প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪-১৮৮৩] বাংলা গদ্যের প্রথম কথাশিল্পী ছিলেন না বটে, কিন্তু ‘আলালের ঘরের দুলাল’ [১৮৫৮] রচনা করে কিংবা ‘আলালী গদ্য’ প্রবর্তন করে তিনি আটপৌরে, সহজ ও সম্প্রতি গদ্য ভাষার সূচনা করেন। আলালী গদ্যের সার্থকতা যেমন আছে, তেমনি আছে সীমাবদ্ধতা, কিন্তু সাতদিনের কথাবার্তার ধরনকে সাহিত্য ভাষারূপে অন্তর্ভুক্ত করার কৃতিত্ব নিরীক্ষায় ও দুঃসাহসে প্যারীচাঁদ মিত্র উন্মেষকালীন বাংলা গদ্যের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
সমকালীন জীবনের বিকাশ, বিশৃঙ্খলা, অসংগতির প্রতি তীক্ষ্ণ কটাক্ষপাত প্যারীচাঁদের সাহিত্য সাধনার প্রধান প্রেরণা।

“His best work in the ‘Alaler Gharer Dulal’ which may be said to be the first novel in the Bengali language.”

ড. সুকুমার সেনের মতে, “মাইকেল মধুসূদন যেমন নবীন কবিতার জন্মদাতা, প্যারীচাঁদ মিত্র তেমনি গল্প, উপন্যাসের পথকর্তা।” লেখক অর্থাৎ প্যারীচাঁদ মিত্র নিজেও ইংরেজি মুখবন্ধে একে উপন্যাস শাখার প্রথম বাংলা রচনা বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলা ভূমিকায় এটিকে তিনি বলেছেন প্রথমোদ্যম। যাহোক উপন্যাস হিসেবে যতটা নয়, গদ্যরীতির দিক থেকে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ততটা উল্লেখযোগ্য।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ এ প্যারীচাঁদের গদ্য অভিনব ও দুঃসাহসিক। যদিও এ গদ্যে ও গদ্যরীতিতে প্যারীচাঁদ শেষাবধি সুস্থির থাকেননি। পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন Theosophist (থিওসফিস্ট) গদ্যনীতির দিক থেকে সাধু আশ্রয়ী। তবুও ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা গদ্যরীতিতে একটা বিস্ময়কর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ গ্রন্থের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এভাবে সূত্রবদ্ধ করা যেতে পারে:

