সূচনা: মধ্যযুগে চার্চ এবং পােপতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক চার্চের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যে ধর্মসংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হয় তা প্রতি ধর্মসংস্কার (counter-reformation) বা ক্যাথলিক ধর্মসংস্কার (catholic-reformation) নামে পরিচিত। মূলত ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

[1] প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য

  • বিরােধীদের প্রতিরােধ: লুথার, ক্যালভিন ও অ্যানাব্যাপটিস্টদের চার্চবিরােধী মতবাদের প্রসার রােধ করাই ছিল প্রতি-ধর্মসংস্কারের মূল উদ্দেশ্য। এককথায়, ক্যাথলিক চার্চের বিরােধীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্য নিয়েই গড়ে উঠেছিল এই ধর্মসংস্কার আন্দোলন।

  • চার্চতন্ত্রের ঐক্যরক্ষা: ধর্মসংস্কার আন্দোলনই প্রথম চার্চের ঐক্য বিনষ্ট করে এবং চার্চতন্ত্রে ভাঙন ধরাতে সফল হয়। তাই চার্চতন্ত্রের ঐক্য রক্ষা করা জরুরি হয়ে ওঠে।

[2] প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

  • প্রােটেস্ট্যান্টদের বিভাজন: পােপ তথা চার্চের আধিপত্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ধর্মসংস্কার আন্দোলনও ঐক্যবদ্ধ ছিল না। তা লুখারপন্থী, জুইংলিপন্থী এবং ক্যালভিনপন্থী—এই তিনটি আলাদা আলাদা গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। এই সুযােগে রােমান ক্যাথলিকগপ পুনরায় সংঘবদ্ধ হন এবং প্রতি ধর্মসংস্কার আন্দোলন গড়ে তােলেন।

  • পােপদের পরিবর্তনমূলক ভূমিকা: ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ধাক্কায় রােমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসীদের দাবির ফলে পােপতন্ত্রের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে এবং রােমান চার্চের সংস্কার প্রচেষ্টা গতিশীল হয়ে ওঠে। রােমান চার্চকে আবার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গৃহীত হয়।

  • পােপ ও যাজকদের নৈতিক উন্নতির প্রচেষ্টা: ধর্মসংস্কার আন্দোলনের আগে দীর্ঘ সময় ধরে ক্যাথলিক পােপ যাজকগণ দুর্নীতি এবং অনাচারে ডুবে থাকায় খ্রিস্টধর্মের অনুগামীগণ তাঁদের প্রতি আস্থা হারান। সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে এঁদের শুদ্ধিকরণের প্রয়ােজন অনুভূত হয়।

  • কাউন্সিল অফ ট্রেন্টের ভূমিকা: কাউন্সিল অফ ট্রেন্ট ছিল প্রকৃত অর্থে মাটিন লুথারের সঙ্গে সম্রাট পঞ্চম চার্লসের একটি মিলিত সম্মেলন। এই সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র ক্যাথলিক জগতকে ঐক্যবদ্ধ করা। কিন্তু শেষপর্যন্ত মাটিন লুথারের সঙ্গে ট্রেন্ট-এর মতানৈক্য ঘটে।

  • ক্যানিসিয়াসের গ্রন্থ: জেসুইট পণ্ডিত পিটার ক্যানিসিয়াস রচিত ‘সামারি অব ক্রিশ্চিয়ান ডকট্রিন নামে গ্রন্থটি ছিল প্রতি-ধর্মসংস্কারকদের তাত্ত্বিক প্রেরণার উৎস।

[3] প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:

  • [i] ‘ক্যাথলিক কাউন্টার রিফরমেশন এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পােপতন্ত্র ও চার্চতন্ত্র বিরোধীদের চিহ্নিত করে তাদের ধ্বংস সাধন করা।
  • [ii] কাউন্সিল অব ট্রেন্ট প্রােটেস্ট্যান্ট ‘বিশ্বাসতন্ত্র’-কে বাতিল ঘােষণা করে।
  • [iii] ক্যাথলিক চার্চের নানান আচার-অনুষ্ঠান (sacraments) আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করার উপদেশ প্রচারিত হয়।
  • [iv] ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে চার্চের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকাকে আরও বেশি করে প্রচার করা শুরু হয়। বলা হয়, ধর্মশাস্ত্রের মতাে চার্চের নিয়ম, নীতি ও বিধিগুলিও অলঙ্ঘনীয়।

