প্রতিহার বংশ:

অষ্টম শতকের গোড়ার দিকে প্রতিহার রাজবংশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সূচনা হয়। সাধারণভাবে এরা গুর্জর প্রতিহার নামে পরিচিত। শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী প্রতিহার হল গুর্জরদেরই একটি শাখা। এই প্রতিহারবংশীয় রাজারা বিভিন্ন শিলালিপিতে নিজেদের সূর্যবংশীয় বলে দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা হলেন রামচন্দ্রের ভ্রাতা লক্ষ্মণের বংশধর। কিন্তু এই দাবির কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ প্রথমত, সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধে ভারতে হুন আক্রমণের সময় গুর্জররা একটি বহিরাগত জাতি হিসেবে ভারতে প্রবেশ করে এবং পাঞ্জাবের মধ্যে অগ্রসর হয়ে আরাবল্লী পর্বতের পশ্চিমে যোধপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। অঞ্চলটির বর্তমান নাম রাজপুতানা, মুসলিম আমল থেকে প্রচলিত। কিন্তু তার বহু পূর্বে এ অঞ্চলের নাম ছিল গুর্জরট্রা (বর্তমানে গুজরাট)। দ্বিতীয়ত, ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে রচিত কোনো ভারতীয় গ্রন্থে গুর্জরদের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। হর্ষবর্ধনের উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তারের সময়েও এই বংশের ‘প্রতিহার’ নামক একটি শাখা এ অঞ্চলে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। এ কারণে অনেক সময় সমগ্র রাজ্যবংশকেই ‘গুর্জর-প্রতিহার’ বলে অভিহিত করা হয়।

গুর্জরবংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিচন্দ্র/ হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী অনুযায়ী তাঁর রাজধানী ছিল ভিনমাল নামক স্থানে। এই বংশেরই প্রতিহার শাখার এক রাজা প্রথম নাগভট্ট (৭২৫-৭৪০ খ্রিঃ) রাজপুতানা অঞ্চল থেকে সরে গিয়ে মালবে এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী। প্রথম নাগভট্ট সিন্ধু অঞ্চলে আরবদের আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং গুজরাট ও রাজপুতানার কিছু কিছু অঞ্চলও নিজ অধিকারভুক্ত করেন। এই বংশের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য নরপতি বৎসরাজ। তাঁর সময় থেকেই ভারতে ত্রিশক্তি সংঘাতের শুরু হয়।

অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে ভারতে যে তিনটি প্রধান শক্তির উত্থান ঘটেছিল, তারা হল গুর্জর প্রতিহারবংশ, পালবংশ এবং রাষ্ট্রকুটবংশ। যথাক্রমে পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে রাজত্বকারী এই তিনটি রাজশক্তির মধ্যে ত্রিপাক্ষিক দ্বন্দ্বই ভারতের ইতিহাসে ‘ত্রিশক্তি-দ্বন্দ্ব’ নামে খ্যাত। এই বৈরিতার মূল লক্ষ্য ছিল কনৌজের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা। হর্ষবর্ধনের সময় থেকেই কনৌজ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে স্থাপিত হয়। হর্যের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগে এই তিনটি শক্তিই কনৌজকে নিজ অধিকারভুক্ত করে সমগ্র উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। এ কারণে প্রায় একশো বছর ধরে গুর্জর, পাল ও রাষ্ট্রকূটরা বংশানুক্রমিকভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। গুর্জর-প্রতিহারদের পক্ষে এই সংঘাতে প্রথম অংশগ্রহণকারী রাজা ছিলেন বৎসরাজ।

গুর্জর-প্রতিহারদের পরবর্তী রাজা বৎসরাজ (৭৭৫-৮০০ খ্রিঃ) পশ্চিম ও মধ্য-ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রভুত্ব বিস্তার করেন। একই সময়ে পূর্ব ভারতে পালবংশীয় রাজারাও একটি শক্তিশালী রাজশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বৎসরাজ পূর্বে রাজ্যবিস্তার করতে চাইলে গৌড়ের রাজা ধর্মপালের সাথে তার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের সময় ও স্থান সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে আর. সি. মজুমদারের মতে, গঙ্গা-যমুনার দোয়াব অঞ্চলেই সম্ভবত এই দুই শক্তির সংঘাত বাধে। এই যুদ্ধে বৎসরাজ ধর্মপালকে পরাজিত করেন, কিন্তু তাঁর এই বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব বৎসরাজকে পরাজিত করেন ও তাঁকে রাজপুতানায় বিতাড়িত করেন। ফলে বৎসরাজ তাঁর হারানো ক্ষমতা ফিরে পেলেন, আবার কনৌজও ধর্মপালের অধীনে থেকে গেল। তবে এ সময় থেকেই ‘ত্রিশক্তি সংঘাত’ দীর্ঘস্থায়ী হতে শুরু করল।