  1.  বিদ্যাসাগরের গদ্যের বিরোধিতা করার জন্য প্যারীচাঁদ আলালী গদ্য লিখেননি। ভাব ভাষা দু’দিক থেকেই দু’জন দু’জনের বিপরীত। দু’জনের তুলনা অবান্তর এ কারণে যে, বিদ্যাসাগর সারাজীবন পাণ্ডিত্য রীতির গদ্য লেখেননি। প্যারীচাঁদের উত্তরকালীন রচনা ও আলালী রীতি থেকে সরে গিয়েছিল।
  2. বঙ্কিমচন্দ্র ঠিকই বলেছিলেন যে, আলালী রীতির গদ্য বাংলা গদ্যের আদর্শ রাগ হয়ত নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার বাক্যরীতির প্রবহমানতা, প্রাঞ্জলতা, দেশাত্মতা, সরসতার প্রশ্নে প্যারীচাঁদ পথিকৃৎ।
  3. প্যারীচাঁদ বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের স্মরণীয় সংস্কারক।
  4. ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রচনার সময় একথা প্যারীচাঁদের মনে ছিল যে, ভাষার প্রধান উদ্দেশ্য যোগাযোগ স্থাপন, কথকের সাথে শ্রোতার, লেখকের সাথে পাঠকের। সেজন্য এ গ্রন্থটি লিখে প্যারীচাঁদ বাংলা ভাষার বোধগম্য রূপ সৃষ্টি করেন।
  5. . ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দেশের মানুষের জন্য সাধারণ বোধগম্য অজটিল গদ্যরীতির প্রবর্তন। গদ্যকে যে হতে হবে সরল, সুস্পষ্ট, শব্দাড়ম্বরহীন, নির্ভর, উন্মুক্ত, সাবলীল ও সুখবোধ্য। তাই এ গ্রন্থ পড়ে বুঝা যায়।
  6. . রামমোহন রায়কে যদি আমরা প্রথম গদ্য লেখক বলি দেখা যাবে তার পরে সে গদ্যের সৃষ্টি তা অলৌকিক বাংলা ভাষা থেকে অনেক দূরবর্তী। বিদ্যাসাগর সুমধুর মনোহর গদ্য লিখেছেন। তবুও তাকে সর্বজনবোধ্য বলা শক্ত। প্যারীচাঁদ এ সর্বজনবোধ্য ভাষার জনপ্রিয়তা হঠাৎ সে অর্থে বাংলা গদ্যের একজন প্রধান সংস্কারক তার গদ্যে ওজস্বিতা এবং বৈচিত্র্যের প্রভাব দেখা যায়।
  7. ‘আলালের ঘরের দুলাল’ রীতি এবং বিষয় দু’দিক থেকে ভিন্ন। নিজের দেশ, সমাজ ও পরিপাট্য সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে তা প্যারীচাঁদের পূর্বে কারো মনে পড়েনি। ইংরেজি কিংবা সংস্কৃতি অনুবাদই ছিল তখনকার প্রথা। বিদ্যাসাগর স্বয়ং প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও তার রচনার বড়ো অংশ সংস্কার অথবা ইংরেজির অনুবাদ। কিন্তু প্যারীচাঁদ বিদেশি উৎসের উচ্ছিষ্টে তৃপ্ত হননি। তিনি স্বভাবের অনন্ত ভাণ্ডার থেকে রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখে তিনি প্রমাণ করলেন সাহিত্যের বিষয়বস্তুর জন্য বিদেশি উৎসের বিচরণ অনাবশ্যক। নিজের দেশ, সমাজ ও প্রতিবেশে সাহিত্যের বিচিত্র উপাদান ছড়িয়ে আছে।

বিশেষ ধরনের গদ্য লেখার কৃতিত্ব অর্জন করেও প্যারীচাঁদ মিত্র তার লেখক জীবনে কেবল ভাষারীতিকে গুরুত্ব দেননি। তিনি অন্তরধর্মে ছিলেন নীতিবাদী, সমাজ কল্যাণকামী, ধর্মনিষ্ঠ এবং সংস্কারক। ভাষারীতির বাইরে তার এ পরিচয় ‘আলালের ঘরের দুলালে’ সঙ্ঘাত ছিল। পরবর্তী রচনামালায় তো বটেই। তবে ধর্ম স্পৃহা, নীতি, শাসন ও সংস্কারক মনোবৃত্তি ‘আলালের ঘরের দুলালে’ বিশেষ প্রভাব রাখেনি। বাক্যের লোকজ কাঠামো তীক্ষ্ণতায়, শ্লেষে, ব্যঙ্গে, উপহাস ও রসিকতায় ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ সাহিত্য বৈশিষ্ট্য বিধৃত।

‘আলালের ঘরের দুলালে’র প্রধান গুরুত্ব সমকালীন জীবনের বিশ্বস্ত ভাষ্যে কিংবা বিশেষ ধরনের ভাষারীতিতে হলেও প্যারীচাঁদের এক ধর্মপূঢ় চেতনা, অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো গ্রন্থের পূর্বাপর ব্যাপ্ত। এ চেতনার উন্মেষ এ গ্রন্থে এবং এ চেতনাই উত্তরকালের সমস্ত রচনায় গভীরতা ও ব্যাপ্তি অর্জন করে। ধর্মগূঢ় চেতনায় অতিরিক্ত আচ্ছাদিত হওয়ার কারণে প্যারীচাঁদের গদ্যরীতি পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এ পরিবর্তনের কারণে উত্তরকালে তার কোনো গ্রন্থই যেমন- ‘মদ খাওয়া বড় দায়’, ‘জাত থাকার কি উপায়’ (১৮৫৯), ‘রামা রঞ্জিকা’ (১৮৬০), ‘অভেদী’ (১৮৭১), ‘আধ্যাত্মিকা’ (১৮৮০), ‘বামাতোষিণী’ (১৮৮১), তার প্রথম গ্রন্থের মত মূল্য অর্জন করেনি। অবশ্য ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর ব্যঙ্গ, উপহাস, রসিকতা, শ্লেষ, কটাক্ষ, কথ্যভঙ্গি, আরবি-ফার্সি শব্দ, লোকজবুলি ইত্যাদি। ‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায় আছে’। যেমন-

