প্রশ্নঃ 
পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির সম্পর্ক আলোচনা কর। 

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও সুশাসন হলো সামাজিক বিজ্ঞান। সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কার্যাবলি ইত্যাদি বিষয় পৌরনীতির আলোচনার বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি অপর সামাজিক বিজ্ঞানগুলোও মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং সব সামাজিক বিজ্ঞানই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শুধু তাই নয়— দর্শন, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি নৈতিক বিজ্ঞানের সাথেও পৌরনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞানের এই মূল্যবান শাখাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি (Civics, Good Governance and Economics): পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি উভয়ই সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা। উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়।

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির সাদৃশ্যঃ উভয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়ঃ

১. অভিন্ন লক্ষ্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির লক্ষ্য অনেকটা এক ও অভিন্ন। উভয়ের লক্ষ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন করা। পৌরনীতি ও সুশাসন হলো নাগরিকতা বিষয়ক বিজ্ঞান। কীভাবে নাগরিকতা অর্জন করা যায়, কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায়, নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ কী কী ইত্যাদি বিষয়ে পৌরনীতি ও সুশাসন আলোচনা করে থাকে। অপরদিকে অসীম অভাবের মাঝে সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করা যায় অর্থনীতি তারই শিক্ষা প্রদান করে। এই শিক্ষা না পেলে নাগরিক জীবন বিষময় হয়ে ওঠে। ফলে কেউ সুনাগরিক হতে পারে না।

২. অভিন্ন আলোচ্যসূচিঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির আলোচ্যসূচিতে কতগুলো অভিন্ন বিষয় চোখে পড়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সমস্যার যেমন অর্থনৈতিক দিক রয়েছে, তেমনি প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক সমস্যারও রাজনৈতিক দিক রয়েছে। রাজনীতিবিদদের যেমন অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হয়, তেমনি অর্থনীতিবিদদেরও পৌরনীতি ও সুশাসন এবং রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। সম্পদ, সম্পদের বণ্টন, কর, উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা, বৈদেশিক বাণিজ্য, বাজেট, অর্থনৈতিক সমস্যা ও তার সমাধান, সমাজসেবা, সমবায়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, জনসংখ্যা পরিস্থিতি ও জনসংখ্যা সমস্যা এবং তার সমাধান প্রভৃতি বিষয় তাই পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি সমান গুরুত্বসহকারে আলোচনা করে থাকে।

৩. পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ আধুনিক রাষ্ট্রের অধিকাংশ কার্যাবলিই অর্থনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। রাষ্ট্র ও সরকারের সাফল্য নির্ভর করে অর্থনৈতিক সাফল্যের ওপর। অপরদিকে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ এবং পরিকল্পনাসমূহ রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক পরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি পরস্পর নির্ভরশীল।

৪. পরস্পরের ওপর প্রভাবঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি একে অপরের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারা রাজনৈতিক কার্যাবলির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কার্যাবলিও পরিচালনা করে থাকেন। এজন্য তাদের অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অপরদিকে, অর্থনীতিবিদদেরও রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে হয়। কেননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে লক্ষ রেখে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গৃহীত না হলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

৫. জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্য উভয়ের প্রয়োজনঃ আধুনিক কল্যাণকর রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করা। অর্থনৈতিক কার্যাবলির অনেক দিকই বর্তমানে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। কল্যাণকর রাষ্ট্রে পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি উভয় শাস্ত্র পাঠ করা তাই একান্ত প্ৰয়োজন।

৬. পরস্পর পরিপূরকঃ পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি পরস্পর পরিপূরক ও সহায়ক। মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন বিচ্ছিন্ন নয়, বরং তা একে অপরের পরিপূরক ও সহায়ক। একটির পরিবর্তন হলে অন্যটিরও পরিবর্তন হয়। এ জন্যই অধ্যাপক ম্যাকাইভার বলেছেন যে, “সকল শাসন পদ্ধতি তার অনুরূপ সম্পত্তি ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে, একটিকে পরিবর্তন করলে অপরটিরও পরিবর্তন সাধিত হয়।”

পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির পার্থক্যঃ তবে পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য রয়েছেঃ

১. বিষয়বস্তুগত পার্থক্যঃ পৌরনীতি ও সুশাসনের মূল আলোচ্য বিষয় হলো নাগরিকতা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, আর অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কার্যাবলি।

২. অনুশীলন পদ্ধতিগত পার্থক্যঃ অর্থনীতির অনুশীলন পদ্ধতি প্রধানত গাণিতিক, কিন্তু পৌরনীতি ও সুশাসনের অনুশীলন পদ্ধতি মূলত ঐতিহাসিক।

পরিশেষঃ আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকলেও পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতির মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। উভয় শাস্ত্রের লক্ষ্য হলো উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী নাগরিক জীবন প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং বলা যায় যে, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক ও সহায়ক। উভয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়।