প্রশ্নঃ পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন মূলত নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। নাগরিকের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যাবলিই পৌরনীতি ও সুশাসনের মুখ্য আলোচ্য বিষয়। পৌরনীতি ও সুশাসনের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নাগারকের জীবন ও কার্যাবলি যতদূর বিস্তৃত, অর্থাৎ যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, পৌরনীতির বিষয়বস্তু ও পরিধি ততদূর প্রসারিত।

পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু (Scope and Subject-matter of Civics & Good Governance): পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু নিম্নের চিত্রের সাহায্যে এভাবে দেখানো যায়-


পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ

১. নাগরিকতা বিষয়কঃ নাগরিকদের উত্তম এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন প্রতিষ্ঠা করার জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি বা উদ্ভব হয়েছে। সুনাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, সচেতনতা প্রভৃতি গুণাবলি রাষ্ট্রকে মহীয়ান করে তোলে। নাগরিকতার অর্থ ও প্রকৃতি, নাগরিকতা অর্জন ও বিলোপ, সুনাগরিকতা, নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য বোধ প্রভৃতির অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে পৌরনীতি আলোচনা করে। এজন্য পৌরনীতি ও সুশাসনকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান বলা হয়।

২. মানবসভ্যতার আদি সংগঠন সম্পর্কে আলোচনাঃ মানবসভ্যতার বিকাশে আদি ও অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। এরিস্টটলের মতে পরিবার হলো রাষ্ট্রের আদি রূপ। সময়ের স্রোত বেয়ে বিবর্তনের ধারায় পরিবারের সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং গড়ে ওঠেছে রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। পৌরনীতি ও সুশাসন তাই পরিবারের বর্তমান ও অতীত রূপ এবং কার্যাবলি; সমাজের বিকাশ, সামাজিক পরিবর্তনের প্রকৃতি ও কারণসমূহ, সামাজিক মূল্যবোধ; রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও উৎপত্তির ইতিহাস এবং বিকাশের ধারা প্রভৃতি দিক সম্পর্কে আলোচনা করে।

৩. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে আলোচনাঃ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, প্রকৃতি ও উৎপত্তির ইতিহাস, রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ, সংবিধানের প্রকৃতি ও শ্রেণিভেদ, সরকারের প্রকৃতি ও শ্রেণিভেদ, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ বা বিভাগের প্রকৃতি, সংগঠন ও কার্যাবলি, নির্বাচন ও নির্বাচকমণ্ডলী, রাজনৈতিক দল, জনমত প্রভৃতি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন সম্পর্কে পৌরনীতি আলোচনা করে৷

৪. রাজনৈতিক তত্ত্বঃ পৌরনীতি ও সুশাসন রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়েও আলোচনা করে। পৌরনীতিতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, রাষ্ট্রের কার্যাবলি সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব বা মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

৫. সামাজিক ও রাজনৈতিক বিমূর্ত বিষয় নিয়ে আলোচনাঃ আইনের প্রকৃতি, সংজ্ঞা, উৎস, প্রয়োজনীয়তা এবং নৈতিকতার সাথে এর সম্পর্ক; স্বাধীনতার প্রকৃতি, সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, রক্ষাকবচ এবং আইনের সাথে এর সম্পর্ক; সাম্যের প্রকৃতি, প্রকারভেদ এবং স্বাধীনতার সাথে এর সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে।

৬. নাগরিকতার স্থানীয় দিক সম্পর্কে আলোচনাঃ একজন আদর্শ নাগরিক ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ প্রভৃতি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সাথেও সংশ্লিষ্ট থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার প্রকৃতি, সংগঠন, কার্যাবলি এবং বিকাশ সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে।

৭. নাগরিকতার জাতীয় দিক সম্পর্কে আলোচনাঃ নাগরিকদের জাতীয় বিষয় অর্থাৎ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি, জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ধাপে ধাপে বিভিন্ন নেতার অবদান, জাতীয় রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ, শাসনতান্ত্রিক সমস্যা ও অগ্রগতি সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে থাকে।

৮. নাগরিকতার আন্তর্জাতিক রূপ সম্পর্কে আলোচনাঃ নাগরিক জীবন আজ স্থানীয় ও জাতীয় গণ্ডির সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই বর্তমানে প্রতিবেশী ও দূরের সকল রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে বিশ্ব-শান্তি ও বন্ধুত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্যই মানুষ আজ গড়ে তুলেছে জাতিসংঘসহ অন্যান্য বহু আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। পৌরনীতি ও সুশাসন তাই জাতিসংঘসহ অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব, বিকাশ, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করে৷

৯. নাগরিকতার অতীত নিয়ে আলোচনাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের অতীত ইতিহাস ও গঠন কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে।

১০. নাগরিকতার বর্তমান নিয়ে আলোচনাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতার বিশেষ করে নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যের বর্তমান রূপ সম্পর্কে আলোচনা করে।

১১. নাগরিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনাঃ নাগরিক জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদির অতীত ও বর্তমান রূপ আলোচনার আলোকে এর ভবিষ্যৎ রূপ ও কার্যাবলি কিরূপ হবে বা হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও পৌরনীতি ও সুশাসন ইঙ্গিত প্রদান করে থাকে।

১২. সুনাগরিকতার শিক্ষাঃ পৌরনীতি ও সুশাসনে সুনাগরিকতার শিক্ষা প্রদান করা হয়। সুনাগরিকতা অর্জনের গুণাবলি; যেমন- বুদ্ধি, বিবেক, আত্মসংযম ও শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে পৌরনীতি ও সুশাসনে আলোচনা করা হয়।

১৩. রাজনৈতিক ঘটনা ও আন্দোলন নিয়ে আলোচনাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন একটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা এবং আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়েও আলোচনা করে। বাংলাদেশের পৌরনীতি ও সুশাসনে পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বাঙালির প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা, ৬ দফা, কর্মসূচি ও আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী ষড়যন্ত্র, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়৷

১৪. সাংবিধানিক অগ্রগতিবিষয়ক আলোচনাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন সাংবিধানিক অগ্রগতি বা বিকাশ ধারা নিয়ে ও আলোচনা করে। বাংলাদেশ পৌরনীতিতে ব্রিটিশ শাসনামল ও পাকিস্তান শাসনামলে সাংবিধানিক বিকাশ ও অগ্রগতি, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধানের বিভিন্ন দিক বা ধারাসমূহ, বিভিন্ন সময়ে আনীত সংবিধানের সংশোধনীসমূহ, জাতীয় সংসদের নির্বাচনসমূহের ফলাফল এবং বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালনকারী সরকার বা মন্ত্রিসভার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

উপসংহারঃ ওপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু ব্যাপক ও বিস্তৃত। নাগরিকের জীবন ও কার্যাবলি যতদূর বিস্তৃত অর্থাৎ যা কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে, পৌরনীতি ও সুশাসনের বিষয়বস্তু ও পরিধিও ততদূর বিস্তৃত।