‘মুক্তধারা’ নাটকে রূপক ও সংকেতের মিশ্রণ ঘটেছে। রাষ্ট্রনীতি, জাতীয়রাষ্ট্রের নীচ শিক্ষণ পদ্ধতি, যান্ত্রিকতা, জাতীয়তা প্রভৃতি বহু বিষয় সম্বন্ধে কবির নিজস্ব মতামত ‘মুক্তধারায়’ বিবৃত হয়েছে। কবি চিরদিন শক্তের অত্যাচার, ধনতন্ত্র, বিজ্ঞানের বিকৃত ব্যবহার, বিকৃত দাস্য মনোভাবাপন্ন শিক্ষাধারা প্রভৃতিকে অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করতেন। এই সকল পরিবেশের মধ্যে আত্মার সহজ সুন্দর বিকাশ হয় না। এই সত্যের ওপরেই ‘মুক্তধারা’র গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সমস্ত কিছুর মূলে আছে মুক্তির ছন্দোস্রোতের প্রতি ইঙ্গিত। কী বস্তুজগতে, কী মানসরাজ্যে যে মুক্তধারা স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাহিত হয়ে চলেছে তাতে বাধা সৃষ্টি করতে যাওয়ার অর্থ আত্মার বিনাশ আনয়ন করা। এই মূল সুরটি সাংকেতিক।

ধনঞ্জয় ও অভিজিতের চরিত্র সাংকেতিকতামণ্ডিত। অভিজিৎ সুদূরের পিয়াসী, গণ্ডীকে বর্জন করে বিরাটত্বের মধ্যে ব্যাপ্ত হতে ব্যাকুল। মুক্তধারার মুক্ত স্রোতের ন্যায় তার আত্মাও মুক্ত। যুবরাজ অভিজিৎকে যে মুক্তধারার কাছে ঝর্ণাতলায় কুড়িয়ে পাওয়া গেছে তার অর্থ— সে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে, দেশকাল জাতির গণ্ডীর বাইরে বিশ্বমানবের সর্বপ্রকার বন্ধন মুক্তিই তার ব্রত।

মুক্তধারাও বিশেষ সাংকেতিকতায় তাৎপর্যবহ। মানবজীবনের অব্যাহত স্বচ্ছন্দ, অবিরাম গতিই মুক্তধারা। গতির স্রোতে মানুষ জন্ম-জন্মাত্তরের নানা অবস্থার মধ্যে দিয়ে নিত্য অগ্রসর মান৷ গতির স্রোেত রুদ্ধ হলেই মানুষের অন্তরাত্মা পীড়িত হয়। রুদ্ধ অবস্থা জীবনের বিকৃত ও অসত্যরূপ। সর্ববন্ধনমুক্ত গতিই জীবনের স্বরূপ। মুক্তধারাই জীবনের প্রতীক।

‘মুক্তধারা’ নাটকের সমস্ত ঘটনা অভিনীত হয়েছে পথের ওপর। পথ এখানে অবিরাম চলার প্রতীক। পথ মানে নিরন্তর অগ্রসর হওয়া, পথের ওপরেই জীবনের বিচিত্র ঘটনা ঘটে, বিচিত্র অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়— আর মানুষ তার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে চলে। মানুষ অনন্ত পথের পথিক রূপে নিত্য অগ্রসরমান। পথ সীমাহীনতার ইঙ্গিত দেয়, জীবনের অনস্ততত্ব ও অসীমত্বের সংকেত দেয়। ভৈরব মন্দিরের দিকে পথের যাওয়ার একটি তাৎপর্য আছে। সেই পথিক-বন্ধু লীলাময় দেবতা পথের শেষে পথিকের জন্য অপেক্ষমান। সমস্ত পথিক তাঁরই দিকে চলেছে। তিনিও তো পথিক— মানুষের পথের সাথী; তিনি পথে নেমে মানুষ পথিকের সঙ্গে খেলায় মেতে ক্রমশই তাঁর দিকে আকর্ষণ করছেন।

রাজা ‘মুক্তধারাকে’ অবরুদ্ধ করেছেন বিরাটাকায় লৌহযন্ত্রের দ্বারা। রাজশাসন যন্ত্রশক্তির সাহায্যে মানুষের সচল জীবন ধারায় বাধা সৃষ্টি করেছে। পাশ্চাত্যের উগ্র, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রশক্তির স্বরূপ, আগ্রাসী নীতি বর্জিত মানবতা যন্ত্রগর্বোদ্ধত শাসন। উত্তরকূটের রাজ্যশাসনে সুপরিস্ফুট। ন্যায় ও সত্যবিচ্যুত রাষ্ট্রনীতির রূপটি এ নাটকে প্রতিফলিত। আর এর প্রতীক হল লৌহযন্ত্র।

