প্রশ্নঃ পৌরনীতিতে আইনের ধারণা কি? আইনের সংজ্ঞা ও উৎস বর্ণনা কর। 

ভূমিকাঃ আইন হলো সামাজিক রীতিনীতি সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা। আইন হলো নিয়মের এক পদ্ধতি যাকে নাগরিক বাধ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করতে ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যকরী করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

আইনের ধারণা ও সংজ্ঞা (Conception and Definition of Law): আইনের সাধারণ অর্থ হলো নিয়ম-কানুন’বা বিধি-বিধান। ফার্সি ‘আইন’ শব্দটির অর্থ সুনির্দিষ্ট নীতি বা নিয়ম। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law’. ইংরেজি Law শব্দটির আভিধানিক উৎপত্তি টিউটনিক মূল শব্দ ‘Lag’ থেকে। Law শব্দের অর্থ ‘স্থির’ বা ‘অপরিবর্তনীয়’ এবং ‘সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য’। সমাজের আইন কানুনও স্থির। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দিবা-রাত্রি, জোয়ার-ভাঁটা সবই স্থির নিয়মের অধীন। সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায় এক নিয়মের রাজত্ব বিরাজমান। এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটানোর ক্ষমতা কারো নেই। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো রাষ্ট্রও একটি প্রতিষ্ঠান। সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সমাজজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সুস্থ রাষ্ট্রীয় জীবনযাপনের জন্য মানুষকে কিছু কিছু বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এসব বিধি-নিষেধ বা নিয়ম-কানুনকে আইন বলে। সুতরাং আইন হচ্ছে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নিয়মের সমষ্টি যা সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনবিদগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এরিস্টটল বলেছেন, “যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন।” (Law is the passionless reason.)। টমাস হবস, জ্যা বোঁদা, অধ্যাপক হল্যান্ড, জন অস্টিন প্রমুখ ‘বিশ্লেষণপন্থি লেখক’ আইনকে ‘সার্বভৌম শক্তির আদেশ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

টমাস হব্‌স (Thomas Hobbes)-এর মতে, “জনগণের ভবিষ্যৎ কার্যাবলি নির্দিষ্ট করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যে আদেশ প্রদান করে তাই আইন।’

অধ্যাপক হল্যান্ড (Prof. Holland)-এর মতে, “আইন হচ্ছে, সেই সাধারণ নিয়ম যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োগ করেন।” (A Law is a general rule of external action enforced by the sovereign political authority.)

জন অস্টিন (John Austin) বলেন, “আইন হচ্ছে নিম্নতমের প্রতি ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আদেশ।” (Law is the command of the political superior i. e. sovereign to the political inferior.)

স্যার হেনরি মেইন, স্যাভিনি (Savigny), মেইটল্যান্ড, স্যার ফ্রেডারিক পোলক প্রমুখ ‘ঐতিহাসিকপন্থি লেখকের’ (Historical school) মতে, রাষ্ট্রের মধ্যে সাংবিধানিক আইন, সাধারণ আইন, প্রথা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে। এসব আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে গণ্য করা যায় না।

অধ্যাপক স্যালমন্ড (Prof. Salmond)-এর মতে, “ন্যায় সংরক্ষণের তাগিদে রাষ্ট্র যেসব নীতি স্বীকার করে এবং প্রয়োগ করে তাই আইন।”

অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettel) বলেন, “রাষ্ট্র যেসব নিয়ম-কানুন সৃষ্টি বা স্বীকার করে এবং বলবৎ করে তাই শুধু আইন বলে পরিগণিত হয়।” (Only those rules which the state creates or which as recognizes, enforces become law.)

আইনের একটি সর্বজনগ্রাহ্য ও চমৎকার সংজ্ঞা প্রদান করেছেন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson)। তার মতে, “আইন হলো মানুষের স্থায়ী আচার-ব্যবহার ও চিন্তাধারার সেই অংশ যা রাষ্ট্রের দ্বারা, স্বীকৃত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যার পশ্চাতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন আছে।” (Law is that portion of the established thought and habit which has gained distinct and formal recognition in the shape of uniform rules backed by the authority and power of the government.)

আইনের উৎস (Sources of Law): জন অস্টিনের মতে, আইনের উৎস একটি এবং তা হচ্ছে সার্বভৌমের আদেশ। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে, উৎস হলো ছ’টি যথা : (১) প্রথা, (২) ধর্ম, (৩) বিচারকের রায়, (৪) ন্যায়বিচার, (৫) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, (৬) আইনসভা। ওপেনহাইম জনমতকেও আইনের উৎস বলে মনে করেছেন। কেননা জনমতের প্রভাবে অনেক সময় সরকার আইন প্রণয়ন বা প্রচলিত আইন পরিবর্তন ও সংশোধন করে থাকে। আইনের উৎসসমূহ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ 

১. প্রথা (Custom): প্রথা আইনের একটি সুপ্রাচীন উৎস। প্রাচীনকাল থেকে যেসব আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি ও অভ্যাস সমাজে অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক সমর্থিত, স্বীকৃত ও পালিত হয়ে আসছে, তাকে প্রথা বলে। প্রাচীনকালে কোনো আইনের অস্তিত্ব ছিল না। তখন প্রচলিত প্রথা, অভ্যাস ও রীতি-নীতির সাহায্যে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হতো। কালক্রমে অনেক প্রথাই রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে আইনের মর্যাদা অর্জন করে। গ্রেট ব্রিটেনের সাধারণ আইন এরূপ প্রথাভিত্তিক।