রাজশক্তিগুলির ক্রমিক ক্ষমতার হস্তান্তর এবং উত্থান-পতনের মাঝে কোনো একটি শক্তি দ্বারা উত্তর ভারত নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রকুটরা গুর্জরদের পরাজিত করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের শক্তিকে নির্মূল করতে পারেনি। বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট (৮০০-৮২৫ খ্রিঃ) প্রতিহারবংশের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি প্রথমে সিন্ধু, অন্ধ্র, বিদর্ভ ও কলিঙ্গরাজ্যের ওপর নিজ আধিপত্য বিস্তার করে নিজেকে শক্তিশালী করে তোলেন। এরপর তিনি কনৌজে অবস্থিত ধর্মপালের প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে আক্রমণ করেন এবং পরাজিত করে কনৌজ অধিকার করেন। এমতাবস্থায় ধর্মপালের সাথে দ্বিতীয় নাগভট্টের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুঙ্গেরের কাছে এক যুদ্ধে তিনি ধর্মপালকে পরাজিত করেন এবং অতি দ্রুত মালব, কীরাট, বৎস, মৎস্য প্রভৃতি রাজ্য জয় করেন। কিন্তু তার এই জয়ও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ বুন্দেলখণ্ডের যুদ্ধে দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেন এবং কনৌজ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। যদিও রাষ্ট্রকুটবাহিনী ফিরে গেলে নাগভট্ট আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তবে কনৌজের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার স্বপ্ন সফল হয়নি। নাগভট্টের রাজ্যসীমা পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে বাংলার সীমা অবধি বিস্তৃত ছিল।

নাগভট্টের পুত্র রামভদ্র গুর্জরদের পরবর্তী রাজা হলেও তাঁর আমলে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। রামভদ্রের পর (আনুমানিক ৮৩৬ খ্রিঃ) তাঁর পুত্র মিহিরভোজ বা প্রথমভোজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ যোদ্ধা ও সমরকুশলী সেনানায়ক এবং এই বংশের শ্রেষ্ঠ নরপতি। সিংহাসনে বসার অব্যবহিত পরেই প্রতিহারবংশের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি ‘গুজরাত্রা’র (মধ্য ও পূর্ব রাজপুতানা) ওপর প্রতিহারদের কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করেন। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে তাঁর অধীনস্থ সামন্তরাজাদের আনুগত্য ও সহযোগিতা বিশেষভাবে কার্যকরী ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলার পালরাজা দেবপালের সামনে এসে মিহিরভোজের বিজয়রথ সাময়িকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাষ্ট্রকূট রাজ্য আক্রমণ করেও প্রতিহাররাজ পরাজিত হন। অবশ্য রাষ্ট্রকূটদের লিপিতে মিহিরভোজের প্রশংসা দেখা যায়। মিহিরভোজ ‘পৃথিবীর সকল অঞ্চল জয় করেছেন’—এমন উল্লেখ কার্যত যোদ্ধা ও রাজ্যের সংগঠক হিসেবে মিহিরভোজের খ্যাতি প্রতিষ্ঠা করে। অবশ্য পাল, রাষ্ট্রকুট ও কলচুরিদের হাতে পুনঃপুন পরাজয়ের ফলে এই সময় প্রতিহারদের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকাংশে শিথিল হয়েছিল।

