প্রশ্নঃ পৌরনীতি ও সুশাসনের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
উত্তরঃ মানুষ সামাজিক জীব। স্নেহ ও ভালোবাসার প্রত্যাশী মানুষ সঙ্গপ্রিয়তার জন্যই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চায়। সমাজ ছাড়া সে বাস করতে পারে না। সুদূর অতীতে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনকে কেন্দ্র করে কতগুলো নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত কতগুলো বিধি-বিধান বা নিয়ম-কানুন। অবশ্য প্রাচীন গ্রিসে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করত শুধু তাদেরকেই বলা হতো নাগরিক। আর নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে জ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা করা হতো তাকে বলা হতো পৌরনীতি। সমসাময়িক ভারতবর্ষে নগরকে বলা হতো ‘পুর’ বা ‘পুরী’ এবং এর অধিবাসীদের বলা হতো, ‘পুরবাসী’। তাদের নাগরিক জীবনকে বলা হতো ‘পৌরজীবন’ এবং নাগরিক জীবন সম্পর্কিত বিদ্যার নাম ছিল ‘পৌরনীতি’।
প্রাচীন ভারতে কৌটিল্য (Kautilya) ‘সুশাসন’-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন, দায়িত্বশীল প্রশাসন, সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বিচার ও যৌক্তিকতা এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, প্রাচীন ভারতবর্ষেও সুশাসন এর প্রয়োজনীয়তা অনেকে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।
সুদূর অতীতেও শাসকদের লক্ষ্য ছিল জনগণের কল্যাণসাধন। এরিস্টটলতো তার গুরু প্লেটোকে অনুসরণ করে সরকারের শ্রেণিবিভাগই করেছিলেন সরকারের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। প্রজা বা রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণে যে সরকার শাসন পরিচালনা করতো তাকে তিনি ‘স্বাভাবিক সরকার’ এবং প্রজাদের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে যে সরকার ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শাসন পরিচালনা করতো তাকে তিনি বিকৃত সরকার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এরিস্টটলের মতে রাষ্ট্রের প্রধানতম ও পবিত্রতম লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিকদের জন্য উন্নততর ও কল্যাণকর জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা, জ্ঞানের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা এবং নৈতিক উৎকর্ষতা সাধন করা। শুধু তাই নয় এরিস্টটল নিয়মতন্ত্রবাদ ও আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও সেই প্রাচীন যুগেই লেখনী ধারণ করেছিলেন। এমনকি তিনি সরকারের স্বেচ্ছাচার প্রতিরোধ করার জন্য সরকারের কাজকে আইন, শাসন ও বিচার—এ তিনভাগে বিভক্ত করার পরামর্শও প্রদান করেছিলেন। মূলত তার লক্ষ্য ছিল এমন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সেখানে আইনের শাসন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
প্রাচীন গ্রিসের ‘নগররাষ্ট্র’ আজ আর নেই। আধুনিক রাষ্ট্রগুলো হলো ‘জাতি রাষ্ট্র’ (Nation State) এবং এগুলো আয়তনে যেমন বিশাল, তেমনি জনসংখ্যায়ও বিপুল। এসব জাতি রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন এবং কার্যাবলি বহুমুখী ও জটিল। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই জটিল আচরণ, কার্যাবলি এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞানের যে শাখা বর্তমানে আলোচনা করে তাই পৌরনীতি।
১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘ, UNDP সহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সুশাসন’ সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক চিন্তাভাবনা শুরু করে। তবে এসব সংস্থার লক্ষ্য ছিল সে সময়ের প্রশাসনে বিদ্যমান দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, সরকারের দায়বদ্ধহীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি অশ্রদ্ধা দূর করে কীভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় তা অন্বেষণ করা । তখন থেকেই ‘সুশাসন’ (Good Governance) সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংক ‘Governance and Development’ শীর্ষক রিপোর্টে সুশাসনের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। বিশ্বব্যাংক তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৯৫ সালে Asian Development Bank (ADB) Governance : Sound Development Management’ শীর্ষক রিপোর্টে ‘সুশাসন’ সম্পর্কে আলোচনা করে। ১৯৯৭ সালে UNDP সুশাসনের সংজ্ঞা প্রদান ও এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে। ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও সুশাসনের উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে । ‘আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত তাদের ‘Policy Paper’-এ সুশাসন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে । বর্তমানে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংগঠন সাহায্য, সহযোগিতা ও সহায়তা প্রদানের বেলায় ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠাকে অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে ঘোষণা করে।
আধুনিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো জনকল্যাণ। এজন্য আধুনিক অধিকাংশ রাষ্ট্রকেই ‘জনকল্যাণকর রাষ্ট্র’ (Welfare State) বলা হয়। বর্তমান, রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা। ‘সুশাসন’ একদিনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুশাসনের ধারণাও একদিনে গড়ে ওঠেনি, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, বিকেন্দ্রীকরণ নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ও দাবি, প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ, জন অংশগ্রহণের দাবি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি, মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের দাবি আজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এর ফলে ‘সুশাসন’ বিষয়টি আজ পৌরনীতিতে গুরুত্বের সাথে আলোচিত হচ্ছে।
Leave a comment