বৈদিক যুগের পরবর্তীকাল ভারতের ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানের কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম আচার সর্বস্বতার পরিবর্তে আত্মঅনুশীলন, সৎজীবন ও সৎকর্মের যে বাণী প্রচার করেছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তার প্রভাবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারেন নি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উপর বৌদ্ধ ও জৈন মতাদর্শ ছাড়াও অনার্যদের ধর্মান্তরণের প্রভাবও দেখা যায়। আদি পর্বের বৈদিক দেবতাদের অনেকেই এ সময় গুরুত্ব হারান এবং কেউ কেউ নতুন গুণাবলীসহ নতুন রূপে আবির্ভূত হন। বৈদিক ধর্মের আচার সর্বস্ব যান্ত্রিকতা বর্জনের তাগিদ এই পর্বের ধর্মভাবনায় যেমন গুরুত্ব পেয়েছিল, তেমনি বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে ঈশ্বরের অনস্তিত্ববাদকেও এঁরা বর্জন করেছিলেন। এই ভক্তি ধর্মদর্শনের কেন্দ্রে ছিলেন একজন ইষ্টদেবতা, যিনি পরম ব্রষ্মের প্রতীক। ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্তব-স্তুতির মধ্যেও দেবতার প্রতি ভক্তির বীজ নিহিত ছিল, কিন্তু সেকালে আচার সর্বস্বতা ও যাগযজ্ঞের প্রাধান্য সেই ভক্তি ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

এই সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল একেশ্বরবাদী চিন্তার জনপ্রিয়তা। উপনিষদে পরমব্রহ্ম কল্পনার মধ্যে এই চিন্তার প্রথম প্রকাশ দেখা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বিভিন্ন অ-বৈদিক লোকায়ত ধর্মবিশ্বাস ও বৈদিক ধর্মের সংমিশ্রণে ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্ম নতুন রূপ নিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই পর্বে ‘হিন্দুধর্ম’ কথাটির প্রয়োগ ইতিহাসসিদ্ধ নয়। কারণ বহুকাল পরে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে আরবগণ শৈব ও বৈয়বদের প্রসঙ্গে ‘হিন্দু ধর্ম” শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন। তবে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ও তার পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বহু নতুন বৈশিষ্ট্য সমাবিষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিতে সাধারণভাবে এখন থেকেই হিন্দুধর্ম কথাটি প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ এই ধর্মমতের প্রবর্তন করেন নি। বহু জটিল দর্শনতত্ত্ব, আচার-বিচার, আরাধনা পদ্ধতি ইত্যাদির সমন্বয়ে হিন্দুধর্মের বিকাশ ঘটেছে। কালে কালে এসেছে নানা সংস্কার ও পরিবর্তন।

উপনিষদের ব্যাখ্যামতে, এই জগতের স্রষ্টা হলেন ব্রহ্মা। ‘সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়’ এই তিন পর্যায়ের পরিচালক রূপে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের সমন্বয়ে সৃষ্টি ‘ত্রয়ী’ কল্পনার মাধ্যমে এই ভাবনা পরিণতি লাভ করেছে। লক্ষণীয় যে, সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় তিনটি প্রাকৃতিক ঘটনা। অর্থাৎ ‘ত্রয়ী’ কল্পনার মধ্যে প্রাকৃতিক আবর্তনের ঘনিষ্ট যোগ আছে। জগতের স্রষ্টারূপে ব্রহ্মার কল্পনা থাকলেও, দেবতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা কম। বিষ্ণু ও শিব তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি প্রাধান্য ও জনপ্রিয়তার অধিকারী। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুসারে ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করলে সেই জগতে বিষুর নিদ্রাভঙ্গ হয়। বিষু উচ্চতম স্বর্গে বাস করেন এবং সেখান থেকে জগৎকে রক্ষার কাজ পরিচালনা করেন। জগতে অমঙ্গল দেখা দিলে বিষ্ণু নানা রূপে বা অবতার রূপে ধরায় অবতীর হন। মৎস অবতার রূপে মনু ও ঋষিগণকে প্রবল বন্যা থেকে রক্ষা করা, বরাহ অবতার রূপে হিরণাক্ষ নামক দৈত্যর আক্রমণ থেকে জগতকে রক্ষা করা, হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে প্রহ্লাদকে রক্ষা করার জন্য নরসিংহ রূপ ধারণ ইত্যাদি কল্পনা বিষুর ‘জগতরক্ষক’ রূপ ও ভূমিকার দৃষ্টান্ত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজা রামচন্দ্র এবং কৃষ্ণ ও বিষুর অবতার রূপে বন্দিত হন।

ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মে দেবদেবীর পাশাপাশি ঋষিরাও পূজিত হতেন। এই প্রসঙ্গে সপ্তর্ষি বা সপ্তঋষির নাম উল্লেখ্য। এঁরা হলেন মারীচ, অত্রি, অঙ্গরম, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রুতু এবং বশিষ্ট। এছাড়াও কশ্যপ, দক্ষ, বিশ্বামিত্র, বৃহস্পতি ও অগস্ত্য মুনিও দেবতার স্থানে আসীন হতে পেরেছিলেন। বিভিন্ন প্রাণী ও বৃক্ষ পুজাও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গীভূত ছিল। প্রাণীদের মধ্যে গোমাতার স্থান সর্বোচ্চে। সুরভিকে সব গরুর জননী মনে করা হয়। ‘পঞ্চগব্য’ অর্থাৎ গোজাত দ্রব্য ধর্মাচরণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। গরু ছাড়া ‘সাপ’ ও উপাস্য ছিল। বাসুকি নাগ, শেষ নাগ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বহু জনপ্রিয় কাহিনীর অবতারণা এদের গুরুত্ব সূচিত করে। প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থে হনুমানকেও দেবতার অংশ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। প্রকৃতি পুজাও ব্রাহ্মণ্য ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী দেবী রূপে পূজা পান। গঙ্গা নদীকে শিবের জটা থেকে সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। সরস্বতী অন্তঃসলিলা। মনে করা এই পবিত্র জলধারাও গঙ্গা, যমুনার সাথে মিলিত হয়ে বিশ্বজগতকে রক্ষার কাজে রত আছে। গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল প্রয়াগ (এলাহাবাদে) পবিত্র স্থান হিসেবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।

বলাবাহুল্য কঠোর বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রয়োগ বহাল রাখার প্রবণতা এই কালেও সক্রিয় ছিল। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রে ছিল চতুবর্ণ ও চতুরাশ্রম প্রথা। ধর্মশাস্ত্রে রাজাকে সতর্ক করা হয়েছে যে, বর্ণাশ্রম প্রথা অটুট রাখা তাঁর অন্যতম পবিত্র কর্তব্য। এই বর্ণবিভক্ত সমাজ অটুট রাখার জন্য জন্মগত শুদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সবর্ণে এবং ভিন্ন গোত্রে বিবাহকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনার কাজে স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণগুলির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৈষুব, শৈব, শাক্ত সবাই তাদের ব্যবহারিক জীবনে স্মৃতিশাস্ত্রের বিধি-বিধান ও অনুশাসন মেনে চলতেন। স্মৃতিশাস্ত্রের বক্তব্যে সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। কোনো স্মৃতিশাস্ত্রেই কোন বিশেষ ধর্মমত বা উপাসনা পদ্ধতির প্রতি পক্ষপাত করা হয়নি। স্মৃতিশাস্ত্রগুলির মধ্যে সর্বাধিক পুরানো এবং তুলনামূলকভাবে বেশি প্রামাণ্য গ্রন্থটি হল ‘মনুস্মৃতি’। একমাত্র মনুস্মৃতিতেই কিছু ধর্মীয় তত্ত্ব ও দার্শনিক চিন্তা আলোচিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, মনু নির্দিষ্ট কোন ঈশ্বরের কথা বলেন নি, যিনি জীব জগতকে নির্দেশ দেন। তিনি মানুষের ‘আত্মজ্ঞান’ অর্জনকেই মুক্তির (মোক্ষ) উপায় বলে মনে করেন। এজন্য সৎ আচার, সৎ জীবন যাপন এবং বিবেকসম্পন্ন হতে পরামর্শ দিয়েছেন। এককথায়, অহিংসা, অস্তেয়, সত্য ও অপরিগ্রহ’কে ধর্মসঙ্গত জীবন যাপনের উপায় বলে গণ্য করেছেন। ঈশ্বরের করুণা লাভের জন্য জ্ঞান, ভক্তি ও জপকেই মনু প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্যান্য স্মৃতিশাস্ত্রের তত্ত্বকথায় মনুস্মৃতিরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।

