প্রশ্নঃ পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর। 

ভূমিকাঃ  পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, তার প্রায় সকল দিক নিয়েই পৌরনীতি আলোচনা করে। পৌরনীতি ও সুশাসন হচ্ছে জ্ঞানের মূল্যবান শাখা। 

পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের প্রয়োজনীয়তা (The Necessity of Study of Civics & Good Governance): পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিম্নরূপঃ 

১. পৌরনীতি ও সুশাসন সুস্থ ও সুন্দর সমাজজীবন গঠনের শিক্ষা দান করেঃ ইতিহাস যেমন মানুষের অতীত ও বর্তমান নিয়ে আলোচনা করে এবং ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে; অর্থনীতি যেমন মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সমস্যা এবং জীবনের মানোন্নয়নের উপায় সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে; পৌরনীতি তেমনি গড়ে ওঠেছে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে। কীভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বারা সুস্থ ও সুন্দর সমাজজীবন গঠন করা যায়, জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করা যায়; সে সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে।

২. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা সম্পর্কীয় জ্ঞান দান করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের ফলে সুদূর অতীতে কীভাবে নাগরিক জীবনের সূত্রপাত হলো, তখন নাগরিকতার স্বরূপ কী ছিল; আধুনিক যুগে নাগরিকতা বলতে কী বোঝায়, কীভাবে তা অর্জিত হয় এবং বিলুপ্তি ঘটে—নাগরিকতা সম্পর্কিত এরূপ বিভিন্ন দিক জানা যায়।

৩. পৌরনীতি ও সুশাসন সুনাগরিকতার শিক্ষা দান করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের ফলে নাগরিকগণ বুদ্ধিমান, আত্মসংযমী, বিবেকবান, নিষ্ঠাবান হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে সামাজিক স্বার্থকে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে। পৌরনীতির জ্ঞান মানুষকে সুসভ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

৪. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি উদার করেঃ সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ নির্ভর করে নাগরিকের স্বচ্ছ, উদার ও সুষ্ঠু দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠে মানুষের মনের গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, সংকীর্ণতা, দীনতা, কুসংস্কার, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি দূর হয় এবং দৃষ্টিভঙ্গি উদার ও প্রসারিত হয়।

৫. বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের অতীত জানতে সাহায্য করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন অধ্যয়ন করে মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব, আইন, স্বাধীনতা, সাম্য প্রভৃতির উৎপত্তি বা অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। অতীতে এ সকল প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের প্রকৃতি কীরূপ ছিল তা না জানলে ভবিষ্যতে এগুলোর সাংগঠনিক রূপ কীরূপ হওয়া উচিত তা অনুমান বা কল্পনা করা সম্ভব নয়।

৬. বিভিন্ন সংগঠনের বর্তমান অবস্থা জানতে সাহায্য করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠ করলে কোন্ দেশের জন্য কীরূপ সংবিধান ও সরকার উপযোগী, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রকৃতি ও কার্যাবলি; নির্বাচকমণ্ডলীর প্রকৃতি ও গুরুত্ব; জনমতের প্রকৃতি, গুরুত্ব ও জনমত গঠনের মাধ্যমসমূহ; রাজনৈতিক দলের প্রকৃতি, কার্যাবলি ও গুরুত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারা যায়।

৭. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিক চেতনা বৃদ্ধি করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অতীত ও বর্তমান, এগুলোর বর্তমানে প্রকৃতি, কার্যাবলি ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে। এর ফলে এই শাস্ত্র পাঠে মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞান ও নাগরিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।

৮. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিককে অধিকার সচেতন করেঃ মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য কিছু কিছু সুযোগ- সুবিধা বা অধিকার একান্ত প্রয়োজন। পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠের ফলে নাগরিকগণ তাদের এসব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সম্পর্কে অবহিত ও সচেতন হতে পারে।

৯. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের কর্তব্যবোধ জাগ্রত করেঃ অধিকারের ধারণার মধ্যেই কর্তব্যের ধারণা নিহিত থাকে। প্রত্যেক নাগরিককে তার কর্তব্য কী কী, কেন কর্তব্য পালন করতে হয়, অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক কী এসব সম্পর্কে জানতে হয়। পৌরনীতি ও সুশাসন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং ব্যক্তিকে অধিকার উপভোগের পাশাপাশি কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করে।

১০. পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি করেঃ গণতন্ত্র সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হলেও তা বাস্তবায়ন করা কষ্টকর। পৌরনীতি ও সুশাসন গণতন্ত্রের প্রকৃতি, প্রকারভেদ, দোষ-গুণ, এর সফলতার শর্তাবলি সম্পর্কে আলোচনা করে। এর ফলে জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।

১১. পৌরনীতি ও সুশাসন আন্তর্জাতিক দিগন্ত উন্মোচন করেঃ বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী, কাছাকাছি হচ্ছে বিশ্বের মানুষ। মানুষ আজ জাতিসংঘের মতো অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তুলেছে। এই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃতি, সংগঠন, কার্যাবলি, সফলতা-ব্যর্থতা ইত্যাদি সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে থাকে। ফলে এসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে মানুষের আচরণ ও কার্যাবলি কীরূপ হওয়া উচিত তা জানতে পৌরনীতি ও সুশাসন সাহায্য করে।

১২. পৌরনীতি ও সুশাসন ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করেঃ পৌরনীতি ও সুশাসন অধ্যয়নের দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের উৎপত্তি, সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যাবলি, নাগরিকতা, অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ভবিষ্যতে এগুলো কীরূপ পরিগ্রহ করবে বা করা উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হবে এবং ভবিষ্যতে তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।

১৩. বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনঃ অতীতে দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে বিশ্বশান্তি বিনষ্ট করেছে। বিশ্বের শান্তিকামী নেতাগণ কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, জাতিসংঘ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলেছে, আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তুলেছে এবং এসব সংগঠন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা পালন করছে, পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠ করে তা জানা যায়৷

১৪. দেশপ্রেম বৃদ্ধির শিক্ষাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন পাঠ করার ফলে নাগরিকদের দেশপ্রেম বৃদ্ধি পায়। এর ফলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একজন নাগরিক প্রয়োজনে জীবন দান করতেও কুণ্ঠিত হয় না।

১৫. সুযোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার শিক্ষাঃ নেতৃত্ব কী, কীভাবে নেতৃত্ব লাভ করা যায়, নেতৃত্বের আবশ্যকীয় গুণাবলি কী কী, নেতৃত্ব অর্জনে সমস্যা কী কী, কীভাবে সেসব সমস্যা দূর করা যায়, এসব বিষয় নিয়ে পৌরনীতি আলোচনা করে থাকে। ফলে পৌরনীতি ও সুশাসনের জ্ঞান সুযোগ্য নেতৃত্ব বিকাশে সাহায্য করে থাকে।

উপসংহারঃ সুতরাং ওপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসন অধ্যয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। সুন্দর ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে তোলা এবং সুনাগরিকতার শিক্ষা অর্জন করতে হলে পৌরনীতি ও সুশাসনের জ্ঞান অর্জন করা খুবই প্রয়োজনীয়।