তবে যুদ্ধে পরাজিত হলেও মিহিরভোজ উদ্যম হারাননি। দ্বিতীয় দেবপালের মৃত্যু এবং দুর্বল উত্তরাধিকারদের সিংহাসনারোহণ তাঁর সামনে নতুন সুযোগ এনে দেয়। অন্যদিকে একই সময়ে রাষ্ট্রকুটদের সিংহাসনে বসেছিলেন অমোঘবর্ষ। অমোঘবর্ষ তাঁর পূর্বসুরি রাজা ধ্রুব বা তৃতীয় গোবিন্দর মতো সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন। এই অনুকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সদব্যবহার করেন মিহিরভোজ। চেদিরাজের সহায়তায় দেবপালের অযোগ্য ও দুর্বল উত্তরসূরিদের পরাজিত করেন। অপরপক্ষে, ভাগ্য তাকে অন্যভাবেও সহায়তা করেছিল। রাষ্ট্রকুটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ এই সময় চালুক্যদের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধে রত ছিলেন। এই সুযোগে মিহিরভোজ দ্বিতীয় কৃষ্ণকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন ও মালব অধিকার করেন। পরে দ্বিতীয় কৃষ্ণ বহু সংগ্রাম করেও সমগ্র কাথিয়াওয়াড় উপকূলকে মিহিরভোজের অধিকার থেকে মুক্ত করতে পারেননি। এইভাবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির সাথে জয়লাভ করে মিহিরভোজ প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে তার আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হন। দাক্ষিণাত্যে পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ধ্রুবের সাথে পরাজিত হয়ে রাজ্যবিস্তারের বাসনা ত্যাগ করতে হলেও কনৌজের ওপর তাঁর স্থায়ী অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল। আরবীয় পর্যটক সুলেমান মিহিরভোজের সামরিক শক্তি ও শাসনব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে, মিহিরভোজের অশ্ববাহিনী সমগ্র ভারতে ছিল অপরাজেয়। আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেও ভোজ আরবরাজের প্রশংসা করেছেন। ভোজের রাজকোষ অর্থসম্পদে ভরা ছিল। তখন সোনা ও রূপার গুড়ো দিয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন চলত। দেশে সোনা ও রূপার খনি ছিল। কিন্তু চুরি-ডাকাতির ভয় ছিল খুব কম। তাঁর রাজ্য সমগ্র কাথিয়াবাড়, উত্তর পশ্চিমে পাঞ্জাব, পূর্বে গোরক্ষপুর এবং সম্ভবত অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

প্রথম ভোজের পর তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী পুত্র প্রথম মহেন্দ্রপাল সিংহাসনে বসেন (৮৮৫ (৯১০ খ্রিঃ)। তিনি যে তাঁর পিতার বিশাল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতাকে রক্ষা করেছিলেন তাই নয়; বাংলার পালবংশীয় রাজা নারায়ণ পালকেও পরাজিত করে মগধ ও উত্তরবঙ্গের কিয়দংশ এই বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’তে কিছুটা অস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, মিহিরভোজ পাঞ্জাবের যে সকল অঞ্চল দখল করেছিলেন, তার একাংশ এই সময় কাশ্মীরের রাজা শংকর বর্মন পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এই দাবি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন লিপির সাক্ষ্য থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি পূর্ব সীমান্তে রাজ্য সম্প্রসারণে যথেষ্ট সফল ছিলেন। বিহার ও উত্তরবঙ্গে তাঁর আমলের সাতটি লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব লিপির তারিখ থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি মগধকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন এবং উত্তরবঙ্গের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এ ছাড়া ঝাঁসি, কাথিয়াবাড়, অযোধ্যা, পূর্ব পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে আবিষ্কৃত বিভিন্ন লিপি থেকে পণ্ডিতদের অনুমান যে, মহেন্দ্রপালের আমলে প্রতিহার সাম্রাজ্য পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত এবং উত্তর-দক্ষিণে হিমালয় থেকে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। উপরন্তু এই সময় উত্তর ভারতে গুর্জর-পাল-রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে যে ত্রিশক্তি সংঘাত প্রায় একশো বছর ধরে চলে আসছিল, তার অবসান ঘটে। প্রথম মহেন্দ্রপাল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘কপুর মঞ্জরী’ নাটক ও ‘কাব্য-মীমাংসা’ নামক সমালোচনা গ্রন্থের লেখক রাজশেখর তাঁর সভাকবি ছিলেন।

