প্রশ্নঃ প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা আলোচনা কর।

অথবা, প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে টমাস হবসের ধারণা বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকাঃ টমাস হবস ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম দার্শনিক ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী টমাস হবস ‘মানব প্রকৃতি’ ও ‘প্রকৃতির রাজ্য’ নামক তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। হবস ‘প্রকৃতি রাজ্য’ সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন তা মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত তার ধারণারই অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। মানুষকে স্বভাবত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও লোভী বলে তিনি সেভাবে চিত্রিত করেছেন। মানব প্রকৃতির ওপর বিশ্লেষণ এবং এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে টমাস হবস প্রাকৃতিক রাজ্যকে বিশ্লেষণ করেছেন।

টমাস হবসঃ বৃটেনের যেসকল দার্শনিক তাদের উন্নত চিন্তাধারার সোনালী ফসলে চিন্তা ক্ষেত্রের গোলা ভরেছেন তাদের মধ্যে টমাস হবস্ এক অনন্য প্রতিভা। এই খ্যাতনামা চিন্তাবিদ ১৫৮৮ সালে উইন্টসারের মেনসবেরীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মত এমন সূক্ষ্মজ্ঞান, যুক্তিপূর্ণ বিচার বুদ্ধি ও বাস্তব চিন্তা ধারা অতি অল্প- সংখ্যক চিন্তানায়কের মধ্যেই মেলে। ষোড়শ শতাব্দীতে তার ক্ষুরধার চিন্তাধারা চিন্তার ক্ষেত্রে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে যা রাজনৈতিক চিন্তা ধারার কর্মবিকাশের পথ প্রশস্ত করে।

টমাস হবসের প্রকৃতির রাজ্যঃ হবস ‘প্রকৃতির রাজ্য’ সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন তা মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত তার ধারণারই অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। মানুষকে স্বভাবত স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক ও লোভী বলে তিনি সেভাবে চিত্রিত করেছেন। তাতে মানব চরিত্রের এই সব স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে যদি কৃত্রিম কোনো শক্তির দ্বারা প্রশিক্ষিত ও শিক্ষিত করা না যায়, তাহলে তিনি প্রকৃতির রাজ্যের সে ভয়াবহ চিত্র তার মহামূল্যবান বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অঙ্কন করেছেন মানুষের বাস্তব জীবনের অবস্থা তার চেয়ে আদৌ অন্যরকম হবে না। তিনি তার উক্তির স্বপক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তিগুলি দেখিয়েছেন।

(১) রাষ্ট্রের পূর্বে প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের বসবাসঃ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাসরত বা এখনও করে বলে তিনি জীবনের যে কাল্পনিক চিত্র অঙ্কন করেছেন তা যদি নিতান্ত কল্পনাই হয় বাস্তব কোনো তথ্যের দ্বারা যদি তার ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করা নাও যায় তাহলেও হবসের এই তত্ত্বের যথার্থতা লোপ পায় না। কারণ হবসের মতে, অত্যন্ত মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক সমাজ সেখানেও মানুষের মধ্যে এই সব প্রবৃত্তি সমানে বিরাজমান। তফাৎ শুধু এই যে, সেগুলো সার্বভৌমের প্রবলতর শক্তির চাপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না।

(২) অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিতঃ তিনি তার উক্তির সমর্থনে বলেন যে, ‘মানুষ যখন ভ্রমণে বের হয় তখন সে নিজেকে অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত করে অন্যদের সঙ্গে নিয়োগ হয়, যখন সে ঘুমাতে যায় তখন বাড়ির দরজাগুলো অর্গলবদ্ধ করে রাখে এবং বাড়িতে অবস্থান করা সত্ত্বেও সে তার সিন্দুকগুলোতে তালা লাগিয়ে রাখে। সে যখন অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ভ্রমণে বের হয় তখন তার দেশবাসী সম্পর্কে, যখন দরজা অর্গলবদ্ধ করে ঘুমাতে যায় তখন পাড়া প্রতিবেশি সম্পর্কে এবং যখন সিন্দুকগুলোতে তালা লাগায় তখন নিজের ছেলেমেয়ে ও চাকর বাকর সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে।

