রবীন্দ্রনাথ একদা সশ্রদ্ধ চিত্তে ঘোষণা করেছিলেন ‘যথার্থ সমালোচনা পূজা। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কোনো সাহিত্যকে যদি সমালোচনার (Criticism) জালে আবদ্ধ করা যায়, তবে তার আসল স্বরূপ ধরা পড়ে, ফলে ভালো মন্দের বোধ বিচার তখন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। পূজার মধ্য দিয়ে পরম আরাধ্যাকে যেমন অনুভব করা সম্ভব হয় তেমনি সমালোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সাহিত্যের স্বরূপকে সহজেই জানা সম্ভব। এই কারণেই তিনি বলেছেন যথার্থ সমালোচনাই হল পূজা। সাহিত্যকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে হলে আগে চাই তার সমালোচনা। তাই প্রকৃত সমালোচনাকে সাহিত্য রূপে মেনে নেওয়া উচিত, এই সাহিত্যের সমালোচনার মধ্য দিয়েই তো সৃষ্টি হয় সৌন্দর্যের, যা পাঠকের একেবারেই আয়ত্বের বাইরে। সমুদ্র মন্থনে অমৃত আবিষ্কারের ন্যায় সমালোচনার দ্বারা প্রকৃত সাহিত্যের মানদণ্ড নির্মিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. উজ্জ্বল কুমার মজুমদার বলেছেন-“সাহিত্য বিচারের মূল কথাই হল বিশেষ মূল্যবোধের মানদণ্ডে সাহিত্য সৃষ্টির স্বরূপ নির্ণয় ।”….শিল্প সৃষ্টির মধ্যে কোন্টি মহৎ কোন্টি মাঝারি বা কোন্টি তুচ্ছ-এই পার্থক্য বোধ গড়ে তোলে তাকেই বলে সাহিত্যবোধ। এই বোধ থেকেই সাহিত্য বিচারের মূল্যায়ন শুরু।
সাহিত্য সমালোচকেরা মূলত তিনটি পদ্ধতি সাহিত্য-সমালোচনা বা মূল্যায়ন করে থাকেন। যথা—
(১) ব্যাখ্যানমূলক : সমালোচক কোনো রচনার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তার অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ বস্তুগত যে পরিচয় দান করে তাকে ব্যাখ্যানমূলক সমালোচনা বলা হয়। কোনো নাটক, কবিতা, উপন্যাস সম্পর্কে স্রষ্টার রচনাশৈলী, মানসিকতা, অভিপ্রায় খুব যত্ন সহকারে পাঠকের সম্মুখে তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য।
(২) বিচারমূলক : এখানে সমালোচক সাহিত্যকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তাঁর কল্যাণকর দিকটিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সমাজে স্থাপন করা এবং অকল্যাণকর দিকটির প্রতি পাঠককে সজাগ করাই হল এই সমালোচনার মূল উদ্দেশ্য।
(৩) উপভোগমূলক : শিল্প ও সাহিত্যের মধ্যে কেবলমাত্র ভালো দিকটি আছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করবে এবং পাঠকদের সম্মুখে তা তুলে ধরাই হল এই সমালোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য।
সাহিত্য সমালোচনা মূলত উক্ত তিনটি উপায়ে সম্পন্ন হলেও বিষয়গত দিক থেকে সমালোচনাকে বেশ কয়েকটি বিভাগে বিভাজিত করা হয়, যাদের মধ্যে প্রকৃতি ও আঙ্গিক গত দিক থেকে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান।
সমালোচনার বিভিন্নরীতি ও পদ্ধতি :
(১) ধারণামূলক ও ব্যক্তিপন্থী সমালোচনা (Impressionistic crit) : যে সমালোচনার মধ্য দিয়ে সমালোচকের ব্যক্তিগত অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া মুখ্য হয়ে ওঠে তাকে ব্যক্তিপন্থী সমালোচনা রূপে আখ্যাত করা হয়। গ্রন্থ পাঠ করে সমালোচকের কেমন লেগেছে তার পূর্ণ প্রকাশ এই সমালোচনায়। যেমন-রবীন্দ্রনাথের মেঘদূত কাব্যের উপেক্ষিতা প্রভৃতি এই গোত্রের সমালোচনা।
(২) সাহিত্য শাখাভিত্তিক সমালোচনা (Gentle criticism) : যে সমালোচনায় সাহিত্যের বিভিন্ন শ্রেণির সূক্ষ্ম স্থূল পার্থক্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার অন্তর্নিহিত লক্ষণগুলিকে পরিস্ফুট করা হয় তাকে সাহিত্য শাখাভিত্তিক সমালোচনা বলে। যেমন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছোটোগল্পের সীমারেখা’, গ্রন্থটি এই শাখার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