স্মৃতিশাস্ত্রের থেকেও জনপ্রিয় আদি ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ‘পুরাণসমূহ’ এগিয়ে আছে। পুরাণের সংখ্যা আঠারো। তবে এদের রচনাকাল স্পষ্ট নয়। অনুমান করা হয় যে, একদা চারণ কবিরা পুরাণের কাহিনী প্রচার করেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা পুরাণ গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে কয়েকটি প্রধান পুরাণ গ্রন্থ যেমন, বায়ুপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ইত্যাদি রচিত হয়েছিল। পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে অন্যান্য পুরাণগুলি সংকলিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের ধর্মভাবনা ও ধর্মাচার সম্পর্কে পুরাণগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমানে যা ‘হিন্দুধর্ম’ নামে অভিহিত হয় তার ভিত্তি হল পুরাণসমূহ। প্রাচীন বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের পরিবর্তে পুরাণ সাহিত্য হিন্দুধর্মের মুখপত্র হিসেবে গুরুত্ব পায়। নানা দেবদেবীর গৌরব কাহিনী, তাঁদের কীর্তির সাথে বিজড়িত স্থানসমূহের নাম, তাঁদের পুজা পদ্ধতি ইত্যাদি পুরাণগ্রন্থে পাওয়া যায়। এই কারণে হিন্দুধর্ম ‘পৌরাণিক হিন্দুধর্ম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে পুরাণের আলোচ্য বিষয় নিছক তত্ত্বকথা বা তত্ত্ববহুল নয়। এগুলিতে দেবদেবীদের দৈনন্দিন জীবনের নানা রসালো কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সম্ভবত জটিল দর্শনতত্ত্বের পরিবর্তে ধর্মের মূল ভাবনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি করার প্রয়োজনে এই সকল নাটকীয় ও আকর্ষণীয় কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। পৌরাণিক হিন্দুধর্মের প্রসারের ফলে আগেকার প্রধান দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মার গুরুত্ব অনেকটাই কমে যায়। ‘ত্রয়ী’ কল্পনায় ব্রহ্মার স্থান থাকলেও কিংবা পদ্মপুরাণে তাঁর গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস থাকলেও, শিব বা বিষুর তুলনায় তাঁর স্থান ও জনপ্রিয়তা ছিল নগণ্য। সিন্ধুদেশ থেকে বাংলার মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে কিছু ব্রহ্মামূর্তি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ব্রহ্মা দেবতা হিসেবে পূজা পেতেন। তবে পারিবারিক দেবতা রূপেই তাঁর আরাধনা হত। বিষু, শিব প্রমুখ মন্দিরে অধিষ্ঠিত থেকে যে রাজকীয় পূজাচর্নার অধিকারী ছিলেন, ব্রষ্মার ক্ষেত্রে তা ছিল না।