মহেন্দ্রপালের পর তাঁর দুই পুত্র দ্বিতীয় ভোজও মহীপাল পর্যায়ক্রমে সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় ভোজ অল্পদিন সিংহাসনে বসেছিলেন। মহীপালের রাজত্বকালের (৯১২-৮৮ খ্রিঃ) প্রথমার্ধে প্রতিহারবংশের গৌরব অক্ষুণ্ণ ছিল—একথা সভাকবি রাজশেখর এবং আরব পর্যটক আলমাসুদির বর্ণনায় পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর আমল থেকেই প্রতিহারদের সঙ্গে রাষ্ট্রকুটদের দ্বন্দ্ব আবার তীব্রতর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় ইন্দ্রের কাছে মহীপাল সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন ও কনৌজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যদিও ইন্দ্র কনৌজে স্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেননি এবং তিনি দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাবার পর মহীপাল হৃতশক্তি পুনরুদ্ধারের সচেষ্ট হন। কিন্তু তিনি কতদূর সফল হয়েছিলেন বলা যায় না। পণ্ডিত রাজশেখর মহীপালের রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মেলক, মুরল, কেরল, কুলুট, কলিঙ্গ, কুত্তল প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠী মহীপালের পদানত হয়েছিল। সমগ্র উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের একাংশ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। রাজশেখর তাঁকে প্রতিহার বংশের মণিমুক্তার সাথে তুলনা করে আর্যাবর্তের ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মহীপাল রাষ্ট্রকুটদের হাত থেকে হৃত রাজ্যাংশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা, সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তবে সমকালীন সাহিত্যে প্রাপ্ত তথ্যাবলি থেকে অনুমিত হয় যে, মহীপালের রাজত্বের শেষদিকে তাঁর সাম্রাজ্য পূর্বে বারাণসী থেকে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত এবং দক্ষিণে চান্দেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

মহীপালের পরবর্তী প্রতিহাররাজ ছিলেন বিনায়কপাল। তিনি ৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর পর দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল, দেবপাল, দ্বিতীয় বিনায়কপাল, দ্বিতীয় মহীপাল আরও কয়েকদশক রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এঁরা ছিলেন দুর্বল ও অযোগ্য শাসক। ফলে প্রতিহার রাজ্য তার অতীত গৌরব আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। ফলে রাজপুত সামস্তরা একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকে এবং প্রতিহার শক্তি ক্রমে ক্রমে দুর্বল হয়ে ধ্বংসের পথে এগোতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলা, চেদির কলচুরি, মালবের পারমার ও গুজরাটের চালুক্য বংশ। অধিকন্তু রাষ্ট্রকুটরা আবার আঘাত হানে ও তৃতীয় কৃষ্ণের নেতৃত্বে তারা কালাপ্পুর ও চিত্রকূট দুর্গ অধিকার করে। মহীপালের উত্তরাধিকারীগণ ছিলেন দুর্বল। এত প্রতিকূলতার সাথে সাম্রাজ্য রক্ষা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশেষে সুলতান মামুদের আক্রমণে ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে কনৌজ লুণ্ঠিত হলে প্রতিহার শক্তির চূড়ান্ত অবসান ঘটে।

হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর যে সমস্ত রাজশক্তি উত্তর ভারতের অখণ্ডতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে গুর্জর-প্রতিহাররাই ছিল প্রধান। প্রতিহার রাজারা প্রায় এক শতাব্দী ধরে আরব আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করেন। আরব পর্যটক সুলেমানের মতে, “ভারতে প্রতিহার রাজাদের মতো ইসলামের প্রবল শত্রু আর কেউ ছিল না।” প্রতিহার রাজারা ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম ও শিক্ষাসংস্কৃতির রক্ষক ও পৃষ্ঠপোষক। তাদের সময়েই ভারতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ ঘটে। প্রতিহারবংশের আমলেই ভারতে রাজপুত-জাতির আবির্ভাব ঘটে, যারা সুদীর্ঘকাল ভারতের বিভিন্ন শক্তিদ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

পল্লব বংশ :

দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতনের পর সেই ধ্বংসস্তূপের উপর কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সাতবাহন সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ অধিকার করেছিল পল্লবগণ। তারা পেন্নার ও বেল্লার নদীর মধ্যবর্তী তোওমমণ্ডলামে রাজত্ব করত, যার রাজধানী ছিল কাঞ্চীপুরম্।