[4] প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রসার

  • জেসুইটদের সাহায্য গ্রহণ: ষােড়শ শতকের জেসুইট সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন ইগনেসিয়াস লয়ােলা। জেসুইটরা একটি সনদ তৈরির মাধ্যমে প্রােটেস্ট্যান্টদের বিরােধিতার সিদ্ধান্ত নেয়। জেসুইটরা প্রােটেস্ট্যান্টদের বিরোধিতার লক্ষ্যে আদি খ্রিস্টধর্মের পবিত্রতার কথা প্রচার করেন ও রােমান চার্চকে রক্ষা করার আহ্বান জানান। জেসুইটদের দৃঢ়তায় ব্যাভেরিয়া, বােহেমিয়া, হাঙ্গেরি, স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পােল্যান্ডে প্রতি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রসার লাভ ঘটে।

  • ইনকুইজিশন: ‘ইনকুইজিশন ছিল মূলত একটি বিচারসভা। ক্যাথলিকগণ প্রােটেস্ট্যান্টদের হত্যা করার কাজে ইনকুইজিশনকে ব্যবহার করেছিল। পােপতন্ত্র, চার্চন্ত্র বা বাইবেল বিরােধীদের ইনকুইজিশন অপরাধী সাব্যস্ত করত ও তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিত। স্পেন, পাের্তুগাল, ইংল্যান্ড এবং ইউরােপের ক্যাথলিক-প্রধান দেশগুলিতে ইনকুইজিশন ব্যবস্থা কার্যকর করা শুরু হয়।

  • ইনডেক্স: ‘ইনডেক্স’ হল পােপতন্ত্রবিরােধী ও ক্যাথলিক ধর্মবিরােধী নিষিদ্ধ গ্রন্থ-তালিকা। এই ধরনের গ্রন্থ রচনাকারীদের চিহ্নিত করে, তাদের নাম ও ঠিকানা তালিকাবদ্ধ করা হত। তারপর তাদের ইনকুইজিশন আদালতে আনা হত। পােপ চতুর্থ পল ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে ও ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে ইনডেক্স প্রস্তুত ও প্রকাশ করেন।

[5] প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল

  • জেসুইটদের উত্থান: প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে জেসুইটদের উত্থান ঘটে। জেসুইটদের সংগঠন ‘সােসাইটি অব জিসাস’ কালক্রমে ইউরােপের এক উল্লেখযােগ্য খ্রিস্টান সংগঠনের রূপ নেয়।

  • প্রােটেস্ট্যান্টবাদের প্রসার রােধ: ফ্রান্স, স্পেন, ইটালি, পােল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চিন, ভারত, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এমনকি পূর্ব ইউরোপে প্রতি ধর্মসংস্কারের অনুপ্রবেশের ফলে প্রােটেস্ট্যান্টবাদের প্রসার রােধ হয়।

  • ক্যাথলিক-প্রােটেস্ট্যান্ট সংঘর্ষ: ফ্রান্স-সহ ইউরোপের নানা জায়গায় ক্যাথলিক-প্রােটেস্ট্যান্ট সংঘর্ষ বাঁধে। ভাসি, বার্থলেমিস্ট ইত্যাদি অঞ্চলের দাঙ্গায় নিহত হয় কয়েক হাজার নিরপরাধ মানুষ।

মূল্যায়ন: প্রতি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম চার্চ ও পােপদের জুটিবিচ্যুতিগুলি শুধরে নেওয়ার উদ্যোগ গৃহীত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইউরােপে খ্রিস্টধর্ম এক নবসমন্বয়ের পথে অগ্রসর হয়।