প্রতিনিধিত্বের কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব হিসাবে অভিহিত করা হয় না। প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব বলতে প্রতিনিধিত্বের কতকগুলি পদ্ধতির সমন্বয়কে বোঝায়। প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত এই সমস্ত তত্ত্ব দীর্ঘকাল ধরে বর্তমান। এই সমস্ত তত্ত্বের গুরুত্ব এখনও অস্বীকার করা যায় না। প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কিত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদ যথাযথভাবে অনুধাবনের স্বার্থে এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা দরকার। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “There are a number of alternative theories that can be grouped under this heading; however it is possible to isolate the essentials of liberal democratic theories of representation.”
(ক) ব্যক্তিগত অধিকারের উপর গুরুত্ব: প্রতিনিধিত্বের উদারনীতিক তত্ত্বগুলি প্রাকৃতিক অধিকারের তত্ত্বের উপর ভিত্তিশীল। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (১৭৭৬) অনুসারে প্রত্যেকে জন্মগতভাবে সমান এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সুখী হওয়ার অধিকার সমেত অন্যান্য অধিকার অলঙ্ঘনীয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্বগুলি ব্যক্তির অধিকার এবং বিশেষ করে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। এই সমস্ত অধিকারের সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী বলে মনে করা হয়। এই মতবাদ অনুসারে মানবাধিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক অধিকার। এবং এই অধিকারে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বল বলেছেন: “Firstly, there is the emphasis on the importance of individual rights, especially the inviolability of the individual’s property and the necessity of limiting the powers of government to protect those rights. The justification of these individual rights was to be found in the theories of natural rights, rights that were beyond the competence of any government interference.” উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে ভোটাধিকারে সমতার কথাও বলা হয়। বল বলেছেন: “…liberal democracy implies not only an extension of the franchise but an equality of voting rights.” এই তত্ত্বে আরও বলা হয় যে, একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি তাঁর নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের এবং তাদের স্বার্থ ও মতামতের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি কোন বিশেষ শ্রেণী, পেশা বা স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন না। বল বলেছেন: “The representative represents individuals, their opinions and their interests and therefore he is elected according to geographically demarcated consti-tuencies, not according to classes, occupational distinctions or distinct interests.”
(খ) মানুষ যুক্তিবাদী: প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্ব অনুসারে মানুষ যুক্তিবাদী। তাই নিজের স্বার্থ ও মতামত সম্পর্কে এবং সমাজের বৃহত্তর দাবি সম্পর্কে মানুষ সচেতন। যুক্তি ও বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ ও যথার্থ প্রতিনিধি নির্বাচন করতে সমর্থ। বল বলেছেন: “….there is in liberal democratic theories of representation of a rationalist strand. Man is a creature of reason, he can identify his own interests and his own opinions, and is aware of the wider claims of the community. He will therefore use his vote in an intelligent fashion and is consequently entitled to share in the selection of representatives.” জেফারসন মার্কিন শাসনব্যবস্থার সাফল্যের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত ভোটদাতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, মানুষের যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা শিক্ষার দ্বারা সুদৃঢ় হয়। জে. এস. মিল সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রবর্তনের পূর্ব শর্ত হিসাবে সর্বজনীন শিক্ষার বিস্তারের কথা বলেছেন। বস্তুত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদের মাধ্যমে জেফারসন ও মিল মুষ্টিমেয় বাছাই করা ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সমস্ত মতবাদ হল অভিজ্ঞতাবাদী। এই সমস্ত তত্ত্বে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের তুলনায় ব্যক্তির যুক্তিবোধ ও বিচার-বিবেচনার উপর জোর দেওয়া হয়। বল বলেছেন: “Human reason is superior to historical tradition or hallowed custom, therefore political institutions and practices are to be judged empirically.”
(গ) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার: উদারনীতিক গণতান্ত্রিক তত্ত্ব অনুযায়ী জনগণের সার্বভৌমত্ব যথাযথভাবে ব্যক্ত হয় সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের মাধ্যমে। বল বলেছেন: “….the sovereignty of the people which was to be expressed through the universal suffrage.” ব্রিটেনে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ‘সংস্কারমূলক আইন’ (Reforms Acts)-এর মাধ্যমে নির্বাচকদের আয়তন বৃদ্ধি, গোপন ব্যালট পদ্ধতির প্রয়োগ, নির্বাচনের ব্যাপারে দুর্নীতি রদ, লর্ড সভার ক্ষমতা হ্রাস প্রভৃতি সম্পাদিত হয়। মনে করা হয় যে এইভাবে ব্রিটিশ সংস্কারবাদী ঐতিহ্যের সাফল্য সূচিত হয়েছে।
(ঘ) প্রতিনিধির ভূমিকার তাৎপর্য: এই তত্ত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিশেষ ভূমিকা স্বীকৃত। প্রত্যেক প্রতিনিধি তাঁর নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে দায়িত্বশীল থাকবেন। কিন্তু তাঁর ভূমিকা মনোনীত মুখপাত্র হিসাবে নির্দেশ পালন নয়। প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি অনুসারে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তবে তাঁরা নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহকে অগ্রাহ্য করবেন না। কোন একজন প্রতিনিধিকে তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রের সম্মিলিত মতামতের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। বল বলেছেন: “…he is responsible to his electorate but he is not its delegate; he represents a geographical collection of opinions, but is not required to surrender his own.”