নন্দিসংকটের যে পথ খুলে দেওয়া হয়েছে তা অবরুদ্ধ জীবন-পথের প্রতীক। মুক্তধারার বাঁধ যান্ত্রিকতার চরম রূপ। যন্ত্রের প্রবল শক্তি সেখানে কেন্দ্রীভূত, ওই বাঁধভাঙা সেখানে সহজসাধ্য নয় জেনেও অভিজিৎ প্রাণের বিনিময়ে সেই বাঁধ ভাঙতে প্রস্তুত। বাঁধ না ভাঙলে জীবন অর্থহীন— পৃথিবীতে মনুষ্যত্বের যথার্থ উপলব্ধি অসম্ভব।

ধনঞ্জয় বৈরাগী বিজিত, অত্যাচারিত জাতির প্রতীক। আত্মার শক্তি জড় শক্তি নয়, সে শক্তি বৃহত্তর নীতির শক্তি। শত অত্যাচার, শত অপমান অন্তরাত্মাকে নিষ্পেষিত করতে পারে না। ধনঞ্জয় সমস্ত অত্যাচারিত জাতির অন্তরাত্মাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তির দ্বারা। তার সংগ্রাম স্থূল ও জড়ের সঙ্গে সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় শক্তির, হিংসার সঙ্গে অহিংসার। ধনঞ্জয় অত্যাচারিত হয়েও জড়শক্তির দৈহিক বলের আশ্রয় গ্রহণ করেনি। নির্ভয়ে সত্যকথা উচ্চারণ করে মানুষের অস্তরতম সত্যের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। রাজার সঙ্গে ধনঞ্জয়ের বিরোধ তাই অহিংসার সংগ্রাম, সত্যের যুদ্ধ।

এ নাটকের রূপকার্থ নিহিত আছে মূল দ্বন্দ্বের মধ্যে। এই মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে যন্ত্রের সঙ্গে প্রাণের, যান্ত্রিকতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার, বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের, দৈত্যের সঙ্গে দেবতার, মানুষের পশু অংশের সঙ্গে দেব অংশের। মানুষের মধ্যে দেবতার অংশরূপী যে অন্তরাত্মা সে নির্যাতিত। দেবতার দান যে জলধারা সে জলধারা রুদ্ধ। দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে অন্ধ জড়শক্তি তার মাথা রূপ নিশান দেবমন্দিরের ত্রিশূলের পাশে উড়িয়ে দিয়ে তাকে স্পর্দ্ধা ভরে আহ্বান করেছে।

এখানে অভিজিৎ এবং ধনঞ্জয় পূর্ণাঙ্গ সংকেতিক চরিত্র, আর বিভূতি ও রণজিৎ রূপক চরিত্র। বিভূতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ ঐশ্বর্য। ঈশ্বর লাভের সাধনায় সাধক ঐশ্বরিক বিভূতিলাভ করেই সন্তুষ্ট হয়, মূলের সন্ধান পায় না। শক্তিলাভের মোহ সকলকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় বিভূতি ঈশ্বরের দান—ঈশ্বরের মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্য শক্তির দম্ভে ভুলে যায়। তবে সেই ঐশ্বর্য হয় অন্ধক্তির উৎস। রণজিৎ চিরকাল রণে জয় করেছেন–ন্যায়, নীতি-সত্য ধর্মের স্বরূপ জানার চেষ্টা তাঁর নেই।

এমনি করেই নাট্যকার ‘মুক্তধারা’ নাটকে রূপক ও সংকেতের মিশ্রণ ঘটিয়ে নাটকটিকে রূপক-সাংকেতিক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। বিশ্বজিৎ, সুমন, কঙ্কর, উদ্ধব, বটু, গণেশ, সঞ্জয়, বিভূতি প্রভৃতি নামগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নাটকে ব্যবহৃত প্রতীক ত্রিশূল, পথ, মুক্তধারা সাংকেতিকতায় ব্যঞ্জিত হয়ে তত্ত্ব দর্শনের দিক থেকে নাটকটিকে অর্থবহ করেছে।

সর্বোপরি, মুক্তধারা নাটকের অন্তিম ফলশ্রুতিতে রূপক সাংকেতিক অর্থ সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের গভীরে প্রবেশ করে মানব চেতনার মৌলিক অর্থকে প্রকাশ করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মানবজীবন কেন্দ্রিক এই অখণ্ড বক্তব্যকে প্রকাশের জন্য সাধারণ বক্তব্যধর্মী নাট্যরীতির আশ্রয় গ্রহণ না করে দূরতরের আভাস ব্যঞ্জনায় রূপক সংকেতের আবহমণ্ডল রচনা করে, দূরায়ত্ত শিল্প সৃষ্টির অনিবচনীয়তায় ‘মুক্তধারাকে’ একটি সার্থক রূপক-সাংকেতিক নাটকে উন্নীত করেছেন।