্ট্রকে পুরোপুরি গীর্জার অনুগামী করার তত্ত্ব প্রচার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে সামন্ত সমাজের বিকাশের গোড়ার দিকে অগাস্‌টিন তাঁর এই বক্তব্য ব্যক্ত করেন। আবার অ্যাকুইনাস হলেন পরবর্তী কালের এক বিশিষ্ট সামন্তবাদের সমর্থক দার্শনিক। তাঁর মতবাদে বৈষয়িক জীবনের উপর বিশেষ প্রাধান্য প্রদান পরিলক্ষিত হয়। অ্যাকুইনাস স্বতন্ত্র কর্তৃত্বের এলাকায় রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সামন্তবাদী দার্শনিক অ্যাকুইনাসের মতবাদ সুসংহত সামন্ত সমাজের সহায়ক ছিল। মানবসবাজের ক্রমবিকাশের ধারায় কালক্রমে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পতন ও ধনতান্ত্রিক সমাজের পতনের ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রক্ষমতা বুর্জোয়া শ্রেণীর দখলে আসে। পুঁজিবাদী সমাজ সভ্যতার বিকাশের ধারার সূত্রপাত ঘটে। এই রকম ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বুর্জোয়া দার্শনিকেরা পুঁজিবাদের জয়গানে মুখরিত হল। তাঁরা সহায়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শের সাহায্যে পুঁজিবাদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন।

অতএব এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, যে-কোন সমাজের প্রাধান্যকারী ধ্যান-ধারণাগুলি সমকালীন প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য লাভ করে থাকে। এবং এই সমস্ত ধ্যান-ধারণা সংশ্লিষ্ট সমাজটিকে সংরক্ষণের সহায়ক বলে প্রতিপন্ন হয়। আর্থনীতিক সম্পর্কধারাই সামাজিক স্থিতাবস্থার মূলে ক্রিয়াশীল থাকে। এই কারণে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণাসমূহের উদ্দেশ্য হল বিদ্যমান আর্থনীতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা ও অধিকতর বিকশিত করা। এইভাবেই প্রভুত্বকারী শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের স্বার্থ সংরক্ষিত ও বিকশিত হওয়ার স্থায়ী ব্যবস্থা হয়ে থাকে। সুতরাং সামগ্রিক ও চূড়ান্ত বিচারে শ্রেণীর প্রাধান্য-প্রতিপত্তিরই অপরিহার্য অন্যতম উপাদান হল সমকালীন ধ্যান-ধারণা ও মতাদর্শের প্রাধান্য।

প্রকৃত প্রস্তাবে প্রত্যেক যুগে বিশেষ ধরনের আর্থনীতিক উপাদান ও তা থেকে অনিবার্যভাবে সমাজের গঠনব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। এবং তা সংশ্লিষ্ট যুগের রাজনীতি ও চিন্তাধারার ইতিহাসের বনিয়াদ হিসাবে বিবেচিত হয়। নির্দিষ্ট কোন সমাজব্যবস্থায় জীবনযাত্রার পদ্ধতির যে ব্যবস্থা বর্তমান থাকে তদনুসারে গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট সমাজের চিন্তা-চেতনা, রাজনীতিক ধ্যান-ধারণা, মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় বিভিন্ন পর্যায়ে জীবনধারণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরন বা প্রকরণ পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে ভাবধারা ও মতাদর্শের যুগ-বৈচিত্র্য দেখা দেয়; সমাজ-বিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শ ও বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান পরিলক্ষিত হয়।