ভূমিকা: ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমানদের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে লুই ভিভিয়ান ডিরোজির দেখানো পথে প্রায় একশ বছর পরে- এক রক্তিম অভিপ্রায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে তাঁর অসাধারণ আন্তরিকতার একদল তরুণ লেখক ও ভাবুকদের নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “মুসলিম সাহিত্য সমাজ” নামক সাহিত্য সংগঠন।

“শিখা” নামক প্রচারপত্র ছিল এ সংগঠনের মুখপত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল ইউনিয়ন কক্ষে বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন, মুসলিম হলের ছাত্র এ.এফ.এম আবদুল হক, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র আবদুল কাদির প্রমুখের ওপর।

মুসলিম সাহিত্য-সমাজের মূলমন্ত্র ছিল “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।” বুদ্ধির মুক্তি বলতে তাঁরা বুঝতেন অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে মুক্তি দান। সংগঠনটি যে নবজাগরণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকর্ম ও সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হয় তার মূলে ছিল তুর্কি জাতি প্রতিষ্ঠায় মুস্তফা কামাল পাশার উদ্যম, ভারতের নবজাগরণের বিভিন্ন মনীষীর প্রয়াস এবং মানবতার উদ্বোধনে সর্বকালের চিন্তাচেতনার সংযোগ। এ সংগঠনের লেখকগণ তাঁদের চিন্তাধারাকে বাঙালি সমাজের কাছে পৌছে দেবার জন্য তিনটি পক্ষ অবলম্বন করেন- ক. পত্রপত্রিকা প্রকাশ, খ, সাময়িক অধিবেশন এবং গ. বার্ষিকসম্মেলন ও গ্রন্থ প্রকাশনা।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র ছিল ‘শিখা’ পত্রিকা। শিখার মোট পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংখ্যায় আবুল হুসেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায় কাজী মোতাহার হোসেন, চতুর্থ সংখ্যায় মোহাম্মদ আবদুর রশীদ এবং পঞ্চম সংখ্যা
আবুল ফজল সম্পাদনা করেন। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের কার্যক্রম দশ বছর (১৯২৬-১৯৩৬) সক্রিয়ভাবে চালু ছিল। দ্বাদশ বর্ষের দ্বিতীয় অধিবেশনের (১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৮) কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, প্রায় ১০/১১ মাস পূর্বে কাজী আবদুল ওদুদের সেগুন বাগানের বাসায় মাহবুব-উল-আলমের সভাপতিত্বে দ্বাদশ বর্ষের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিশেষ চেতনায় কাজী আবদুল ওদুদ সচেতন লেখক ছিলেন। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের প্রধান উদ্দেশ্য চিন্তা চর্চা ও জ্ঞানের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং সু-রুচি সৃষ্টি। যুক্তি ছিল তাঁর হাতিয়ার, বুদ্ধি ছিল তাঁর পরিশীলিত মনন চেতনার বাহন। মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদ চিন্তাধারার পরিবর্তন সাধন করে ধর্মকে যুক্তির আলোকে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণাই ছিল তাঁর প্রবন্ধের উপজীব্য।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের তথা পুনর্জাগরণের লেখক হিসেবে কাজী আবদুল ওদুদের অবদান অনস্বীকার্য অন্যতম। সাহিত্য ও জীবনধারায় তাঁর বিশ্বাস ছিল অভিন্ন। তিনি সমকালীন মুসলিম সমাজের প্রচলিত ভাবধারা থেকে বেরিয়ে এসে- আধুনিক চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদারনৈতিক চিন্তা চেতনার একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘শাশ্বত বঙ্গ’ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) প্রবন্ধ গ্রন্থটি। ‘শাশ্বত বঙ্গ’ রচনাটি মূলত হিন্দু মুসলমানের মিলন মেলা। এ প্রবন্ধ সংকলনের বিভিন্ন প্রবন্ধে সাহিত্য-স্বদেশ-স্বসমাজ ইসলামের মূল আদর্শ মহৎ ব্যক্তিত্ব সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম মত প্রভৃতি বিষয়ে আবদুল ওদুদের চিন্তা চেতনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞান মনস্ক বিয়ষচেতনা বাংলাদেশের প্রবন্ধ ধারায় মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে বিশিষ্ট চিহ্নিত করেছে। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ বা ‘শিখাগোষ্ঠী’ গড়ে উঠেছিল, মোতাহের হোসেন ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখকেরা বাঙালি মুসলমান সমাজের পশ্চাদপদতা নিয়ে ভেবেছেন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়কে আশ্রয় দিয়ে বাঙালি সমাজ ও মানস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে স্বদেশ- ডাবনার বিভিন্ন প্রান্তকে উন্মোচন করেছেন। ফলে এর মধ্যে উঠে এসেছে তাঁর দেশের বিভিন্ন সমস্যা-সুবিধা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দৈশিক চিন্তার কাহিনি। তাছাড়াও তিনি দেশের সমস্যা চিহ্নিতকরণের সাথে সাথে তাঁর সমাধানের পথও আলোচ্য প্রবন্ধগুলোতে তুলে ধরেছেন।