(৩) মূল পাঠভিত্তিক সমালোচনা (Texual crit) : যে সমালোচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের ভালোমন্দ বিচার না করে তার মূল পাঠটিকে ঠিক করে এবং পাঠান্তরের নানা ভুলভ্রান্তি তুলে ধরে পূর্বের চেহারাটিকে ফিরিয়ে আনে তাকে মূল পাঠভিত্তিক সমালোচনা বলে। যেমন বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রাচীন গ্রন্থগুলিকে নিয়ে মূল পাঠ নির্ণয় করা।
(৪) ঐতিহাসিক সমালোচনা (Historical crit) : যে সমালোচনা যুগ চিত্ত, পারিপার্শ্বিক গ্রন্থকারের ব্যক্তিমানস কাব্য বিশেষে কতখানি মূর্ত হয়েছে, তার বিচার করে, সেটাকে ঐতিহাসিক সমালোচনা রূপে পরিগণিত করা হয়। এই ধরনের সমালোচনায় কয়েকটি অসুবিধাও বিদ্যমান। তবে বাংলার নীরেন্দ্রনাথ রায়, গোপাল হালদার, অরবিন্দ পোদ্দার, বিশেষ করে বিনয় ঘোষ তাঁর নূতন সাহিত্য সমালোচনায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
(৫) মনোবৈজ্ঞানিক সমালোচনা (Psychological crit) : যে সমালোচনায় গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন বা তাঁর অবচেতন মনের ছাপ সাহিত্যে কতখানি মূর্ত হয়ে উঠেছে তার বিচার করাকেই মনোবৈজ্ঞানিক সমালোচনা বলে। বাংলায় এমন ধরনের সমালোচনা অসংখ্য বিচ্ছিন্নভাবে আছে, তা আজও গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়নি।
(৬) তুলনামূলক সমালোচনা (Comparative crit) : দুটি বিভিন্ন লেখকের রচনা কীর্তি, শব্দ সম্পদ, পক্তি তুলনামূলক বিচারের মধ্য দিয়ে যে সমালোচনায় সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাকে তুলনামূলক সমালোচনা বলে। যেমন—মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কতখানি প্রভাব আছে তা নির্ণয় করা হয় এই পদ্ধতির দ্বারা।
(৭) বিষয়, রূপ ও রসবাদী সমালোচনা : যার মধ্য দিয়ে সাহিত্যে বিষয় না রূপ কোন্টির গুরুত্ব বেশি? এমন ধরনের সমালোচনা প্রকাশ পায় তাকে এই গোত্রে ফেলা হয়; যেমন বাংলায় একটা কাব্যের সঙ্গে আর এক কাব্যের বিষয় ও রূপগত যে সমস্ত সমালোচনা হয়ে থাকে।
(৮) সাহিত্য আন্দোলন ভিত্তিক সমালোচনা : এইরকম সমালোচনায় এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে। সাহিত্যকে গোঁড়ামী থেকে, ঔচিত্তের দিকে টেনে নিয়ে যায়। যেমন–বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইলে ভ্রমরের চেয়ে রোহিণীর ওপর সহানুভূতি বেশি পড়েছিল বলেই পরবর্তীকালে বিনোদিনী, দামিনী, কিরণময়ী, অচলা, কমলের সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল।
(৯) গঠনাত্মক সমালোচনা (Structuralism) : সাহিত্যকে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে রেখে কিংবা লেখকের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাখ্যা করার বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় গঠনাত্মক সমালোচনার। এ প্রসঙ্গে ‘এক্ষন’ পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যা ১৩৮৭-তে প্রকাশিত ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের ‘কাঞ্চনমালা কাঞ্চনমালা’ প্রবন্ধটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
(১০) পরিসংখ্যা মূলক সমালোচনা (Statistical crit) : লেখকের ব্যক্তি জীবন, পারিপার্শ্বিক, সমাজজীবন ও ব্যক্তি প্রতিভার প্রকাশে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, তাঁরা এর আলোচনা না করে রেখাচিত্র এবং পরিসংখ্যান-এর সাহায্যে যে সমালোচনা করে তাকে পরিসংখ্যান মূলক সমালোচনা বলে। তবে এ যাবৎ বাংলা সাহিত্যে এই জাতীয় সমালোচনার এখনও আবির্ভাব ঘটেনি।
সর্বশেষে একটা কথা না বলে উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃত সমালোচনাকে পূজা রূপে চিহ্নিত করলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সার্থকতা পরিস্ফুট হয় না। বিশেষ করে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনায় ব্যক্তি হৃদয় ছাড়া বস্তু সৌন্দর্য সেখানে ধড়া পড়ে না। তাই ব্যক্তি হৃদয় মুখ্য হওয়ায় বস্তুসৌন্দর্য সেখানে বারে বারে আত্মপ্রকাশ থেকে বঞ্চিত হয়। অতএব সব সমালোচনাকে পূজা রূপে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
Leave a comment