ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন হলো সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কার্যাবলি ইত্যাদি বিষয় পৌরনীতির আলোচনার বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি অপর সামাজিক বিজ্ঞানগুলোও মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সব সামাজিক বিজ্ঞানই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শুধু তাই নয়— দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি নৈতিক বিজ্ঞানের সাথেও পৌরনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞানের এই মূল্যবান শাখাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান (Civics, Good Governance and Political Science): সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর। সমাজবিজ্ঞানের এ গুরুত্বপূর্ণ শাখা দুটির সম্পর্ক সহোদর ভাইয়ের মতো।

সাদৃশ্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে নিম্নলিখিত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়ঃ

১. অর্থগত অভিন্নতাঃ উৎপত্তিগত দিক থেকে পৌরনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রায় এক ও অভিন্ন। ল্যাটিন শব্দ ‘Civis’ ও ‘Civitas’ থেকে ইংরেজি Civics (পৌরনীতি) শব্দের উৎপত্তি। ‘Civis’ শব্দের অর্থ নাগরিক এবং Civitas শব্দের অর্থ ‘নগররাষ্ট্র’। Politics (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ ‘Polites’ ও ‘Polis’ থেকে। ‘Polites’-এর অর্থ ‘নাগরিক এবং ‘Polis’ এর অর্থ হলো ‘নগররাষ্ট্র’। সুতরাং বলা যায় যে, অর্থগত দিক থেকে জ্ঞানের উভয় শাখাই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং প্রায় অভিন্ন।

২. নিবিড় সম্পর্কঃ পৌরনীতি ও সুশাসন হলো নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান, আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজ্ঞান। পৌরনীতি ও সুশাসনকে নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান হলেও তা রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করে। কেননা প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রের সভ্য এবং তার জীবনের বৃহত্তর অংশ রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অপরদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজ্ঞান হলেও নাগরিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করে থাকে। কেননা, নাগরিকদেরকে নিয়েই রাষ্ট্র গঠিত। সুতরাং উভয়ের সম্পর্ক দেহ ও প্রাণের সম্পর্কতুল্য। উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ। 

৩. আলোচ্য বিষয়ে মিলঃ কিছু কিছু বিষয় উভয় শাস্ত্রই আলোচনা করে থাকে। নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান হলেও পৌরনীতি ও সুশাসনের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে সংবিধান, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সরকার, প্রশাসন, আইন-কানুন, স্বাধীনতা, সাম্য, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়। অপরদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজ্ঞান হলেও নাগরিকতা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ নিয়েও আলোচনা করে থাকে।

পার্থক্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠই হোক না কেন, উভয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য লক্ষ করা যায়ঃ

১. পরিধি ও বিষয়বস্তুগত পার্থক্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসন অপেক্ষা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু বিস্তৃত ও ব্যাপক। অনেকেই এ জন্য পৌরনীতি ও সুশাসনকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অংশ বলেও মনে করে থাকেন৷

২. বিষয় নির্ধারণ ও গুরুত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্যঃ আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ এবং তার ওপর গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রেও জ্ঞানের উভয় শাখার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোর ওপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করে অন্য বিষয়গুলোর ওপর ততটা নয়। অপরদিকে, পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর যতটা গুরুত্ব আরোপ করে, রাষ্ট্রীয় সংগঠন সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ওপর ততটা গুরুত্ব আরোপ করে না।

৩. দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য তা মূলত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান হওয়ায় সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যাগুলোকে নাগরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজ্ঞান হওয়ায় ঐ একই সমস্যাগুলোকে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়।

৪. উৎপত্তিগত পার্থক্যঃ পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Civics-এর উৎপত্তি ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ Civis এবং civitas থেকে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ Political Science অথবা Politics শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে Polities ও polis থেকে।

উপসংহারঃ সুতরাং বলা যায় যে, সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এ দুটি শাখার সম্পর্ক সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। উভয়ের সম্পর্ক দেহ ও প্রাণের সম্পর্ক তুল্য, যেন একে অপরের সহোদর। জ্ঞানের এ দুটি শাখা আসলে পরস্পর পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরক।