উদারনীতিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে সৃষ্টি:
প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রতিনিধিত্বের এই উদারনীতিক তত্ত্বের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সমষ্টিবাচক তত্ত্বের উদ্ভব হয়। উদারনীতিক তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনার উপর সমষ্টিবাচক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সমর্থকরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বকে বর্তমান রূপে হাজির করেন। বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Collectivist concepts of representation were developed in modern form by the nineteenth century European socialists.”
শ্রেণী-সংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ:
সমষ্টিবাচক তত্ত্বে সমাজের শ্রেণী-দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী-সংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। এই তত্ত্ব অনুসারে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র কার্যত সংখ্যালঘু বিত্তবান ব্যক্তিবর্গের স্বার্থ রক্ষা করে এবং শ্রেণী-শোষণের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের তত্ত্বও আইনসভাকে সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের একটি সংস্থা হিসাবে সৃষ্টি করে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক তত্ত্ব অনুসারে শ্রেণী-প্রতিনিধিত্বের (class representation) ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রতিপত্তিশালী সংখ্যালঘু শ্রেণীর প্রাধান্য আইনসভায় প্রতিষ্ঠিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব কায়েম হয়। সুতরাং প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক তত্ত্ব কার্যত বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের তত্ত্ব হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।
প্রতিনিধিদের উদারনীতিকতত্ত্বের সমালোচনা:
প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় বাছাই করা মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষিত হয় ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বের প্রকৃতি প্রসঙ্গে লেনিনের মত হল যে, বুর্জোয়া গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বলেছেন: “In capitalist society…. democracy always remains, in effect, a democracy for the minority, only for the propertied class, only for the rich.” প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্ব সম্পর্কে বল বলেছেন: “These were to reject the individualism under penning representation of the liberal theorists and to emphasise the importance of class conflict within society and the middle class liberals’ use of the state as an instrument of class oppression.”
প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
(ক) জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন: প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বের উদ্দেশ্য হল সংখ্যালঘিষ্ঠের পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্ব জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত। সমষ্টিবাচক তত্ত্ব অনুসারে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের পরিবর্তে সকলের ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়। বল বলেছেন: “Here we find an emphasis both on the sovereignty of the people and on the will of the majority.” বর্তমানে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে প্রতিনিধিত্বের এই সমষ্টিবাচক তত্ত্ব প্রবর্তিত আছে। চীনে মাও-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্ব প্রবর্তন করেছে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও সমষ্টিবাচক প্রতিনিধিত্বের তত্ত্ব স্বীকৃত ও প্রযুক্ত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে শোষণ ও অবিচারের অবসান ঘটে। সমাজতান্ত্রিক সামাজিক ভিত্তিতে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব যথার্থ ও সার্থক প্রতিনিধিত্ব হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এবং এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জনগণের সার্বভৌমত্বই প্রকৃত সার্বভৌমত্ব হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
(খ) শোষণের অবসান: প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক সমতা স্বীকৃত হয়, কিন্তু সামাজিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায়বিচারকে উপেক্ষা করা হয়। সামাজিক ও অর্থনীতিক সাম্যের অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গণতন্ত্রকে অর্থহীন করে তোলে। সকল ক্ষেত্রে সাম্যের প্রতিষ্ঠা ও শ্রেণী-শোষণের অবসান ব্যতিরেকে গণতন্ত্র সার্থক ও সফল হতে পারে না। গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সামাজিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা এবং আর্থনীতিক শোষণের অবসান অপরিহার্য। বল বলেছেন: “….social equality and the absence of economic exploitation is the yardshick of a genuine democracy.” সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে এবং যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকলে পরিপূর্ণভাবে আর্থ-সামাজিক, রাজনীতিক ও ব্যক্তিগত অধিকারসমূহ ভোগ করার সুযোগ পায়। তার ফলে সার্বিক অধিকার ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সুনিশ্চিত হয়। প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সমানাধিকার ও সর্বজনীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত হয়।
(গ) কমিউনিস্ট পার্টি: উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণী ও শ্রেণী-স্বার্থের অস্তিত্ব বর্তমান। এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণী-স্বার্থের জন্য বিভিন্ন রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব নিতান্তই স্বাভাবিক। নির্বাচনে এই সমস্ত দল রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক ও আর্থনীতিক সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকে। বিভিন্ন শ্রেণী-স্বার্থ বা শ্রেণী-শোষণ থাকে না। তার ফলে বিভিন্ন রাজনীতিক দলেরও প্রয়োজন থাকে না। তাই প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নও থাকে না। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় জনগণই হল সকল ক্ষমতার উৎস। এই ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টিই হল একমাত্র রাজনীতিক দল। এই দলই জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সামগ্রিক স্বার্থ সংরক্ষণে সক্ষম।
(ঘ) আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব: প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্বে পেশাগত বা কর্মগত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাকে সমর্থন করা হয় না। তার পরিবর্তে আঞ্চলিক বা ভৌগোলিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থাকে কাম্য বিবেচনা করা হয়।
প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বের ভিত্তিতে চার্চওয়ার্ডের অভিমত:
প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক ব্যবস্থার কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের প্রতি চার্চওয়ার্ড (L.G. Churchward) তাঁর Contemporary Soviet Government শীর্ষক গ্রন্থে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বলেছেন।
(১) প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বে গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হিসাবে গণ্য করা হয় এবং নাগরিকদের অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে তিনি পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার কথা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে চার্চওয়ার্ডের এই বক্তব্য সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। কারণ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাতি, ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ-সুবিধা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সংখ্যালঘু বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনীতিক ক্ষমতা দখলের যাবতীয় প্রতি-বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে সব রকম পথে ব্যর্থ করার উদ্যোগ-আয়োজন করা হয়। কারণ এই সংখ্যালঘু বুর্জোয়া শ্রেণী মাথাচাড়া দিতে শুরু করলে বুর্জোয়া সমাজের শ্রেণী-বৈষম্য, শ্রেণী-স্বার্থ, শ্রেণী-শোষণ প্রভৃতি আবার দুষ্ট ক্ষতের মত দেখা দিবে।
(২) উদারনীতিক গণতন্ত্রের ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ’, ‘ক্ষমতার বণ্টন’, ‘মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা’, ‘আইনের অনুশাসন’ প্রভৃতি ধারণাকে প্রতিনিধিত্বের সমষ্টিবাচক তত্ত্বের প্রবক্তারা সমর্থন করেন না।
(৩) প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্বে জনসাধারণের কাছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা, প্রতিনিধিত্বের অপসারণের ব্যাপারে জনগণের ক্ষমতা, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
(৪) প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে প্রতিনিধিত্বমূলক পরোক্ষ গণতন্ত্রের সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করা হয়। চার্চওয়ার্ড মন্তব্য করেছেন: “…it couples the concept of ‘direct democracy’ to the concept of ‘representative democracy.”
Leave a comment