পৌরাণিক নারী চরিত্রগুলি কী ভাবে মধুসূদনের হাতে নবরূপ লাভ করেছে তা আলোচনা করো। বীরাঙ্গনা কাব্যকে নারী মুক্তির কাব্য বলা যায় কী?

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বীরাঙ্গনা কাব্যকে মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলেছেন। এই কাব্য কী ছন্দে, কী ভাষায়, কী কাহিনী বিন্যাসে অতুলনীয়। সম্ভবতঃ বীরাঙ্গনা কাব্যই বাংলার একমাত্র পত্র-কাব্য। পুরাণ, মহাকাব্য ও প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের থেকে নারী চরিত্র চয়ন করে নতুন ভাবে যুগোপযোগী কৃত্রিম ক্লাসিক সৃষ্টি করেছেন। নবজাগরণের কবি মধুসূদন আধুনিক জীবনবোধের অন্যতম পরিচয় দিতে তাঁর কাব্যে পুরাতনের নবায়ন ঘটিয়েছেন এবং যুগোপযোগী তথা আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বীরাঙ্গনা কাব্যের অঙ্গনাদের চিত্রিত করেছেন। ফলে তাঁর কাব্যের অঙ্গনাগণ হয়ে উঠেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা। বস্তুতঃ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তিনি।

ফরাসী বিপ্লবের পরে যে মানবতাবাদ সাহিত্যে প্রতিষ্ঠালাভ করে, মধুসূদন সেই মানবতাবাদকেই তাঁর কাব্যে পূর্ণ স্বীকৃতি দান করতে চেয়েছেন। মানবতাবাদের লক্ষণ হল মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দান। মানব জীবনের মূল্যবোধের প্রতি সমোচিত শ্রদ্ধাবোধ। যার ফলে তাঁর কাব্যে রাক্ষস চরিত্রও চিত্রিত হয়েছে অনার্য মানুষ হিসেবে। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র রাবণ হয়েছেন দোষেগুণে সমন্বিত বলিষ্ঠ মানব। নায়ক হিসেবে সেই বলিষ্ঠ রাবণই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেখানে। দেবকুলপ্রিয় চরিত্র রামচন্দ্র সে মর্যাদা লাভ করতে পারেন নি। জীবনবোধের প্রতি আস্থাশীল মধুসূদনের কাব্যে তাই শোনা যায় মানবের জয়গান। দেবতা বা দৈবী ভাব কিম্বা রাক্ষসাদি সমস্তই মানবিক রূপে অঙ্কিত হয়েছে। বাংলা কাব্যে সাহিত্যে মধুসূদনের পরে অন্যান্য শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকদের রচনার মাধ্যমে সেই মানবতাবাদের জয়যাত্রা আজও পরিপুষ্ঠ করে চলেছে সাহিত্যের বাতাবরণ।

ঠিক যে সময়টায় নারীদের স্বতন্ত্র সত্তা বলে কিছু ছিল না, পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ শোষিত নারীর অবস্থান। ছিল কেবল সংসারে আর আতুর ঘরে, সেই সময়েই মধুসূদনের মানবতাবাদের আলোক বিচ্ছুরণে সেই নারীরা স্বতন্ত্র সত্তা রূপে জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম বা সচেষ্ট হয়েছিল। বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে ব্যক্ত হতে দেখা যায় নারীর প্রেমের বীর্যে অশঙ্কিনী হবার আগ্রহ, পুরুষের সমকক্ষ হবার বাসনা। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিনীর মতোই তারা বলতে চেয়েছিল—

পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে 

সে নহি নহি 

হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে 

সে নহি নহি,

যদি পার্শ্বে রাখ মোরে

সংকটে সম্পদে সম্মতি দাও যদি

কঠিন ব্রতে সহায় হতে…।

এ আহ্বান নতুন যুগের নব চেতনায় উদ্ভাসিত নায়িকার আহ্বান। মধুসূদনের বীরাঙ্গনার নায়িকাদের কণ্ঠে এ আহ্বানধ্বনিই শ্রুত হয়। কারণ বীরাঙ্গনা কাব্য প্রকৃত অর্থেই নারী প্রগতির সূচনা কাব্য। বীরাঙ্গনা পত্র কাব্যের পত্রগুলি বিশ্লেষণ করলে এই কথা সহজে বোঝা যাবে।

বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলা, আশ্রম কন্যা। তিনি ধীর, স্থির, নম্র, কোমল চিত্তবৃত্তিযুক্ত। তিনি রাজৈশ্বর্য আকাঙ্ক্ষা করেন না, বিভব বৈভবে তাঁর লোভ মাত্র নেই। দুষ্মন্তের বিরহে তিনি জগৎ সংসার অন্ধকারময় দেখলেও প্রয়োজনে দুখস্তকে মৃদুকণ্ঠে দোষারোপ করতে চেষ্টা করেছেন, ‘কেন ব্যাধ বেশে আসি বধিলে তাহারে, নরধিপ? একথা শকুন্তলার গভীর মনের কথা। যেখানে তিনি কেবল অবহেলিত, পুরুষের নমসহচরী কিম্বা পুরুষের পদপ্রান্তে অবস্থিত নারী মাত্র নন, জীবন বোধে উজ্জীবিত এক নারী। পতির বিরহে আকুল হওয়া সত্ত্বেও মনের গভীরে যার রয়েছে বাঁচার প্রেরণা ‘জীবনের আশা হয়ে কে ত্যজ্ঞে সুহজে’। যে যুগের নারীদের স্বামীই ছিল একমাত্র ধ্যান জ্ঞান, সে যুগে বীরাঙ্গনা শকুন্তলা যথার্থই প্রগতিশীল নারী।

তারা চরিত্রটি বিশেষ গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। যদিও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে বসলে তারার প্রেম সমাজরীতি বহির্ভূত এবং অবৈধ। কিন্তু কবি মধুসূদন সংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে যুবতী তারার এই পদস্খলনকে বিচার করেন নি। তারার নারী মনের স্বাভাবিক আবেগ ও প্রবৃত্তিকে তিনি অস্বীকার করেন নি। তাই তারা তাঁর তপস্বী স্বামীর বর্তমানেই অকুণ্ঠে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করে চন্দ্রের উদ্দেশ্যে লিখেছেন—

“এস তবে, প্রাণসখে; দিনু জলাঞ্জলি

কুলমানে তব জন্যে, ধর্ম, লজ্জা ভয়ে।”

চন্দ্রের প্রতি তারা তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করতে কোন দ্বিধা করেন নি। কারণ তাঁর যুবতী শরীর ও মন ছিল প্রেম বুভুক্ষু। দেবগুরু বৃহস্পতির প্রেম উদাসীনতার মধ্যে লালিত হয়ে দিব্যকাত্তি যুবক চন্দ্রকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রেম বঞ্চিতা তারার মনে প্রেমের সঞ্চার হয়েছিল। নিজের অসংযত হৃদয় দৌর্বল্য ও বিধি বহির্ভূত প্রেমের জন্যে নিজেকে ধিক্কার দিলেও অপ্রতিবোধ্য কামনার চাঞ্চল্যে আলোড়িত হয়েছেন। এ প্রেম সমাজ সংস্কারের পরিপন্থী হলেও এর মধ্যে তারার প্রেম সত্তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তারার পক্ষে নিজ মনের ভাব অকুণ্ঠে ব্যক্ত করার দৃঢ়তায় নারী প্রগতির যাত্রারম্ভ ঘোষিত হয়েছে।

দ্রৌপদীর মধ্যে যে ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে তাতে তিনি দাম্পত্য লীলা অভিজ্ঞ প্রেম সম্পর্কে আস্থাশীল রমণী। তিনি পদানত নারী নন কিম্বা শাস্ত্রবাক্যে বাধা আচার ভীরুতা তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে নি। তিনি তাঁর প্রবাসী স্বামীকে যেমন তীব্র বিদ্রূপে বিদ্ধ করতে পারেন তেমনি তাঁকে যথাযোগ্য পরামর্শ দান করতেও দ্বিধা করেন না। তিনি প্রগতিশীলা নারী বলেই যে যুগের ‘পতি বাক্যই বেদ বাক্য’ বা ‘পতি পরম গুরু’ ধারণার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে পতিকে তাঁর পত্নীত্বের অধিকারে সদুপদেশ দান করেছেন এমন কি তাঁর ইচ্ছাকে পতির ইচ্ছায় পরিণত করাতে প্রবাসী অর্জুনকে সপ্রেম আহ্বান জানিয়েছেন।

“কি কাজ উত্তরে?