পল্লববংশের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। যেমন—প্রথমত, তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের তামিল সঙ্গম সাহিত্যে বা অশোকের লেখতে পল্লবদের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। পল্লবদের প্রাচীন লেখগুলি স্থানীয় তামিল ভাষার পরিবর্তে, প্রথমে প্রাকৃত ও পরে তামিল ভাষায় রচিত হয়েছিল। তাদের শাসনব্যবস্থার সাথে অর্থশাস্ত্র নির্ভর সাতবাহনদের শাসনব্যবস্থার বিশেষ মিল দেখা যায়। এইসব কারণে জয়সোয়াল অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, পল্লবগণ ছিল উত্তর ভারতের অধিবাসী। দ্বিতীয়ত, রাইসের মতে, পল্লবগণ পহ্লব বা পার্থিয় বংশোদ্ভূত। পরবর্তীকালে ফাদার হেরস এ মত সমর্থন করেছেন। দুব্রেইল বলেছেন যে, পল্লবগণ ছিল রুদ্রদামনের পার্থিয় মন্ত্রী সুচিশাখের বংশধর। কিন্তু প্রাচীন পল্লব লেখ থেকে জানা যায় যে, পল্লবগণ ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্রীয়। তাই তাঁরা পার্থিয় বংশোদ্ভূত ছিলেন, একথা মেনে নেওয়া যায় না। তৃতীয়ত, ড. কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গারের মতে, পল্লবগণ ছিলেন দক্ষিণ ভারতের আদি বাসিন্দা। চোলবংশীয় পিতা ও নাগবংশীয় মাতার বংশধর ছিলেন পল্লবগণ। কিন্তু সেক্ষেত্রে পল্লবদের প্রথম দিককার লেখতে স্থানীয় তামিল ভাষা ব্যবহৃত না হবার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না। চতুর্থত, রলিনসন, সাতাইনাথাইয়ার প্রমুখের মতে, পল্লবগণ ছিল তোণ্ডোমোওলম্-এর বাসিন্দা। অশোকের লেখতে এদের ‘পুলিন্দ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এরা সাতবাহনদের অধীনস্থ নরপতি থাকার সময়ে প্রাকৃত ভাষা ও উত্তর ভারতীয় রীতি-নীতি সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করে। তারপর সাতবাহনদের অবনতির সুযোগে এরা স্বাধীন হয়ে যায়। পঞ্চমত, মহালিঙ্গম্ উক্ত মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, পল্লব শব্দের সাথে পুলিঙ্গ শব্দের সম্পর্ক নেই। তিনি মনে করেন, পল্লবদের উৎপত্তির ইতিহাস তাদের ভরদ্বাজ গোত্রের মধ্যে নিহিত আছে। দক্ষিণ ভারতীয় সালঙ্কায়ণ রাজবংশেরও গোত্র ছিল ভরদ্বাজ। এদেরও প্রথমদিকের লেখগুলির ভাষা প্রাকৃত, পরের দিকের ভাষা সংস্কৃত। উভয় বংশের রাজাদের নাম, শাসন-পদ্ধতি ইত্যাদিতেও যথেষ্ট মিল রয়েছে। তাই তিনি মনে করেন যে, পল্লবগণ ও সালঙ্কায়ণগণ একই বংশ থেকে উদ্ভূত। তবে এতগুলি মতের কোনটিকেই সম্পূর্ণ সঠিক বলে ধরা যায় না। তাই পল্লবদের বংশপরিচয় সম্পর্কে ইতিহাস এখনো ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন (“The origin of the Pallavas remained till now a mystery.)”

পল্লবদের রাজনৈতিক ইতিহাস দুটি পর্বে বিভক্ত। যে আদি পল্লবরাজারা প্রাকৃত লিপি ব্যবহার করতেন তাঁরা ২৫০ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সংস্কৃতি লিপি ব্যবহারকারী রাজারা ৩৫০ থেকে ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এঁদের মধ্যে বিষ্ণুগোপ (যাঁকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেন), অশ্বমেধ যজ্ঞকারী শিবস্কন্দবর্মন, বীরকুর্চ, স্কন্দশিষ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় সিংহ বর্মন প্রমুখের নাম জানা যায়।

৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে রাজা সিংহবিষ্ণুর নেতৃত্বে পল্লববংশের ঐতিহাসিক অগ্রগতির সূচনা হয়। তিনি চোলরাজ্য-সহ দাক্ষিণাত্যের বহু রাজ্য জয় করেন। সিংহলরাজ্যও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। কৃষ্ণা থেকে কাবেরী পর্যন্ত ভূভাগে তাঁর আধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল। তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের মত্তবিলাস প্রহসনে তাঁর সম্পর্কে অনেক উচ্চ প্রশংসার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সংস্কৃত কবি ভারবীর পৃষ্ঠপোষক। মহাবলীপুরমে তাঁর ও তাঁর দুই রানীর যে আলেখ্য পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয় তিনিই ঐ স্থানকে শিল্পচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ নেন।