আধুনিক জটিল যুগের দুর্বোধ্যতম কবি জীবনানন্দ। তিনিই সম্ভবত রবীন্দ্রোত্তর যুগের সর্বাপেক্ষা কালসচেতন ও ইতিহাস সচেতন কবি। একটি নিবন্ধে জীবনানন্দ জানিয়েছেন— “ইতিহাস ও সমাজ সন্বন্ধে সচেতন থাকতে হয়। এই চেতনা ও কল্পনা প্রতিভা যাদের রয়েছে তারাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা করতে সমর্থ।” ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুচেতনা’ কবিতাতেও কবির এই ইতিহাস ও সমাজচেতনা আশ্চর্য শব্দবন্ধে প্রকাশিত।
কিন্তু প্রখর সংবেদন, অনুভব ও অভিজ্ঞতার তীব্র ঘাত-প্রতিঘাত, দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে আলোকসন্ধানের তীব্র আকুতি, সদর্থক পথ সন্ধানের আন্তরিক সাধনা কখনো কখনো জীবনানন্দকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দোলাচল ও সংশয়াকীর্ণ অঞ্চলে। ফলে কোথাও কোথাও জীবনানন্দ প্রায় পরস্পরবিরোধী কথা বলেন, কখনও তাঁর কথা অস্পষ্ট হেঁয়ালির মতো শোনায়, অর্থবোধে অসুবিধা হয়, কখনও তাঁর ভাষাবয়নের অর্থ অনুধাবন করতে না পেরে পাঠক বিমূঢ় বিভ্রান্ত হয়। কিন্তু জীবনানন্দের কবিসত্তা ও জীবন-অনুভবের প্রকৃতিটিকে অবহিত হয়ে সতর্কভাবে তাঁর কবিতাকে অনুসরণ করতে কিছুটা বোঝা যায়, তিনি কি বলতে চাইছেন। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুচেতনা’ কবিতার মর্মকথাটিও বহুস্তরীয় অর্থের জন্য হয়তো আমাদের বিভ্রান্ত করে, কখনও পরস্পরবিরোধী বলে মনে হয়। তবু অনুধাবন করলেই কবির তীব্র ইতিহাসবোধ ও সমাজবোধ এবং সেইসঙ্গে কবির প্রার্থিত জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। পৃথিবীর গভীর অসুখের কথা যুদ্ধোত্তর কালের সমস্ত কবিশিল্পীদেরই অনুভবে ধরা পড়েছিল। আবিশ্ব কবিচেতনাকে সভ্যতার পাশবিক করাল মূর্তি নগ্নরূপের বীভৎসতায় আলোড়িত করেছিল। মানবতা, কল্যাণ, শান্তি, প্রেম, ঈশ্বর বিশ্বমৈত্রী করুণা ইত্যাদি শব্দগুলি প্রহসনের মতো অলীক বলে প্রতিপন্ন হচ্ছিল। বাস্তব কেবল হিংসা, লোভ, ক্ষমতা, সাম্রাজ্য, ভোগ, অর্থ ইত্যাদি। আবহমান কালের মানুষের শুভচেষ্টা, মনীষী-বিজ্ঞানী-সত্যসন্ধানীদের প্রয়াস ও আত্মত্যাগও যেন ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছিল।
যুগবাস্তবের এই নির্মম নির্মোহ সময়ে আধুনিক কবিদের মধ্যে এক তীব্র হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, বিষণ্ণতা গাঢ় হয়ে উঠছিল। আর এই সময়েই জন্ম নিচ্ছিল সবকিছুতে আস্থাহীন, হতাশাপিষ্ট, জগতের কোনো পরম উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বিশ্বাসহীন এক ধরনের নৈরাশ্যের দর্শন।
জীবনানন্দও তাঁর প্রখর কালচেতনা দিয়ে এই যুগটিকে স্পষ্টভাবেই চিনতে পেরেছিলেন। তাই সভ্যতার ‘রণ রক্ত সফলতা’-র উত্তেজক পদযাত্রাকে তিনি ‘শেষ সত্য’ বলে স্বীকার করতে পারেন নি। সভ্যতার পথে এতখানি পথ অতিক্রম করে এসেও তিনি দেখেছেন মানুষের হাত রক্তাক্ত, হৃদয় ঈর্ষা ও হিংসায় পূর্ণ। অতএব ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ উচ্চারণে এই সভ্যতার ইতিহাস চেতনাও সমসাময়িক কালের পরিচয়টিই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন কবি।
কি সেই অসুখ? সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল মানুষের জন্য মানুষের সে কল্যাণ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে, সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে লোভ ও স্বার্থের প্ররোচনায় সেই কল্যাণপথ থেকে মানুষ ক্রমে ক্রমে ভ্রষ্ট হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের সভ্যতাকে জৌলুয দিয়েছে অনেকখানি হয়ত, কিন্তু বহু মানুষকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থকে চরিতার্থ করার কৌশলও ব্যবহৃত হয়েছে সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরেই। সাম্রাজ্যবাদী লোভ অন্য দেশকে দলিত করার জন্য আবিষ্কার করেছে মারণাস্ত্র। মানুষ এখন শুধু স্বার্থ ও লোভের দাস। পৃথিবীর এই গভীর অসুখের কথা অন্য বহু কবিতাতেও বারবার উচ্চারণ করেছেন জীবনানন্দ। যেমন—