“কলিকাতায় যেখানে যাওয়া যায়, সেখানেই মদ খাওয়ার ঘটা, কি দুঃখী, কি বড়ো মানুষ, কি যুবা কি বৃদ্ধা সকলেই মদ পাইলে অন্ন ত্যাগ করে। কথিত আছে, কোনো ভদ্রলোক এক গ্রামে কিছু দিবস অবস্থিতি করিয়াছিলেন, সেখানে দেখিলেন, প্রায় সকল লোক অহোরাত্র অবিশ্রান্ত গাঁজা খাইতেছে। — গাঁজাখোরের মধ্যে একজন উত্তর করিল। আমরা সকলেই গাঁজা খাইয়া থাকি। গ্রামে শালগ্রাম ঠাকুর ও আমাদের টেপীপিসী-যাহার বয়স নিরানব্বই বৎসর, তারাই খারিজ আছেন। কলিকাতা এখন তদ্রূপ।” [১ম খণ্ড, ১ম পরিচ্ছেদ)

‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’ এর পরবর্তী সকল গ্রন্থের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক অত্যন্ত কম। এ গ্রন্থসমূহের মুখ্য উদ্দেশ্য নীতি ও তত্ত্বকথা প্রচার। স্ত্রী বিয়োগ, ব্যাপক ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ, বয়োবৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে প্যারীচাঁদ ক্রমশ থিয়োসফিতে উৎসাহী হয়ে উঠেন, বিদেশি গ্রন্থ থেকেও ব্যাপকভাবে অধ্যাত্মবিষয় পাঠ নেন। ওয়ার্লকস্ট ও মাদাক্ষ ব্লাডটস্কির থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন এবং শেষাবধি এ বিশ্বাস মীমাংসিত হন যে, আত্মা চিরন্তন ও অবিনশ্বর। ‘রামারঞ্জিকা’, ‘অভেদী’, ‘আধ্যাত্মিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থে তার এ বিশ্বাস, ধারণা ও প্রত্যয় উপস্থাপিত। এসব গ্রন্থ বিষয়বস্তু ও গদ্যরীতিতে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে ভিন্ন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর গদ্যভঙ্গি ছিল সহজ, সরল, আটপৌরে, কিন্তু বিষয়ের অনুরোধ পরবর্তী গ্রন্থগুলোর গদ্য হয়েছে কঠিন। তৎসম শব্দবহুল, জটিল। প্যারীচাঁদ বিষয়ের অনুসরণ করেছেন তার গদ্যরীতিতে। সমকালীন জীবন ও তার বাস্তবতার রূপাঙ্কনে প্যারীচাঁদ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার ভাষা যেমন ‘আলালী’ ধরন থেকে সরে গেছে একইভাবে বিষয়বস্তুও হয়ে উঠেছে বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক শূন্য। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারীচাঁদের স্বনির্মিত বাদ্যভঙ্গি সমকাল সাহিত্যে তেমন অনুসৃত হয়নি।

উপরিউক্ত আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা গদ্য সাহিত্যে এক অভিনব ও স্বতন্ত্র ভাষারীতির উদ্ভাবক। বাংলা গদ্যের সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন, তার গুরুত্ব অসীম, অশেষ। তবুও একথা বলা যায়, ‘আলালী’ ভাষার মতো একটি অভিনব ভাষাভঙ্গি নির্মাণ করেও প্যারীচাঁদ মিত্র এ ভাষারীতিকে পরবর্তীকালের সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি। জীবিতকালে তিনি নিজেও তার রচনায় ‘আলালী’ ভাষা থেকে সরে গেছেন। অবশ্য প্যারীচাঁদের সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তিনি বিষয়ানুসারী গদ্য রচনা করেছেন। বিষয়বস্তুর সাথে তার রচনায় রয়েছে অত্যাশ্চর্য সংযোগ।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।