প্রচেষ্টা ও ভুল’-এর শিখন কৌশলের প্রবক্তা হলেন মনােবিদ ই এল থর্নডাইক। তার শিখন কৌশল বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলটি বিশ্লেষণ করলে আমরা কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাই, যা তাকে শিখন কৌশলের প্রবক্তা হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই শিখন কৌশলের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
(১) আত্মসক্রিয়তা : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল প্রাণী বা শিক্ষার্থীর আত্মসক্রিয়তা। শিক্ষার্থী নিজে থেকে সক্রিয় হয়ে সমস্যার সমাধানে উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সঠিক সংযােগসাধনের জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালাবে এবং ভুল প্রচেষ্টাগুলি ত্যাগ করবে। একসময় সঠিক প্রচেষ্টা করে সমস্যার সমাধান করবে। সুতরাং চাহিদার নিবৃত্তির জন্য শিক্ষার্থী যদি নিজে থেকে সক্রিয় না হয়, তাহলে এই শিখন কৌশলটি সংগঠিত হবে না । থর্নডাইকের পরীক্ষায় বিড়ালটির মধ্যে খাদ্যের চাহিদা ছিল বলেই বাইরে আসতে সক্রিয় হয়েছিল।
(২) পুনরাবৃত্তি: থর্নডাইকের মতে, সমস্যামূলক পরিস্থিতিতে একটি উদ্দীপক ও তার সমাধান-উপযােগী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সংযােগসাধনের ফলে প্রাণীর শিখন হয়। এক্ষেত্রে উদ্দীপক ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে (S-R Connection/ Bond) গড়ে ওঠে।
(৩) উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন: প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলে প্রাণী বা শিক্ষার্থী কেন আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমে বারবার সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালাবে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যেমন – বিড়ালটির উদ্দেশ্য ছিল পাজল বক্স থেকে বেরােতে পারলেই খাদ্যবস্তু হিসেবে মাছ খেতে পারবে। এক্ষেত্রে বিড়ালটি উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল।
(৪) বহুমুখী প্রতিক্রিয়া: থর্নডাইকের শিখনতত্ত্বে একটিমাত্র উদ্দীপক থাকে। কিন্তু প্রাণী বা শিক্ষার্থীদের বহু প্রতিক্রিয়া করার সুযােগ থাকে। পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে ভুল প্রতিক্রিয়াগুলিকে তারা বর্জন করে এবং সঠিক প্রতিক্রিয়া নির্বাচন করে। যেমন- বিড়ালটির সামনে একটিমাত্র উদ্দীপক হিসেবে রাখা ছিল মাছ, কিন্তু পাজল বক্স থেকে বেরােনাের জন্য বিড়ালটিকে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করতে হয়েছে।
(৫) আংশিক প্রতিক্রিয়া: থর্নডাইকের মতে, প্রাণী যখন সমস্যামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন অংশভিত্তিক প্রতিক্রিয়া করে, সামগ্রিকভাবে করে না। অংশগুলির প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সর্ব অংশ শিক্ষার্থীর আয়ত্তে সমস্যাটির সমাধান হয়ে যায়। সুতরাং প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলে আংশিক প্রতিক্রিয়া হল একটি বৈশিষ্ট্য।
(৬) জৈব-মানসিক প্রস্তুতি: থর্নডাইকের শিখনে প্রস্তুতির সূত্রে ও মানসিক প্রস্তুতির সূত্রে জৈব-মানসিক প্রস্তুতির কথা বলেছেন। শিক্ষার্থী যদি দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে শিখন সম্ভব হবে না। যদি দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি না থাকে, তাহলে উদ্দীপক থাকলেও শিক্ষার্থী কোনােভাবে তার প্রতি প্রতিক্রিয়া করবে না।
(৭) ফললাভ: প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলে ফললাভের সূত্রের মাধ্যমে থর্নডাইক শিখনের ফলাফলের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। যে শিখন আনন্দদায়ক অনুভূতি দেয়, সেই শিখন স্থায়িত্ব লাভ করে এবং যে শিখন বেদনাদায়ক অনুভূতি দেয়, সেই শিখন শিক্ষার্থী পরিত্যাগ করে। যেমন- পাজল বক্সের বাইরে যদি নকল মাছ রাখা হত, তাহলে বিড়ালটি সঠিক প্রতিক্রিয়াটি দ্বিতীয়বার করত না। তাই ফলপ্রাপ্তি এই শিখন কৌশলের আরও একটি বৈশিষ্ট্য।
(৮) সাদৃশ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়া: এই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাণী যখন সমস্যামূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন সে পূর্বের জ্ঞাত প্রতিক্রিয়ার দ্বারা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে। থর্নডাইক তার শিখন সূত্র অর্থাৎ ‘সাদৃশ্যের সূত্রে সাদৃশ্যভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যটি তুলে ধরেছেন।
(৯) প্রচেষ্টার সংখ্যা ও সময় ক্রমহ্রাস: প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনে প্রচেষ্টার সংখ্যা ও সময় পুনরাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে হ্রাস পায়।
(১০) সর্বজনীনতা: সমস্যাসমাধানে মানুষ-সহ সমস্ত প্রাণী এই পদ্ধতির সাহায্য গ্রহণ করে।
(১১) জানা থেকে অজানা বিষয়ের দিকে যাওয়া: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের সময় শিক্ষক-শিক্ষিকরা জানা বিষয় থেকে অজানা বিষয়ের দিকে পড়ানাের পদ্ধতিকে অনুসরণ করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণে আগ্রহী হয়। ফলে পড়ানাে ও পড়া বোঝা উভয়ই সহজ হয়।
শিক্ষার্থীরা প্রচেষ্টা ও ভুলের কৌশল প্রয়ােগ করে জীবনের বিভিন্ন সমস্যামূলক পরিস্থিতির সমাধান করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় শিশুরা মানসিক ও দৈহিক তৃপ্তি লাভ করে।
Leave a comment