(ঙ) সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভারসাম্য: প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্ব ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর শাসন বিভাগের অবাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণকে রদ করার পক্ষপাতী। এই উদ্দেশ্যে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বল বলেছেন: “Liberal democracy emphasises the role of the representative assembly as a protection against the encroachment of executive power, especially encroachments on the liberties of the individual.” তবে এক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। কারণ এই আইনসভা নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ইচ্ছার অনুগামী হলে সংখ্যালঘুদের ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। মার্কিন চিন্তাবিদ হ্যামিলটন (Alexander Hamilton)-এর মতানুসারে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ক্ষমতার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। তা না হলে ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটবে। কারণ মানুষ প্রকৃতিগত বিচারে ক্ষমতালিপ্স। সংখ্যাগুরু ক্ষমতাসীন হলে সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার হবে। আবার সংখ্যালঘু ক্ষমতা পেলে সংখ্যাগুরু অত্যাচারিত হবে (“Give all power to the many, they will oppress the few. Give all power to the few, they will oppress the many.”)। এ সমস্যা সম্পর্কে মিলও অবহিত ছিলেন। তাই তিনি অশিক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ঠের অকাম্য ভূমিকার আশংকায় শিক্ষিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভোটাধিকারের কথা বলেছেন। আবার মিল শিক্ষিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে বহুমুখী ভোটাধিকারের কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে মার্কিন লেখক রবার্ট ডালের বক্তব্যও উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতানুসারে রাজনীতিক সাম্য ও জনগণের সার্বভৌমত্বের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। এবং তার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি সংবিধানে স্বীকৃত হওয়া দরকার। বল তার Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে ডালের অভিমত উদ্ধৃত করেছেন। ডাল তাঁর A Preface to Democratic Theory শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “What I am going to call the Madisonian’ theory of democracy is an effort to bring off compromise between the power of majorities and the power of minorities, between the political equality of all adult citizens on the one side, and the desire to limit their sovereignty on the other. ” আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে সাধারণত সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, পেশাগত প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি ব্যবস্থাদির মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বাধীনতার সংকোচনের সম্ভাবনা প্রতিরোধের জন্য উভয়ের ক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন আবশ্যক।
(চ) অন্যান্য রূপ: প্রতিনিধিত্বের এই তত্ত্বের অন্যান্য রূপও আছে। বল এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উপযোগিতাবাদী তত্ত্ব এবং আদর্শবাদী তত্ত্বের কথা বলেছেন। উপযোগিতাবাদী বা হিতবাদীদের (utilitarians) মতানুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচকমণ্ডলীর সামাজিক দর্পণ হিসাবে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। বল বলেছেন: “There are other variations within the representative theories of liberal democracy: the utilitarian demand for representatives to constitute an exact social mirror of the electorate presents one enduring aspect of these theories;….” মিল সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব ও বিশেষ ভোটাধিকার ব্যবস্থার কথা বলেছেন। আদর্শবাদীদের (Idealists) মতানুসারে প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব হল আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সাধারণ স্বার্থের আবির্ভাবে সাহায্য করা। বল বলেছেন: “….the English idealists’ partial reaction against nineteenth century individualism in their belief that the system of representation should allow common interests to emerge after a process of discussion is another strand” f শতাব্দীতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া হিসাবে আদর্শবাদী তত্ত্বের উদ্ভব হয়।
উপসংহার: প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বমূলক উদারনীতিক গণতন্ত্র বাছাই করা কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তির শাসন হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। সামগ্রিক বিচারে প্রতিনিধিত্বের উপরিউক্ত তত্ত্বসমূহ গণ-ভিত্তিক রাজনীতিক দলের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এবং শাসন-বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বল বলেছেন: “However, these representative theories, taken as a whole, have managed to accommodate themselves to the rise of the mass party and the growth in executive power.” তিনি আরও মন্তব্য করেছেন: “…there has been a falling back on the theory that at election times voters are deciding which competing team of political leaders to support, and representative liberal democracy must be compatible with the existence of political elites.”
Leave a comment