পৌরাণিক হিন্দুধর্মে দেবতা হিসেবে সূর্যের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভবিষ্যপুরাণে সূর্যের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। শাম্বপুরাণ, বরাহপুরাণেও সূর্যদেবতার জনপ্রিয়তার উল্লেখ আছে। তবে খ্রিষ্টপূর্ব কালে সূর্য-উপাসক বা সৌরীয়দের অস্তিত্ব ছিল কিনা বলা কঠিন। গুপ্তযুগ ও পরবর্তীকালে সূর্য উপাসনার জনপ্রিয়তা দেখা যায়। মূলত পশ্চিম ভারতে আড়ম্বরপূর্ণ সূর্য মন্দিরের অস্তিত্ব আছে। মান্দাশোর লেখ, ইন্দোর তাম্রশাসন প্রভৃতি লেখতে সূর্যমন্দির প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ আছে। পুষ্যভূতি রাজা হর্ষবর্ধন তাঁর পঞ্চবার্ষিক ধর্ম সম্মেলনে একদিন সূর্য পূজার আয়োজন করতেন। হর্ষের নানা লেখতে তাঁর পূর্ব পুরুষদের ‘পরমাদিত্য ভক্ত’ বলা হয়েছে। বলভির শাসকদের কেউ কেউ সূর্যের উপাসক ছিলেন। ক্রমে উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতেও সূর্য পুজার প্রচলন জনপ্রিয় হয়েছিল। পশ্চিম ও উত্তর ভারতের সূর্য পুজায় শক্-পার্থিয়দের উদ্যোগে পারসিক প্রভাব পড়েছিল। তৎকালীন ভাস্কর্যে এর প্রতিফলন দেখা যায়। ভূমরের শিব মন্দিরের মধ্যে একটি রিলিফে সূর্য মূর্তির অবস্থান আছে। প্রস্তর নির্মিত এই মূর্তির মাথায় আচ্ছাদন, গায়ে আজানুলম্বিত কোর্ট এবং পায়ে বুট জুতো পরিহিত। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের সূর্য মূর্তি ভারতীয় ধারানুযায়ী নগ্নপদ বিশিষ্ট। কুর্মপুরাণের একটি স্তোত্রে (সূর্যহৃদয়) সূর্যকে শ্রেষ্ঠ দেবতা বলা হয়েছে। এখানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের সাথে সূর্যকে সমগুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

গণেশ বা গণপতি ‘গণ’ বা Tribe-এর দেবতা, গণেশের অনুগামীরা গাণপত্য সম্প্রদায় নামে পরিচিত। ঋগ্বেদেও এই দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি স্তোত্রে বলা হয়েছে ‘গণানাং ত্বাং গণপতিং হবাহমে’। এর দ্বারা ইন্দ্রকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ তিনি ছিলেন গণপতি। পুরাণ মতে, গণেশ আদিতে ছিলেন অমঙ্গলের দেবতা, পরে সিদ্ধিদাতায় রূপান্তরিত হন। গণেশের হস্তিমুণ্ড সম্পর্কে নানা মত আছে। একটি মতে, গণেশ আদিতে ছিলেন রুদ্রদেব। কোন কিছুতে তাঁর দৃষ্টি পড়লে তার ক্ষতি হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। পরবর্তীকালে শনিদেবের দৃষ্টিতে গণেশের মুণ্ডু উড়ে যায়। তখন তার ধড়ের উপর গজমুণ্ড বসিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর গণেশের রুদ্ররূপ তিরোহিত হয় এবং তিনি সিদ্ধিদাতায় পরিণত হন। অন্য একটি মতে, আদিম টোটেমবাদ অনুসারে গণেশও কোন একটি শক্তিশালী ট্রাইব-এর মূখ্য দেবতার প্রতীক ছিলেন। সেই ট্রাইবের ‘টোটেম’ ছিল হস্তী, তাই গণেশ হস্তীমুণ্ড বিশিষ্ট দেবতা। আজও হিন্দুধর্মে গণেশ দেবতার পূজা সর্বাগ্রে করা হয়। আধুনিক ব্যাখ্যানুযায়ী গণেশ সকল গোষ্ঠীর প্রতীকস্বরূপ। তাই তাঁর আহ্বান ও আরাধনা সবার আগে করা হয়। তবে কিংবদন্তী অনুসারে, পশুমুণ্ড বিশিষ্ট দেবপুত্রকে মানসিক প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে তাঁর আরাধনা আগে করা হয়।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের আগে গণপতি পূজার বিশেষ প্রচলন ছিল না। গুপ্তযুগ ও গুপ্ত পরবর্তীকালে গণেশ পূজার বিস্তৃতি ঘটে। ভারতের পাশাপাশি কম্বোজ, যবদ্বীপ, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশেও গণেশ জনপ্রিয়তা পান। গণেশের প্রাচীনতর মূর্তি পাওয়া গেছে মথুরায়। এই নগ্নমূর্তির হাতে মোদক ভাণ্ড এবং তিনি শুঁড় দিয়ে মোদকপানে রত। দুটি হাত বিশিষ্ট গণেশ মূর্তি খুবই কম দেখা যায়। চতুর্ভুজ গণেশ বেশি। আবার ষড়ভুজ বা অষ্টভুজ মূর্তিও আছে। গণেশ মূর্তিগুলি দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট বা নৃত্যরত অবস্থায় দেখা যায়। পঞ্চম শতকে ভিটরগাঁও (কানপুরের নিকটে)-তে প্রাপ্ত মূর্তিটি কিছুটা অস্বাভাবিক। পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ এই গণেশমূর্তি উড্ডীয়মান। গুপ্তযুগের শেষ দিকে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ভুমারার মন্দিরে দুটি উপবিষ্ট গণেশমূর্তি পাওয়া গেছে। একটি মুর্তি দু’হাত বিশিষ্ট, অন্যটি চতুর্ভুজ। উত্তরবঙ্গের পাহাড়পুরে ধাতু, পাথর ও পোড়ামাটির তৈরি বহু গণেশ মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সময় গণেশ বিঘ্ননাশক ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য আনয়নকারী দেবতা রূপে বিবেচিত হতে থাকেন। নবম শতকে রাজস্থানের নানা লেখতে ব্যবসায়ের দেবতা হিসেবে গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজার এলাকায় গণেশ মূর্তি প্রতিস্থাপনের দৃষ্টান্তও আছে। বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যেও গণেশ জনপ্রিয় ছিলেন। বহির্ভারতেও দেবতারূপে গণেশের পরিচিতি ছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে নির্মিত কম্বোডিয়ার মাইনস নামক স্থানে প্রাপ্ত গণেশ মূর্তিটি দণ্ডায়মান এবং মোদক পানরত।