প্রগতিশীল জীবনদৃষ্টি সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞান মনস্ক বিয়ষচেতনা বাংলাদেশের প্রবন্ধ ধারায় আবুল ফজলকে (১৯০৩-৮৩] বিশিষ্ট চিহ্নিত করেছে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখক হিসেবে আবুল ফজল বাঙালি মুসলমান সমাজের পশ্চাদপদতা নিয়ে ভেবেছেন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেছেন। প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি তাঁর প্রবন্ধগুলোতে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়কে আশ্রয় দিয়ে বাঙালি সমাজ ও মানস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলার মুসলমান সমাজে যে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা বিরাজমান ছিল, সেসব দূরীকরণই ছিল এ আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ধর্মবিশ্বাস, পর্দাপ্রথা, সুদ গ্রহণ, নৃত্যগীত ইত্যাদি সম্পর্কে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতেন। সাহিত্য সমাজের বিভিন্ন সভায় পঠিত এবং শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে তাঁদের চিন্তা ও আদর্শের প্রতিফলন ঘটত। আবুল ফজলের প্রবন্ধসমূহের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তাঁর প্রবন্ধসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, এগুলো হলো সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ বা জীবন।

আবুল ফজলের প্রবন্ধের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জীবন বা সমাজ, রাষ্ট্র। এ জাতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হলো ‘মানবতন্ত্র’। এ প্রবন্ধে লেখক মানবতার জয়গান গেয়েছেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন আমাদের জাতীয় জীবনের বা সমাজজীবনের নিয়ন্ত্রণকারী মূল শক্তিটি ধর্ম হতে পারে না। এ প্রবন্ধে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় তিনি প্রকাশ করেছেন বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের যে ধর্ম তা মানবতার চেয়ে বড়ো নয়। কেন লেখক ধর্মের চেয়ে মানবতাকে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন তা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। তাঁর রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানবতাবোধ। আর তাঁর মানবতাবোধের ভিন্নতর পরিচয় পাওয়া যায় ‘মানব-কল্যাণ’ প্রবন্ধে। এ প্রবন্ধে তিনি মানব-কল্যাণের স্বরূপ নির্ণয়ের মাধ্যমে এর সাথে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের সম্পর্ক, মানব-কল্যাণে ধর্মীয় প্রভাব ও মানব-কল্যাণের সাথে পারলৌকিক সম্পর্ক বিষয়ে মতামত তুলে ধরেছেন।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের স্বরূপ: বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে সৈয়দ আবুল হুসেন, আবুল ফজল, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মুসলিম সাহিত্য সমাজ শুধু জ্ঞান ও চিন্তাচর্চা করেননি; তারা ছিলেন স্বাধীন ও মুক্ত। এতে কোনো ভাবাবেগ ছিল না, এর পিছনে ছিল যুক্তিবাদী দৃষ্টি। ইয়ং বেঙ্গলদের আন্দোলনে যুক্তিবাদ ছিল। এ আন্দোলনে আবেগের কোনো স্থান ছিল না। এ আন্দোলনের সাথে জড়িতরা উগ্রপন্থি ছিলেন না। তারা সমাজের আমূল পরির্তন চাননি, তারা জেমসের আদর্শে সমাজের নবজীবন চেয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন মুসলমান সমাজের জীবন চিন্তাধারা ও গতির পরিবর্তন সাধন। তাদের মন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি। এ মন্ত্র তারা পেয়েছেন কামাল আতাতুর্কের কাছ থেকে। রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ ও হযরত মুহম্মদ (স) এর কাছ থেকে। এসব উক্তি থেকে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের উচ্চশিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে একত্রিত করা এবং তাদের মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতামত মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের তাৎপর্য:

মুসলিম সাহিত্য সমাজ পরিচালিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। নিচে এর তাৎপর্য বর্ণনা করা হলো:

মহামানবদের জীবনাদর্শ অনুসরণ: উনিশ শতকে রাজা রামমোহন, ডিরোজি ও অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীর সাধনায় বাংলাদেশে যে নবজাগরণের সূচনা হয় তার সাথে বাঙালি মুসলিম সমাজের কোনো আত্মিক যোগ ছিল না। ফলে বাঙালি মুসলিম সমাজ ছিল অনগ্রসর। মুসলিম সাহিত্য সমাজ পরিচালিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন অনগ্রসর বাঙালি সমাজকে মুক্ত স্বাধীন চিন্তার পথ দেখাল এবং বাঙালি মুসলিম সমাজে নবজাগরণ ঘটল। বাংলার রাজনৈতিক আকাশ যখন সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন তখনো প্রমথ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম সমস্ত বাঙালি সমাজের মধ্যে এবং কাজী ইমদাদুল হক ও মোহাম্মদ লুতফর রহমান বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে মানবতার আদর্শ প্রচার করে চলেছেন। এদের সাহিত্যাদর্শকে সামনে রেখেই ঢাকায় গড়ে উঠলো মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও তাদের পরিচালনায় “বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন।”

