অথবা, পৌরনীতির সংজ্ঞা দাও।
ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক জীব। স্বভাবতই মানুষ নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে পারে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ও স্নেহ-প্রেম-প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ জন্যই মানুষ আপনজনদের নিয়ে একত্রে বাস করতে চায়। স্নেহ ও ভালোবাসা প্রত্যাশী মানুষ সঙ্গপ্রিয়তার জন্যই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চায়। সমাজ ছাড়া সে বাস করতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল এজন্যই বলেছেন, “মানুষ স্বভাবতই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব এবং যে সমাজে বসবাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু।” (Man is by nature a social and political animal and a man who is not a member of a society is either a God or a beast.)
প্রাচীন যুগের মানুষ ফলমূল সংগ্রহ, পশু শিকার এবং অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহের জন্য সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করতো, ঘুরে বেড়াত। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের ফলে সভ্যতার অগ্রগতি সাধিত হলেও মানুষের মধ্যে এখনো সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার সেই প্রবণতা এতটুকু কমে যায়নি। আজও মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
সুদূর অতীতে সমাজবদ্ধ মানুষের নাগরিক জীবনকে কেন্দ্র করে কতগুলো নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি প্রচলিত ছিল। বর্তমান সময়েও দেখা যায়, সমাজবদ্ধ মানুষের নাগরিক জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান। নাগরিক জীবনের এসব দিক নিয়ে আলোচনার জন্য তাই গড়ে উঠেছে জ্ঞানের এক বিশেষ শাখা, যা আজ CIVICS বা ‘পৌরনীতি’ বলে পরিচিত। এজন্য পৌরনীতিকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞানও বলা হয়। পৌরনীতি ও সুশাসন মূলত একটি সামাজিক বিজ্ঞান।
পৌরনীতির ধারণা ও সংজ্ঞা (Concept and Definition of Civics):
শাব্দিক পরিচয়ঃ ইংরেজি ‘সিভিক্স’ (Civics) শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘পৌরনীতি’। ‘সিভিক্স’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘সিভিস’ (Civis) এবং ‘সিভিটাস’ (Civitas) থেকে। ‘সিভিস’ এবং ‘সিভিটাস’ শব্দের অর্থ যথাক্রমে ‘নাগরিক’ ও ‘নগররাষ্ট্র’ (City State)। সুতরাং শব্দগত অর্থে ‘সিভিক্স’ বা পৌরনীতি হলো নগররাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের আচরণ ও কার্যাবলি সংক্রান্ত বিজ্ঞান। প্রাচীন ভারতবর্ষ ও গ্রিসে শব্দগত বা মূলগত অর্থেই পৌরনীতিকে নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কিত বিষয় বলে মনে করা হতো।
সংস্কৃত ভাষায় নগরকে ‘পুর’ বা ‘পুরী’ এবং নগরের অধিবাসীদেরকে বলা হয় ‘পুরবাসী’। এ জন্যই নাগরিক জীবনের অপর নাম ‘পৌর জীবন’ এবং নাগরিক জীবন সম্পর্কিত বিদ্যার নাম ‘পৌরনীতি’।
পারিভাষিক পরিচয়ঃ প্রাচীন গ্রিসে এক একটি নগর ছিল এক একটি রাষ্ট্র। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স, স্পার্টা প্রভৃতি নগর-রাষ্ট্রগুলোর আয়তন ও জনসংখ্যা ছিল সীমিত। নগর-রাষ্ট্রের সকল সদস্যকে নাগরিক বলা হতো না। নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে শুধু যারা রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতো অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতো শুধু তাদেরকেই ‘নাগরিক’ বলা হতো। নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করা হতো পৌরনীতিতে। সুতরাং শব্দগত বা মূলগত অর্থে পৌরনীতির অর্থ ছিল অনেকটা সীমিত ও সংকীর্ণ।
কিন্তু বর্তমানে পৌরনীতিকে শুধুমাত্র শব্দগত অর্থে আলোচনা করা হয় না। কেননা, আধুনিক রাষ্ট্রগুলো প্রাচীন গ্রিসের ‘নগররাষ্ট্র’ (City state) নয়, বরং এগুলো এখন ‘জাতি রাষ্ট্র’ (Nation state)। প্রাচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষা আধুনিক জাতি রাষ্ট্রগুলো আয়তনে যেমন বিশাল, জনসংখ্যা তেমনি বিপুল। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে (Nation State) নাগরিকের ধারণাও পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে নাগরিক হলো সেই ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন, রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন এবং রাষ্ট্র স্বীকৃত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করেন৷ এসব জাতি রাষ্ট্রে নাগরিকদের জীবন এবং কার্যাবলি বহুমুখী ও জটিল। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের আচরণ, কার্যাবলি এবং তাদের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারাবাহিক পর্যালোচনার মাধ্যমে যে শাস্ত্র আদর্শ নাগরিক জীবনের ইঙ্গিত দান করে, তাই হলো ‘সিভিক্স’ বা ‘পৌরনীতি’। পৌরনীতি মূলত সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
এফ. আই. গ্লাউড (F. I. Gloud)-এর মতে, “যে সকল প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস, কার্যাবলি ও চেতনার দ্বারা মানুষ রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন এবং অধিকার ভোগ করতে পারে, তার অধ্যয়নই হচ্ছে পৌরনীতি। (“Civics is the study of institutions, habits, activities and spirit by means of which a man or woman may fulfil the duties and receive benefits of membership in a political community”.)
ই. এম. হোয়াইট (E. M. White)-এর মতে, “নাগরিকতার সাথে জড়িত সকল প্রশ্ন সম্পর্কে যে শাস্ত্ৰ আলোচনা করে, তাই পৌরনীতি।” (“Civics is the subject that deals with everything appertaining to citizenship.”)
ই. এম. হোয়াইট তার “The philosophy of citizenship” গ্রন্থে আরও বলেছেন যে, “পৌরনীতি হচ্ছে জ্ঞানের সেই শাখা, যা নাগরিকতার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও মানবতার সাথে জড়িত সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।” (“Civics is that branch of human knowledge which deals with everything relating to a citizen past, present and future; local, national and human.”)
Webster’s International Dictionary-তে পৌরনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, “পৌরনীতি হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই বিভাগ বা শাখা যা নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করে” (Civics is that department of political science dealing with rights and duties of citizen.)।
Encyclopedia Britanica-তে পৌরনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, “পৌরনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা বলে অভিহিত করা যায়, যেখানে সরকারের সংগঠন ও পদ্ধতি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ আলোচনা করা হয়।”
ফ্রেডরিখ জেমস গুল্ড (Fredrick James Gould)-এর মতে, “পৌরনীতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, আচরণ ও চেতনার অধ্যয়ন শাস্ত্র, যার মাধ্যমে একজন পুরুষ বা নারী কর্তব্য পালন ও সুযোগ সুবিধা ভোগ সম্পর্কে জানতে পারে।” (Civics is the study of institutions, habits and spirits by means of which a man or woman may fulfil the duties and receive the benefits of memberships in the political community.)
পৌরনীতির সংজ্ঞা থেকে এর যে অর্থ ও প্রকৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা নিম্নের চার্ট দ্বারা প্রকাশ করা হলোঃ
উপসংহারঃ উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, নাগরিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের যে শাখা আলোচনা করে তাকে পৌরনীতি বলে। পৌরনীতি নাগরিক হিসেবে মানুষের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা, মানুষের কার্যাবলি, অভ্যাস ও আচরণ বিশ্লেষণ এবং রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি পর্যালোচনার আলোকে আদর্শ নাগরিক জীবন গঠনের শিক্ষা দান করে।
Leave a comment