“নিলেমের ঘরবাড়ি আসবার—অথবা যা নিলেমের নয়
সে সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত করে দুজন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে ; সকলের জন্যে নয়।
অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দুর্জনের হাতে।
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকেদের দাবি এসে
সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।”
পণ্য সভ্যতার শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতার ছবি যেমন ফুটে উঠেছে উপরোক্ত কবিতায়, তেমনি আধুনিক যুগ জীবন প্রায় নৈতিকতা-সততার অপমৃত্যু ও নষ্ট মানুষের একাধিপত্যের ভয়ংকরতা প্রকাশিত ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ নামক একটি কবিতায়—
‘‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই,
প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আশা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”
‘সুচেতনা’ কবিতাতেও সেই অসুস্থ পৃথিবীর কথা প্রকাশিত হয়েছে ব্যঞ্জনাগর্ভ ইশারায়। পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতার মধ্যে সেই দিকভ্রষ্ট সভ্যতার ইঙ্গিত আছে: কলকাতা যে একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে, তার ব্যঙ্গাত্মক উচ্চারণেও বাহা জৌলুষের অন্তরালস্থিত অসুস্থতার ইশারা আছে; আর ভাই বন্ধু পরিজনের রক্তে রক্তাক্ত হাতের প্রসঙ্গে অসুস্থ সময়ের হিংসাগ্রস্ত ছবিটি ধরা পড়ে।
কিন্তু পৃথিবীর এই তীব্র ও প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধির কথা স্বীকার করলেও আধুনিক যুগপর্বের অধিকাংশ কবির মতো জীবনানন্দ সেই অসুখ ও বিনষ্টিকেই শেষ কথা বলে স্বীকার করেননি। কোনো নৈরাশ্যবাদ বা অপচয়ের দর্শন প্রচার করতে চাননি জীবনানন্দ। বরং যুগবাস্তবতার সমস্ত ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্যেও তিনি মানবাত্মার ও মানবসমাজের অন্তঃস্থিত এক গভীর শুভবোধ ও সত্য-সুন্দরের পরমলোকে উত্তরণের সম্ভাবনায় বিশ্বাস রেখেছেন।
আর সেই কারণেই এই পার্থিব জীবন তথা পৃথিবীর প্রতি কবি বিমুখ বীতশ্রদ্ধ হননি কখনও। বরং বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে জানিয়েছেন সভ্যতার অভিযাত্রা পথে বিকার ও বিনষ্টি যতই আসুক, মানবজীবনের সঞ্জিত অভিজ্ঞতাকে কবি পরম মমতায় ভালোবাসার সামগ্রী হিসাবেই গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই তিনি বলেন—“মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।” কেননা যুগে যুগে এই পৃথিবীর তথা মানব সভ্যতার পথ ধরেই মানুষের কল্যাণ সন্ধান করেছেন বুদ্ধ, কনফুশিয়াসের মতো মনীষীরা। তাঁদের আত্মত্যাগে, কঠিন প্রয়াসে, কত শত বিজ্ঞানীর আত্মদানে, কত অভিযাত্রী দুঃসাহসিকতায় সভ্যতা অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু যে শুভচেতনা ও সার্বিক কল্যাণ মানুষের জন্য প্রার্থিত ছিল, তা আজও সুদূর পরাহত। কবি মনে করেন—“সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ।” কল্যাণকামী মনীষীবৃন্দের ক্রমাগত প্রয়াসের মধ্য দিয়েই অনাগত কালে একদিন “পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।” কবিতার শেষ স্তবকেও পৃথিবীর মানবজীবনের প্রতি অনিঃশেষ ভালোবাসাই উচ্চারণ করেছেন কবি–“এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি।” মানব জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শুভচেতনার আবির্ভাবে বিশ্বাসই সমস্ত বিনষ্টি ও অপচয়ের বাস্তবতার মধ্যে এ কবিতায় ভাস্বর হয়ে আছে।
Leave a comment