প্রগতিশীল চেতনা জাগ্রত করা: একটি বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুসলিম সাহিত্য সমাজ উনিশ ও বিশ শতকের বাংলায় তথা ভারতবর্ষে জাগরণ সৃষ্টির প্রয়াস পায় এবং বিশ্বের সর্বকালের প্রগতিশীল চেতনা থেকে শিক্ষা লাভ করে। বাংলাদেশে অনুন্নত দুলালিম সমাজের মধ্যে চিন্তার বিশ্বার ঘটানো এর লক্ষ্য। তারা বিশ্বাস করতেন “মানুষের যে জাগতিক জীবন, এ জাগতিক জীবন যদি সুন্দর না হয়, সুব্যবস্থিত ন। হয় তবে সত্যিকার নৈতিক জীবন, আধ্যাত্মিক জীবন তার পক্ষে সুদূর পরাহতই হয়ে থাকবে।”

মাতৃভাষা নির্ধারণ: উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা নিয়ে যে তর্কবিতর্কের শুরু হয় ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সময়েই তার অবসান ঘটে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাকেই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষারূপে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন।

জাতীয় বিষয় নিয়ে বিতর্কের আয়োজন: জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে হলে সেই সমস্যাকে কেন্দ্র করে আলাপ আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হয়। মুসলিম সাহিত্য সমাজ বাঙালি জাতির একটি বৃহত্তর অংশের পশ্চাদপদতার কারণ উদ্‌ঘাটন করতে গিয়ে প্রথমেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

সুশিক্ষিত সমাজ: মুসলিম সাহিত্য সমাজ পরিচালিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এ সত্য উপলব্ধি করতে পারে যে, বাঙালি মুসলমান সমাজকে শিক্ষার আলোকে উজ্জীবিত করতে না পারলে শিল্প সাহিত্যের কোনো মূল্য নেই। তাদের মতে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে যে অনন্ত সম্ভাবনা সুপ্তাবস্থায় আছে তাকে বিকশিত করে তোলা। “শিখা” পত্রিকায় এ সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে।

স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন: মুসলিম সাহিত্য সমাজ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের জন্য স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপক প্রচলন ও অবরোধ প্রথা উচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন। কাজটা খুব কঠিন ছিল। কারণ রক্ষণশীল গোষ্ঠী বিশ শতকের তৃতীয় দশকেও যথেষ্ট তৎপর ছিল।

মুসলমানদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি: বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলিম সাহিত্য সমাজ কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ সময় সমবায় পদ্ধতির আলোচনায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও সুদ আদান প্রদানের কথা উঠে। তবে ধর্মীয় কারণে এ সমস্যা সমাধানের কথা মুসলমান সমাজ চিন্তা করেনি। তা সত্ত্বেও মুসলিম সাহিত্য লেখকরা বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানই একটি জাতির শেষ উদ্দেশ্য হতে পারে না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, রেনেসাঁর অর্থ গণজাগরণ নয়, নবজাগরণ। তাই রেনেসাঁর সাধকরা রাজনীতিবিদদের মতো হাতেনাতে ফলাফল প্রয়াসী হতে পারে না। মুসলিম সাহিত্য সমাজের লেখকরাও রেনেসাঁর সাধক ছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সামজের সাফল্য এখানে যে, তারা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের সদস্যবৃন্দ তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি ব্যবহার করলেও তাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অধিবেশনে অভ্যাগতজনের উপস্থিতির তালিকা পরীক্ষা করলেই এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচক চারু বন্দ্যোপাধ্যায়। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের লক্ষ্য ছিল সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনা বাঙালি সমাজের কাছে তুলে ধরা। বাঙালি সমাজ বলতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাংলা ভাষাভাষী অধিবাসীকে বুঝায়। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির দিক থেকে এ সময়ের বাঙালি মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজ থেকে অনেক পিছনে পড়েছিল। মুসলিম সাহিত্য-সমাজকে তাই পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হয়েছে। তাই তাঁরা মুসলিম সাহিত্য-সমাজের বিভিন্ন অধিবেশনে প্রবন্ধপাঠ, আলোচনা ও ভাষণের মাধ্যমে মাতৃভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক সমস্যা, ললিতকলাচর্চা, ধর্মীয় রাজনীতির ব্যাখ্যা প্রভৃতি বিষয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজকে সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করেন। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের লেখকগণ ছিলেন রেনেসাঁর সাধক- তাই তাঁরা বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণে বিশাল প্রভাব ফেলে। মুসলিম সাহিত্য-সমাজেব সাফল্য এখানে যে, তাঁদের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই প্রগতির পক্ষে অগ্রসর হতে পেরেছে। সুতরাং বলা যায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের তাৎপর্য সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।