(৩) প্রকৃতির রাজ্য বিভীষিকাময়ঃ হবসের মতে, আইনের শক্ত গাঁথুনিতে বাঁধা রাজনৈতিক সমাজে জীবনের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে যেখানে আইন শাসন বলে কোন জিনিস নেই সেখানে মানুষের অবস্থা কীরূপ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তার মতে, এরূপ অবস্থায় অর্থাৎ ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ মানুষ অবিরাম ভয়ভীতি ও ভয়াবহ মৃত্যুর বিভীষিকার মধ্যে বাস করে, এখানে মানুষের জীবন সঙ্গীহীন, অসহায়, নোংরা, পাশবিক, ক্ষণস্থায়ী।

(৪) উইলিয়ামের ধারণাঃ হবস বর্ণিত ‘প্রকৃতির রাজ্যের’ বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে উইলিয়াম ম্যাকগর্ভান বলেন, এই ‘প্রকৃতির রাজ্য’ শুধু যে মানব জাতির শৈশব লগ্নে প্রচলিত ছিল তাই নয়, আধুনিক কালের বর্বর জাতীয় লোকদের মধ্যেও এর অস্তিত্ব বিরাজমান।

(৫) আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতাঃ হবস বিশ্বাস করতেন যে, তার যুগে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানগণ এরূপ প্রকৃতির রাজ্যেই বাস করত। উপরন্তু তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, যদি ইউরোপের সরকারি শাসন শৃঙ্খলার মধ্যে কিছুমাত্র শৈথিল্য প্রকাশ পায়, তাহলেই ইউরোপের সুসভ্য অধিবাসী গণের মধ্যে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ প্রত্যাবর্তনের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। কৃত্রিম নিয়ন্ত্রণের অভাব দেখা দিলেই মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে।

(৬) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিঃ হবস যে ‘প্রকৃতির রাজ্যের’ কথা চিন্তা করেছেন, মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবনে তার ততটা যথার্থতা না থাকলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে তা সঠিকভাবেই প্রযোজ্য৷ লীগ অব নেশনস-এর মাধ্যমে এ ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে কিছুটা সাধারণ নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী হলেও জাতীয় রাষ্ট্রগুলো মূলত এখন পর্যন্ত হবসের ‘প্রকৃতির রাজ্যই’ রয়ে গেছে। সঠিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ মানুষ স্বাধীন ও সমান, হবস সে কথা বেশ জোরের সঙ্গেই স্বীকার করেছেন।

(৭) অসীম স্বাধীনতা ও সমতাঃ তার মতে, মানুষের এই অসীম স্বাধীনতা ও সমতাই প্রকৃতির রাজ্যের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী। যেহেতু সকলেই স্বাধীন, সেহেতু সকলেই সমান এবং সেহেতু ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ সার্বভৌম শক্তির দ্বারা বলবৎকৃত কোন সাধারণ আইনের অস্তিত্ব নেই, কাজেই ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ মানুষ ঠিক জঙ্গলের পশুদের মতোই বসবাস করে।

(৮) সবলের অস্তিত্বঃ এখানে সবল দুর্বলকে আক্রমণ করে এবং দুর্বল সবলের ভয়ে পলায়ন করে। ফলে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ যে অবস্থা বিরাজ করে তার সঙ্গে যুদ্ধাবস্থার কোন পার্থক্য নেই। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ সব সময় যুদ্ধ-বিবাদে লিপ্ত থাকে। বরং প্রকৃত অর্থ হলো এই যে, যেসব কারণে যুদ্ধের সৃষ্টি হয় সেসব কারণ এখানে পুরোদমে বিদ্যমান।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম দার্শনিক ও ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখলকারী টমাস হবস ‘মানব প্রকৃতি’ ও ‘প্রকৃতির রাজ্য’ নামক তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। হবস ‘প্রকৃতি রাজ্য’ সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন তা মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত তার ধারণারই অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। মানুষকে স্বভাবত স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক ও লোভী বলে তিনি সেভাবে চিত্রিত করেছেন। মানব প্রকৃতির ওপর বিশ্লেষণ এবং এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে টমাস হবস প্রাকৃতিক রাজ্যকে বিশ্লেষণ করেছেন।