এযুগে কার্তিকেয় দেবতা রূপে জনপ্রিয় ছিলেন। স্কন্দ-কার্তিকেয় লৌকিক দেবতা, যিনি কালক্রমে পৌরাণিক দেবতা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। আদিতে ইনি ছিলেন কৃষি ও প্রজননের দেবতা, তাঁর পত্নী সন্তান উৎপাদনের দেবী ষষ্ঠী রূপে বন্দিত হন। পৌরাণিক দেবমণ্ডলীর সদস্য হবার পর কার্তিকেয় দেব সেনাপতি হিসেবে গণ্য হন। তাঁর জন্ম কাহিনী কালিদাসের কুমার সম্ভব কাব্যের মূল বিষয়। তারকাসুরকে বধ করে কার্তিকেয় দেবকুলকে রক্ষা করেন। কদম্ববংশীয় রাজারা এবং যোধেয়গণ কার্তিকেয় পূজা করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পতঞ্জলি কার্তিকেয় এবং শিবের সংযোগের কথা বলেছেন। কুষাণ রাজা হুবিদ্ধের মুদ্রায় কার্তিকেয়, স্কন্দ, কুমার, মহাসেন প্রমুখের মূর্তি পাওয়া গেছে। মহাভারতেও স্কন্দ-কার্তিকেয়র উল্লেখ আছে। গুপ্তযুগে শিব ও বিষ্ণু দেবতার পাশে কার্তিকেয় স্থান করে নিতে সক্ষম হন। প্রথম কুমারগুপ্তের একটি স্বর্ণমুদ্রায় ময়ূরবাহন কার্তিকেয় উৎকীর্ণ দেখা যায়। প্রথম কুমার গুপ্ত তাঁর প্রতীক হিসেবে গড়ুরের পরিবর্তে কার্তিকেয়র বাহন ময়ূরকে গ্রহণ করেছিলেন। উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের উভয় অংশেই দেবতারূপী কার্তিকেয়র পরিচিতি ছিল।