২. ধর্ম (Religion): ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের জীবনবোধের খুব গভীরে নিহিত থাকায় অনেক বিধি-নিষেধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এ সমস্ত ধর্মীয় বিধি- বিধানসমূহ রাষ্ট্রীয় সমর্থন লাভ করে পরে আইনে পরিণত হয়। প্রাচীন রোমক আইন ধর্মীয় বিধানের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি আইন ধর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মুসলিম আইন প্রধানত কুরআন ও সুন্নাহর ওপর নির্ভরশীল। পারিবারিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনগুলো মূলত ধর্ম থেকে এসেছে।

৩. বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত (Judicial Dicision or Adjudication): বিচারকরা দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে বিচার কাজ পরিচালনা করে থাকেন। অস্পষ্ট শব্দগত ব্যাখ্যার কারণে অথবা পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে বিচারকরা যখন দেশে বিরাজমান আইন দ্বারা মামলা মকদ্দমার নিষ্পত্তি করতে সমর্থ হন না, তখন তারা নিজেদের বিবেক, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা থেকে নতুন নতুন আইন সৃষ্টি করেন এবং প্রয়োজনবোধে আইনের যথার্থতা বিশ্লেষণ করেন। পরবর্তীতে এসব ‘বিচারক প্রণীত আইন’ (Judge-Made law) অন্যান্য বিচারকগণ কর্তৃক ব্যাপকভাবে অনুসৃত হতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতি মার্শাল, হিউজেস প্রমুখ বিচারক এভাবে বহু নতুন আইন সৃষ্টি করেছেন।

৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Discussion): প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞদের মূল্যবান ও সারগর্ভ আলোচনা, বিশ্লেষণ এবং লিখিত গ্রন্থসমূহ আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। বিচারকরা যখন কোনো বিতর্কিত জটিল বিষয়ে আইনজ্ঞদের এসব মতামত গ্রহণ করেন তখন তা প্রচলিত আইনের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডের কোক ও ব্লাকস্টোন এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরি ও কেন্ট প্রমুখ আইনবিদের ব্যাখ্যা উভয় দেশের আইনের ব্যাখ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম আবু হানিফার ব্যাখ্যা, হেদায়া-ই-আলমগিরি প্রভৃতি গ্রন্থ ইসলামি আইনের ব্যাখ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

৫. ন্যায়বোধ (Equity): আইন নির্দিষ্ট ও স্থিতিশীল। কিন্তু সমাজজীবন পরিবর্তনশীল ও গতিময়। দেশে প্রচলিত আইন যখন যুগোপযোগী বিবেচিত হয় না বা পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে কঠোর বা অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে বিচারকরা তখন তাঁদের শুভবুদ্ধি, সচেতন বিচারবুদ্ধিমাফিক সেই আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন কিংবা নতুন আইন তৈরি করেন। বিচারকের ন্যায়বোধ থেকে এভাবে অনেক নতুন আইন প্রণীত হয়েছে।

৬. আইন পরিষদ (Legislature): আধুনিককালে আইনের প্রধানতম উৎস হচ্ছে আইন পরিষদ। আইনসভা জনমতের সাথে সঙ্গতি রেখে আইন প্রণয়ন করে। আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইনের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইন। আইন পরিষদ শুধু নতুন আইন তৈরি করে না, পুরনো আইন সংশোধন করে তা যুগোপযোগী করে তোলে।

৭. জনমত (Public opinion): ওপেনহাইম, হল প্রমুখ মনীষী জনমতকে আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস বলে উল্লেখ করেছেন। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন প্রকৃতপক্ষে জনমতের অভিব্যক্তি। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত আইনসভার সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব হলো জনমতের যথার্থ প্রতিফলন। আইন প্রণয়নের সময় তাই জনমতের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখা হয়।

৮. প্রশাসনিক ঘোষণা (Administrative declaration): বর্তমানে আইন বিভাগের দায়িত্ব ও পরিধি বিস্তৃত হয়ে গেছে। এই জটিলতার কারণে আইন বিভাগ তার কর্তব্য সুচারুরূপে সমাধা করতে সমর্থ হয় না। তাই আইনসভা তার নির্বাহী কর্তৃত্বের বহুলাংশ শাসন বিভাগীয় কর্মকর্তাদের হাতে অর্পণ করে। এভাবে অর্জিত ক্ষমতাবলে জারিকৃত ঘোষণা ও আইনসমূহকে ‘প্রশাসনিক আইন’ বলে।

৯. সংবিধান (Constitution): সংবিধান আইনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা ও কাজের পরিধি সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকে। সংবিধানের নির্দেশিত পথ ধরে আইনসভা আইন তৈরি করে।

উপসংহারঃ সুতরাং আইন হচ্ছে নাগরিকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু বিধানের সমষ্টি, যা রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক গৃহীত ও সমর্থিত এবং জনকল্যাণের জন্য অপরিহার্য। আইন হচ্ছে ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নিয়মের সমষ্টি যা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োগ করে থাকে।