পত্রবহ সহ ফিরি আইস এ বনে।”

মানবতাবাদী মধুসূদন বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি নায়িকাকেই এইভাবে নারীত্বের মর্যাদা দিতে প্রগতিশীলা করে তুলেছেন।

অনুযোগ পত্রিকা রচয়িতা কেকয়ী এবং জনা উভয়েই নিজ নিজ বক্তব্য প্রকাশ করেছেন বীর্যবত্তার সঙ্গে। কেকয়ী রাজা দশরথের আচরণে ক্ষুব্ধ। কোন এক সময় দশরথ কেকয়ীকে বলেছিলেন ভরতকে তিনি যৌবরাজ্যে অভিষেক করবেন, কিন্তু কার্যকালে জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করলে, কেকয়ী ক্ষুব্ধ হন। তিনি দশরথকে পূর্ব কথা স্মরণ করার জন্যে অনুরোধ করেছেন এবং সেই সঙ্গে কৌশল্যা ও রামচন্দ্রের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে ভর্ৎসনা করেছেন। অভিযোগ পত্রিকায় কেকয়ী তাঁর অভিমানী মনের ছবি তুলে ধরেছেন নানা ভাবে। কখনও তাঁর প্রৌঢ়ত্বের ফলে শরীরের ধার কমার কারণে দশরথ তাঁর প্রতি বিমুখ—এ কথা যেমন উল্লেখ করেছেন, কখনও কৌশল্যার প্রতিও ঈর্ষা প্রকাশ করেছেন। নানা ভাবে রাজাকে স্বমতে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টাও করেছেন। তিনি পত্রে লিখেছেন– দেশে দেশে, গ্রামে গঞ্জে তিনি প্রচার করিয়ে দেবেন, ‘পরম অধর্মাচারী রঘু-কুল-পতি’ এবং এখানেই শেষ নয়, তিনি দশরথকে শাসিয়েছেন যে, পুত্র ভরতকে নিয়ে তিনি পিত্রালয়ে চলে যাবেন। সেখানে—

“পিতৃ-মাতৃহীন পুত্রে পালিবেন পিতা—

মাতামহালয়ে পাবে আশ্রয় বাছনি। 

দিব্য দিয়া মানা তারে করিব খাইতে

তব অন্ন, প্রবেশিতে তব পাপ-পুরে।”

কেয়ীর এই ধরনের ভর্ৎসনা, অভিযোগ, অনুযোগ তাঁর স্বাধীন বিদ্রোহিনী চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। তাঁর এই অনুযোগ ধরণীটির মধ্যে প্রগতিশীলতা বর্তমান।

জনা চরিত্রের মধ্যে যে বলিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায় তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁর বীর পুত্র বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। এই সংবাদ পেয়েও তাঁর স্বামী তথা প্রবীরের পিতা নীলধ্বজ, পুত্রের হত্যাকারীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে, তাকে নরনারায়ণ জ্ঞানে, পরম মিত্ররূপে বরণ করলেন। ক্ষত্রিয় রমণী জনা তাতে ক্ষুব্ধ। তিনি স্বামীকে নানাভাবে ক্ষত্রিয়জনোচিত আচরণ করতে অনুরোধ করেছেন।

যে যুগে পতি বাক্য লঙ্ঘন করা যেত না, সেই যুগে জন্য তাঁর পতিকে উপযুক্ত কার্য পালন করার জন্যে যে পরামর্শ দান করেছেন তাতেই তাঁর প্রগতিশীলতার প্রমাণ দান করে। এই ভাবে আলোচনা করে দেখলে বীরাঙ্গনা কাব্যকে প্রকৃতই নারী প্রগতির কাব্য রূপে অভিহিত করা যায়।