পঞ্চোপাসনার :

বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মদর্শন ব্যাপক সাড়া জাগালেও, তাদের জনপ্রিয়তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই দু’টি ধর্মের অনুগামীরা আজও ভারতে এবং ভারতের বাইরে রয়েছেন। কিন্তু খ্রিষ্টীয় শতকের প্রায় শুরু থেকেই এই সকল ধর্মমত তাদের সামাজিক কর্তৃত্বের আসন থেকে সরে যেতে শুরু করেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ভারতে ভক্তিবাদ ভিত্তিক ধর্মের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বৈদিক ধর্ম ছিল জ্ঞানপ্রধান। উপনিষদের যুগে ধর্ম হয় কর্মপ্রধান। এখন তা হয়ে ওঠে ভক্তিপ্রধান। এই সময় মহাজ্ঞানী ঋষিকুল উপলব্ধি করেন যে, ধর্ম ও শাস্ত্রকে ভক্তিরসে জারিত করে প্রচার করতে না পারলে সমাজকে ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে না। বস্তুত উপনিষদের যুগেই নির্গুণ ব্রহ্ম থেকে সগুণ ব্রশ্নের ধারণা রূপ পেতে শুরু করেছিল। শাণ্ডিল্য ঋষি এই ভক্তিমার্গকে গ্রহণ করে ধর্মশাস্ত্রে ভক্তিবাদকে উচ্চাসন দান করেন। এই বিচারে ভক্তিধর্মকে বেদ ও উপনিষদ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধারণা মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। বলা যায়, অবতারবাদ ও প্রতিমা পূজার প্রচলন ছিল বেদ ও বেদান্তের চূড়ান্ত পরিণত পর্যায়।

ভারতে ধর্মচিন্তার এই পরিণত পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ইত্যাদির পরিবর্তে ‘হিন্দুধর্ম’ পরিভাষাটি ব্যাপকতর ব্যবহার পেয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে, ‘হিন্দু’ শব্দটি ধর্ম বা জাতিবাচক নয়, ভৌগোলিক অবস্থান বোঝাতে বিদেশীরা এই শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। উচ্চারণগত পরিবর্তন সাপেক্ষে ‘হিন্দু’ কথাটি বাস্তবতা পেয়েছে এবং ভারতের ভৌগোলিক পরিমণ্ডল (হিন্দুস্তান) এবং সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের (হিন্দুস্তানী বা হিন্দুস্থানী) বোঝাতে শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। কালক্রমে ভারতীয়দের ধর্ম বোঝাতেও শব্দটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। উদ্ভব হয়েছে হিন্দুধর্ম শব্দটির। এই প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, “হিন্দু শব্দটির তাৎপর্য ভৌগোলিক যা ভারতবর্ষ নামক সমগ্র উপমহাদেশটিকেই সূচিত করে। সেই হিসাবে ব্যাপক অর্থে ভারতে উদ্ভূত যে-কোন ধর্মকেই হিন্দুধর্ম আখ্যা দেওয়া যায়।” হিন্দুধর্মকে একটি বহমান নদীর সাথে তুলনা করে শ্রীভট্টাচার্য লিখেছেন যে দীর্ঘ অতীত থেকে ভিন্ন ভিন্ন উৎসজাত অসংখ্য রীতি-নীতি, দেবদেবী, উপাসনা পদ্ধতি, দর্শন তত্ত্ব, সাধন পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান উপনদীর মতই সৃষ্টি হয়ে সমাজ জীবনে সক্রিয়তা পেয়েছে, আবার কখনো বা সমন্বিত হয়ে সৃষ্টি করেছে নতুনতর জীবনবোধ, জীবনচর্চা। এই কারণে হিন্দুধর্মকে ‘সনাতন ধর্ম’ আখ্যা দেওয়া যায়।

বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর অনুসৃত ধর্ম পাঁচটি ধারায় বিভক্ত–বৈয়ব, শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য। এদের একত্রে বলা হয় পঞ্চোপাসনা। এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের মধ্যে আচার অনুষ্ঠানগত কিছু স্বাতন্ত্র্য্য অবশ্যই আছে। তবে এদের দর্শনতত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের পরিমাণই বেশি। যেমন—(১) প্রতিটি ধর্মমতই ভক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাহ্যিক কিছু আচারগত স্বাতন্ত্র্য থাকলেও, সবকটি ধর্মেই পরম শক্তিমান ঈশ্বরের কাছে সর্বাঙ্গীণ আত্মসমর্পণ দ্বারা তাঁর সান্নিধ্য লাভের কথা বলা হয়েছে। (২) প্রাক্-বৈদিক যুগের দেবদেবীকে অবলম্বন করেই প্রতিটি ধর্মের ঈশ্বরতত্ত্ব দানা বেঁধেছে। (৩) প্রত্যেকেই বেদান্তের ঈশ্বরবাদী ব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। (৪) প্রতিটি ধর্মের একজন মুখ্য উপাস্য দেবতা আছেন। কিন্তু অন্যান্য দেবতাদের সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা হয়নি। শিব শক্তি, হরি-হর, শিব-সূর্য, বিষু-সূর্য ইত্যাদি যুগ্মদেবতার কল্পনা সমন্বয়বাদী চেতনার প্রকাশ। (৫) পাঁচটি উপাসনা পদ্ধতিতে মন্ত্র, তন্ত্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে একই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। (৬) পাঁচটি উপাসনা পদ্ধতিতেই ব্রশ্নের সাথে চিদাচিদের সম্পর্ক দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তাত্ত্বিক প্রবক্তাগণ বেদান্তের ‘ত্রিত্ববাদ’কে আশ্রয় করে নিজ নিজ তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন। বেদান্ত কথিত, ঈশ্বর বা পরমাত্মা (ব্রষ্মা); জীবাত্মা অর্থাৎ চেতনজীব, মূলত মানুষ (চিৎ) এবং অচেতন বা জড় বস্তু (অচিৎ)—এই ত্রিতত্ত্ব প্রতিটি সম্প্রদায়ের দার্শনিক ভিত্তি।

পঞ্চোপাসনা বা ভক্তিধর্মের কেন্দ্রে আছেন একজন ইষ্টদেবতা। এই ইষ্টদেবতা পরম ব্রহ্মের প্রতীক বা ঈশ্বর। বিভিন্ন দেবতা সেই পরম ব্রহ্মের ভিন্ন ভিন্ন রূপ কল্পনা। এঁরা কেউই একক ভাবে পরম ব্রষ্মের প্রকাশ নয়। এই পরম ব্রহ্মের কাছে আত্মসমর্পণমূলক ভক্তি বা প্রেম দ্বারা তাঁর অনুগ্রহ বা প্রসাদ লাভ করা যেতে পারে। এই প্রসাদ লাভের মাধ্যমে জীবের মুক্তিলাভ সম্ভব। ভক্তিবাদ ঋগ্বেদের বিভিন্ন স্তোত্রে উচ্চারিত হত। কিন্তু ধর্মীয় দর্শন হিসেবে সেকালে ভক্তিতত্ত্ব গুরুত্ব পায়নি। উপনিষদের বক্তব্যে ভক্তিবাদ তত্ত্ব গুরুত্ব পায়। উপনিষদের ‘উপাসনা’ বিষয়ক ধারণা ভক্তিতত্ত্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ‘আত্মা’কে পরম ঈশ্বরের সাথে অভিন্ন রূপে কল্পনা করা হয়। পুত্র-পরিজন, বিত্ত-সম্পদ ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে আত্মাকে স্থান দেওয়া হয়। আত্মার সন্তুষ্টি ইষ্টদেবতার তুষ্টির সমতূল্য এই ধারণাকে কেন্দ্র করে ভক্তি ধারার বিকাশ ঘটতে থাকে। আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি ভক্তিবাদের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কেবল আত্মসমর্পণ নয়, ব্রষ্মজ্ঞান সমৃদ্ধ আত্মসমর্পণ দ্বারাই ইষ্টের সন্তুষ্টি বিধান সম্ভব।

