প্রশ্নঃ 
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টাডিজ এর সম্পর্ক আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন হলো সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কার্যাবলি ইত্যাদি বিষয় পৌরনীতির আলোচনার বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি অপর সামাজিক বিজ্ঞানগুলোও মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সব সামাজিক বিজ্ঞানই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শুধু তাই নয়— দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি নৈতিক বিজ্ঞানের সাথেও পৌরনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞানের এই মূল্যবান শাখাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টাডিজ (Civics, Good Governance and Human Rights, Gender Studies): পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার স্টাডিজ-এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়। উভয়ের সম্পর্ক কতটা নিবিড় তা বুঝতে হলে হিউম্যান রাইটস বা মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টডিজ এর প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হয়।

ব্যক্তি সমাজ জীবনে যেসব সুযোগ ও সুবিধার দাবিদার হয় এবং যা ছাড়া তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে পারে না, তাই মানবাধিকার। মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মৌলিক মানবাধিকারসমূহ গৃহীত ও ঘোষিত হয়।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ যে মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ঘোষণা করে সেখানে ১-৩০ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সর্বত্রই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের ঘোষণা রয়েছে। এ জন্যই ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদকে বিশ্বের সকল মানুষের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের যেসব দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা হচ্ছে সেসব দেশ মানবাধিকারের এই নীতিগুলোর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল।

জৈবিকভাবে ‘Gender’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘লিঙ্গ’ বা ‘Sex’, সাধারণত জেন্ডার শব্দটি ব্যবহৃত হয় নারী না পুরুষ- কোন্ লিঙ্গ তা চিহ্নিত করার জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়ন ভাবনায় ‘জেন্ডার’ একটি বহুল আলোচিত প্রত্যয়। জাতীয় ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর নিকট জেন্ডার বিষয়টি মানব উন্নয়নের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

জৈবিকভাবে মানুষ নারী ও পুরুষ—এ দুই ভাগে বিভক্ত। কিন্তু জেন্ডার হলো সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা নারী এবং পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য। এই পার্থক্য শারীরিক বা জৈবিক পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয়নি। জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা নারী ও পুরুষের পরিচয়, সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক, সমাজ কর্তৃক আলোচিত নারী ও পুরুষের ভূমিকা। এক কথায় নারী ও পুরুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা বা নারী ও পুরুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় হলো জেন্ডার। জেন্ডার নারী ও পুরুষের সামাজিক শ্রেণিকরণকে ‘মেয়েলী’ ও ‘পুরুষালি’ বিষয়ে পরিণত করে। জেন্ডার এজন্যই জৈবলিঙ্গের পরিণতি নয়, সমাজ কর্তৃক নির্মিত।

জেন্ডার স্টাডিজে বলা হয় যে, নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যর মধ্যে এমন কিছু নেই যার জন্য তাকে সারা জীবন গৃহে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে বা গৃহের বাইরের কাজের জন্য নারী অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। পাশাপাশি পুরুষ গৃহকর্মের জন্য জন্মগ্রহণ করেনি কিংবা সবকিছুতেই পুরুষ নারীর থেকে উন্নত, যোগ্য ও শ্রেয় এ কথাও জেন্ডার স্টাডিজে অস্বীকার করা হয়। জেন্ডার স্টাডিজে নারী-পুরুষের বৈষম্য যা পুরুষশাসিত সমাজ কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়। কীভাবে এর ফলে নারী পুরুষে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, কীভাবে এর ফলে মানবাধিকারের নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে সেসব বিষয়ও জেন্ডার স্টাডিজ পাঠ করলে জানা যায়।

পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে হিউম্যান রাইটস এবং জেন্ডার স্ট্যাডিজের মধ্যে নিম্নলিখিত সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়ঃ

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টাডিজ এর সাদৃশ্যঃ

১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অভিন্নতাঃ জ্ঞানের উভয় শাখার চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন। পৌরনীতি ও সুশাসন নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা বৃদ্ধি করে। মানবাধিকার ও জেন্ডার স্ট্যাডিজ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি, নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলের জন্য মানবাধিকার ও জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করে।

২. বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সাদৃশ্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসনের মূল আলোচ্য বিষয় রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবন। মানবাধিকার ও জেন্ডার স্ট্যাডিজেরও আলোচ্য বিষয় নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় জীবনে অধিকার, কর্তব্য, মানবাধিকার ও সুশাসন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা।

৩. নাগরিক জীবনের মানোন্নয়নঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার স্ট্যাডিজ নাগরিক জীবনের মানোন্নয়নের উপায় নিয়ে আলোচনা এবং এ নিয়ে গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণ, মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করে।

৪. একে অপরের পরিপূরকঃ কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায়, সুনাগরিকতার প্রতিবন্ধকতা কী কী, কীভাবে তা দূর করা যায় সে সব বিষয়ে পৌরনীতি ও সুশাসনে আলোচনা করা হয়। ঠিক তেমনি মানবাধিকার ও জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিষয়টিও নাগরিক জীবনের বিকাশের জন্য, পূর্ণাঙ্গতার জন্য এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা সুনাগরিকতার শিক্ষা দেয়।

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টাডিজ এর বৈসাদৃশ্যঃ

১. উৎপত্তির দিক থেকেঃ পৌরনীতি ও সুশাসনের উৎপত্তি ঘটেছে আগে, হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার স্ট্যাডিজ এর উৎপত্তি ঘটেছে পরে।

২. পরিধির দিক থেকেঃ নাগরিকের জীবন ও কার্যাবলি যতদূর বিস্তৃত, অর্থাৎ যা’ কিছু নাগরিক জীবনকে স্পর্শ করে পৌরনীতি ও সুশাসনের বিষয়বস্তু ও পরিধি ততদূর বিস্তৃত। অপরদিকে, হিউম্যান রাইটস এবং জেন্ডার স্ট্যাডিজ শুধুমাত্র মানবাধিকার ও জেন্ডার নিয়ে আলোচনা করে থাকে। সুতরাং হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার বিষয়ের পরিধি ও বিষয়বস্তুর থেকে পৌরনীতি ও সুশাসনের পরিধি ও বিষয়বস্তু অনেক বেশি বিস্তৃত ও ব্যাপক।

৩. নারী ও পুরুষের সমতার প্রতি গুরুত্ব আরোপের দিক থেকেঃ পৌরনীতি ও সুশাসনে নারী ও পুরুষকে পৃথকভাবে দেখা হয় না। তাদেরকে ভাবা হয় একজন নাগরিক হিসাবে। একজন নাগরিকের, সে পুরুষ হোক বা নারী হোক- পৌরনীতি ও সুশাসনে সবার জন্য অভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকারের কথা বলা হয়। অপরদিকে জেন্ডার স্ট্যাডিজে জেন্ডার বৈষম্যের প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়।

৪. মানুষ সম্পর্কে ধারণাঃ পৌরনীতি ও সুশাসনে মানুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ও জেন্ডার বিষয়ে মানুষকে শুধু সামাজিক জীব হিসেবেই মনে করা হয় এবং তার মানবিক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়।

পরিশেষঃ উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পৌরনীতি ও সুশাসনের সাথে মানবাধিকার ও জেন্ডার স্টাডিজের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মানবাধিকারের ঘোষণার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে এবং কৃত্রিমভাবে সমাজসৃষ্ট নারী-পুরুষের বিভাজন ও বৈষম্য দূর করতে হবে।