প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই হল প্রকৃত বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। বর্তমান বৃহদায়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্রে নানা কারণে এ ধরনের গণতন্ত্র অসম্ভব বলে প্রতিনিধিত্বমূলক বা পরোক্ষ গণতন্ত্রের ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে এই প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থাকেই বোঝায়। শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা গঠিত হয় এবং তাঁদের তত্ত্বাবধানেই শাসনকার্য পরিচালিত হয়। সেইজন্য আধুনিক গণতন্ত্রে ভোটদাতাদের সঙ্গে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রতিনিধি ভোটদাতাদের এজেন্ট: গণতন্ত্রে নির্বাচক ও নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কি রকম হবে সে বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। একটি মত হল প্রতিনিধিরা ভোটদাতাদের ইচ্ছার অনুপন্থী ভূমিকা পালন করবেন। ভোটদাতাদের প্রতিভূ হিসাবে তিনি তাদের নির্দেশের বাইরে বা বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। অর্থাৎ তিনি নির্বাচনী এলাকার এজেন্ট বা মুখপাত্র হিসাবে কাজ করবেন। জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রবক্তা ফরাসী দার্শনিক রুশো (Rousseau)-র তত্ত্বে এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। সার্বভৌম জনগণের রাষ্ট্রকার্যে অংশগ্রহণের ক্ষমতা বলতে তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার কথাও বুঝিয়েছেন। এই মতের সমর্থকদের মতানুসারে গণতন্ত্রে জনগণই হল সার্বভৌম। জনগণের সার্বভৌমত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
(১) প্রতিনিধিরা নির্বাচকদের এজেন্ট মাত্র নন: এই মতের বিরুদ্ধে অনেকে বলেন যে প্রতিনিধিরা নির্বাচকদের আদেশবাহক হিসাবে গণ্য হলে তাঁদের পক্ষে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না। এডমণ্ড বার্ক (Edmund Burke) উপরিউক্ত ধারণার বিরোধিতা করে বলেছেন যে, আইনসভার সদস্যগণ ভোটদাতাদের প্রতিভূ নন, প্রতিনিধি (…..a member of Parliament is a representative and not a delegate.”)। তাঁর মতে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ তাঁদের জ্ঞানবুদ্ধি মত দেশের সামগ্রিক স্বার্থসাধনে আত্মনিয়োগ করবেন। নিজের নির্বাচন এলাকার স্বার্থসাধন বা ভোটদাতাদের সন্তুষ্টি বিধান প্রতিনিধিদের মুখ্য উদ্দেশ্য হবে না। নির্বাচনী এলাকার স্বার্থের তুলনায় জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব অনেক বেশী। তাই নির্বাচিত প্রতিনিধি সমগ্র দেশবাসীর সাধারণ কল্যাণ ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিচারবুদ্ধি অনুসারে স্বাধীনভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন।
(২) অযৌক্তিক: প্রতিনিধিরা সাধারণ ভোটদাতাদের তুলনায় অধিকতর বিবেক-বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একথা অস্বীকার করা যায় না। ল্যাস্কির মতে নিজের বিবেক ও বুদ্ধি অনুসারে ভাল কাজ করার জন্য প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। সুতরাং রাজনীতিক জ্ঞান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিনিধিরা সাধারণত ভোটদাতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন, এই ব্যবস্থা অযৌক্তিক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অনিয়মতান্ত্রিক (“….unwarranted, inconsistent and unconstitutional”-Leiber) |
(৩) বাস্তব অসুবিধা: জন-নিয়ন্ত্রণ নীতি অবাস্তবও বটে। কারণ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচনী এলাকার বিপুল সংখ্যক নির্বাচকের মতামত সর্বদা গ্রহণ করা এক অসম্ভব ব্যাপার। কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন বিশেষ সমস্যা সম্পর্কে নির্বাচকমণ্ডলীর সামগ্রিক মতামত সংগ্রহ ও প্রয়োগ করা কঠিন ব্যাপার। অর্থাৎ নির্বাচকমণ্ডলীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করার বাস্তব অসুবিধা আছে।
(৪) যোগ্য ব্যক্তিরা প্রতিনিধি হবেন: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকলাপের স্বাধীনতা না থাকলে যোগ্য এবং মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রতিনিধি হতে চাইবেন না। তার ফলে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সেবা থেকে জনসাধারণ বঞ্চিত হবে। আইনসভার উৎকর্যের হানি ঘটবে। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতে প্রতিনিধিরা নিজেদের বিচার বুদ্ধি অনুসারে স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করবেন।
(৫) নীতিবিরুদ্ধ: নৈতিক দিক থেকেও এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না। কারণ একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা ও বিশ্বাসকে নির্বাচকমণ্ডলীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে বিসর্জন দিতে বলা নিতান্তই অনৈতিক।
(৬) পরস্পর বিরোধী স্বার্থ ও আইন: এই ব্যবস্থায় প্রতিনিধিরা সংকীর্ণ স্থানীয় স্বার্থ ও মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেবেন। এবং তারা যে যার নির্বাচনী এলাকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরস্পর-বিরোধী আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হবেন। তার ফলে আইনসভা পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের এক রণক্ষেত্রে রূপান্তরিত হবে।
(৭) জরুরী অবস্থায় অসুবিধা: দেশে কোন সংকট সৃষ্টি হলে জরুরী প্রয়োজনে দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামত সংগ্রহ করা প্রতিনিধিদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতদ্সত্ত্বেও নির্বাচকদের মতামত সংগ্রহ করতে গেলে যে কালক্ষেপ হবে তাতে জাতীয় স্বার্থের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
আগের মত এখন প্রতিনিধিরা আর এজেন্ট হিসাবে গণ্য হন না: প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ার গোড়ার দিকে প্রতিনিধিদের নির্দিষ্ট শ্রেণী বা গোষ্ঠীর এজেন্ট হিসাবে তাদের নির্দেশমত কাজ করতে হত। নির্বাচকমণ্ডলীর নির্দেশ পালনে অক্ষম বা অসমর্থ প্রতিনিধিকে পদচ্যুত হতে হত। গেটেল বলেছেন: “When the system of representation was first developing the representative was generally. viewed as the agent of the class or the group selected him, subject to instruc tion and to recall if he failed to carry out their wishes.” গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিকাশ ও বিস্তারের ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এজেন্ট হিসাবে গণ্য করার ধারণা পরিত্যক্ত হয়। এখন প্রতিনিধিরা নিজের বিচার-বুদ্ধি অনুসারে জাতীয় স্বার্থ ও দায়িত্ব সম্পাদনে স্বাধীনভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রে এই বিষয়টি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রতিনিধি দলের নীতি ও কর্মসূচী অনুসারে কাজ করবেন: এ বিষয়ে তৃতীয় একটি মত হল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিজ নিজ দলের নীতি ও কর্মসূচী অনুযায়ী কাজ করা উচিত। কারণ ভোটদাতারা দলীয় নীতি ও কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রার্থীদের নির্বাচিত করেন। দল-ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে প্রতিনিধিরা কোন-না কোন রাজনীতিক দলের সদস্য হয়ে থাকেন। সুতরাং দলীয় নীতি ও কর্মসূচীতে প্রতিনিধিদের আনুগত্য থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক দল নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়ী থাকবে। এ বিষয়েও ল্যাস্কি বিরূপ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিজ দলের ভৃত্য নন। তিনি বলেছেন: “A member is not the servant of a party in the majority in his constituency. He is elected to do the best he can in the light of his intelligence and his conscience.”
ল্যাস্কির মত: ল্যাস্কি আংশিকভাবে জন-নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রয়োগের পক্ষপাতী। তিনি সীমাবদ্ধ পদচ্যূতি পদ্ধতি (System of limited recall) সমর্থন করেন। তাঁর মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের মর্যাদা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাই নির্বাচিত প্রতিনিধি যাতে জনমতকে অগ্রাহ্য করতে না পারেন তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। সীমাবদ্ধ পদচ্যুতি বা নির্বাচকমণ্ডলীর দুই-তৃতীয়াংশের বিরূপ ভোটে পদচ্যুত হওয়ার আশংকা থাকলে প্রতিনিধিরা সংযত এবং জনমতের অনুবর্তী ভূমিকা পালন করতে বাধ্য থাকেন।
উপসংহার: বস্তুত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর ভোটদাতাদের কোন রকম নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, তা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ সেক্ষেত্রে প্রতিনিধিরা সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধনে উদ্যোগী হবেন এবং দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ উপেক্ষিত হবে। এই অবস্থায় গণতন্ত্র তত্ত্বসর্বস্ব ও অর্থহীন হয়ে পড়বে। তা ছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব সময় এবং সর্বক্ষেত্রে ভোটদাতাদের তুলনায় বুদ্ধি-বিবেচনা ও গুণগত যোগ্যতার বিচারে উন্নত তা বলা যায় না। এই সমস্ত কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচকমণ্ডলীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করবেন এ তত্ত্ব যেমন মেনে নেওয়া যায় না তেমনি প্রতিনিধিরা নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতকে একেবারে অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা ভোগ করবেন তাও স্বীকার করে নেওয়া যায় না। নির্বাচনে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিমত প্রতিনিধিরা কাজ করেছেন কিনা নির্বাচকরা তা নিশ্চয়ই নজর করতে পারেন। এবং প্রতিশ্রুতি পালনে অক্ষম ও অপারগ প্রতিনিধিদের পদচ্যুত করার কিছু ক্ষমতা নির্বাচকদের হাতে থাকা উচিত। তা হলে প্রতিনিধিদের জনস্বার্থ-বিরোধী ভূমিকা রদ করা যাবে এবং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষণ করা যাবে। প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের দায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদচ্যুত করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। গণ প্রজাতন্ত্রী চীন প্রভৃতি দেশে প্রতিনিধিকে পদচ্যুত করার ব্যবস্থা আছে। আবার কোন একটি দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে কোন প্রতিনিধি নিজের দল ত্যাগ করে অন্য দলে যোগ দিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে পদচ্যুত করার পদ্ধতি থাকা বাঞ্ছনীয়। এই সমস্ত দলত্যাগী প্রতিনিধিদের আবার জনসমর্থন যাচাই করতে বাধ্য করা উচিত। প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই ব্যবস্থা ইংল্যাণ্ডে প্রচলিত আছে। বর্তমানে ভারতেও দলত্যাগ-বিরোধী আইন প্রণীত হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচক-মণ্ডলীর কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকা বাঞ্ছনীয়। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “He is not entitled to get elected as a free trader and to vote at once for a protective tariff.” একটি বিশেষ নীতি ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার পর একজন প্রতিনিধিকে তাঁর মর্জিমাফিক অন্য যে কোন নীতি ও কর্মসূচীকে সমর্থন করার স্বাধীনতা ভোগ করতে দেওয়া যায় না।
Leave a comment