খ্রিষ্টপূব; প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে রচিত ‘ভগবদ্গীতা’ ভক্তিবাদী ধর্মতত্ত্বের মূল ভিত্তি। এখানে ভক্তিতত্ত্বের প্রবক্তা শ্রীকৃষ্ণ। তিনি এক বিশেষ উপাসনা পদ্ধতির কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও অন্যান্য চারটি উপাসনা পদ্ধতির ভিত্তি হিসেবে ভগবদ্গীতার গুরুত্ব স্বীকৃত। এখানে ফলের প্রত্যাশা-বিমুক্ত কর্মের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কর্মযোগী জ্ঞান তথা ভক্তির পথে আত্মাতে বিশ্বকে এবং বিশ্বে আত্মদর্শন করতে সক্ষম হয়। ভক্তিবাদীতত্ত্বের দ্বিতীয় সূত্রটি হল ভাগবতপুরাণ। এটি বৈষুবধর্ম তত্ত্বের ভিত্তি। তবে মধ্যযুগের ভারতে ভক্তিবাদের উৎস হিসেবে এই গ্রন্থের প্রেরণা সর্বাধিক। এছাড়া নারদীয় ভক্তিসূত্র এবং শাণ্ডিল্য ভক্তিসূত্র গ্রন্থ দুটিতেও ভক্তিমার্গের স্বরূপ ও অনুশীলন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। নারদসূত্রে পরমেশ্বর কি রূপে বিষুর কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ঋষি শাণ্ডিল্য নির্গুণ ভক্তির উপর জোর দিয়েছেন। তাই পরমেশ্বর স্বরূপ কোন বিশেষ দেবতার প্রতি আত্মসমর্পণের পরামর্শ তিনি দেন নি। আবার নারদ ভক্তি অনুশীলনের অন্যতম মার্গ হিসেবে শ্রবণ, কীর্তন ইত্যাদি কর্মের কথা বলেছেন। কিন্তু শাণ্ডিল্য সূত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ঐকান্তিক ভক্তি ও ভক্তের নীরব আত্মনিবেদনের উপর।

ভারতে একেশ্বরবাদী ধর্মকে সাধারণভাবে ভাগবত ধর্ম নামে অভিহিত করা হত। তবে ভাগবত ধর্ম বলতে কেবল বৈয়ব ধর্মকেই বোঝাত না। শৈবধর্মের বিশেষণ হিসেবেও ভাগবত শব্দটি প্রযুক্ত হয়ে ‘শৈব-ভাগবত’ কথাটির প্রচলন ছিল।

বৈষুব ও শৈব-এই দুটি প্রধান একেশ্বরবাদী ভক্তিধর্মের সাথে রাজশক্তির ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি লক্ষণীয়। রাজা নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বা প্রতিনিধি রূপে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে তাঁর প্রতি গণ আনুগত্যের বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাস ও ভক্তি তত্ত্ব দ্বারা এক রাজার প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা প্রচার করা সহজ হত। গুপ্ত বংশীয় রাজারা এবং সপ্তম শতকীয় ভারতে গড়ে ওঠা অসংখ্য আঞ্চলিক রাজ্যের রাজারা শিব কিংবা বিষুর পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা নিজেদের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করার জন্য বৈষুব ও শৈবধর্মের নেতারাও তাঁদের তাত্ত্বিক ভিত্তি পাল্টে ফেলতে দ্বিধা করেননি। প্রাথমিক ভাবে এঁরা সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতি-প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। পরিস্থিতিগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁরাও পুরাতন দর্শন থেকে সরে আসেন এবং বেদান্তের একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যার উপর নিজেদের দর্শনতত্ত্বকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন।

একেশ্বরবাদের সাথে ত্রিতত্ত্ববাদ যুক্ত করে বৈষুব ও শৈবধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের রূপরেখা তৈরি করলেও, এরা কখনই লৌকিক উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে পারেনি।