১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দেখা যায়। তবে এই পর্বে পূর্ব ইউরােপের যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসার ঘটেছিল তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যাই হােক, এর মূল কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল一

[1] সাম্যবাদের বিস্তার: পূর্ব ইউরােপের যুগােস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, রােমানিয়া, পােল্যান্ড ইত্যাদি দেশে সােভিয়েত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে রুশ সরকার সাম্যবাদের বিস্তার ঘটানাের উদ্যোগ নেয়। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিপরীত দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী আদর্শের বিস্তার শুরু হয়। মতাদর্শগত এই দ্বন্দ্বের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকার জন্য সােভিয়েত নেতৃত্ব পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েতীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়।

[2] সাম্যবাদী জোটের শক্তিবৃদ্ধি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি জোট বাঁধে। অপরদিকে সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সাম্যবাদী দেশগুলি জোটবদ্ধ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে মার্শাল পরিকল্পনা, টুম্যান নীতি প্রভৃতির প্রস্তাব ঘােষিত হয়। এই প্রস্তাবগুলির মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য দান ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রলােভন দেখিয়ে পুঁজিবাদী জোটে শামিল করানাের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এতে ভীত হয়ে সােভিয়েত রাশিয়া সাম্যবাদী জোটের শক্তি বৃদ্ধির জন্য পূর্ব ইউরােপের দেশগুলি দখল করার উদ্যোগ নেয়।

[3] সােভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তা ও আর্থিক সমৃদ্ধি: রুশরাষ্ট্র প্রধান স্ট্যালিন পূর্ব ইউরােপে একটি নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলায় বিধ্বস্ত সােভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতির জন্য নিরাপত্তা বজায় রাখার প্রয়ােজন দেখা দেয়। পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত সােভিয়েত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও সমৃদ্ধির জন্যই পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দরকার হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে, পূর্ব ইউরােপের দেশগুলির সম্পদ শােষণ ও দেশগুলিতে সােভিয়েত শিল্পজাত পণ্যের বাজার তৈরির লক্ষ্য নেওয়া হয়।

[4] অন্যান্য:

  • [i] সােভিয়েত সেনাদল পূর্ব ইউরােপকে জার্মান আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে পেরেছিল। তাই সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলিতে সােভিয়েত রাশিয়া সমধর্মী রাজনৈতিক কাঠামাে প্রবর্তনে আগ্রহী হয়।

  • [ii] পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত প্রভাবাধীন কিছু রাষ্ট্র থাকলে বিশ্ব রাজনীতিতে সােভিয়েতের শক্তিবৃদ্ধি ঘটবে। এই আশায় পূর্ব ইউরোপে সােভিয়েতীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

[1] ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি: পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে সােভিয়েতীকরণের প্রভাব হিসেবে ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ে। বিশ্ব রাজনীতিতে নিজ নিজ কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য দুই জোটের তরফ থেকে সামরিক জোট গড়ে তােলা শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ন্যাটো, সিয়াটো, মেডাে (পরবর্তীকলে সেন্টো), অ্যানজাস আর রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে ‘ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা’ গড়ে তােলা হয়। ওই সমস্ত সামরিক জোট গঠন বিশ্বশান্তির পক্ষে মােটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না।

[2] অ-কমিউনিস্ট শাসকদের উৎখাত: পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে প্রথমে কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্টদের নিয়ে যৌথ মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়। তারপরে অ-কমিউনিস্টদের উৎখাত করে কমিউনিস্টরা ক্ষমতার দখল নেয়। মন্ত্রীসভার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতর কমিউনিস্টদের অধীনে আনা হয়। সবশেষে অকমিউনিস্ট সমস্ত সদস্যকে মন্ত্রীসভা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে একচেটিয়া, একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

[3] সােভিয়েত বিরােধিতা ও স্বাধীন চেতনা: পূর্ব ইউরােপের বিভিন্ন দেশে সােভিয়েত একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ শুরু হয়। এইসব দেশ থেকে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক বিকাশের পরিণতি হিসেবে পরবর্তীকালে অর্থাৎ সােভিয়েত ভাঙনের পর সমাজতন্ত্রের বিদায় ঘটে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে জাতীয়তাবাদের পুনরুখান ঘটে।

[4] স্বশাসন প্রতিষ্ঠা: পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে সােভিয়েতীকরণের বিরুদ্ধে প্রকৃত স্বশাসনের দাবি ওঠে। পােল্যান্ড ও হাঙ্গেরির মতাে দেশে সােভিয়েত নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বশাসন প্রতিষ্ঠার দাবিতে একে একে সংগঠিত হয় গণ আন্দোলন। গােমুলকার নেতৃত্বে পােল্যান্ডে, ইমরে নেগির নেতৃত্বে হাঙ্গেরিতে আলেকজান্ডার ডুবসেকের নেতৃত্বে চেকোস্লোভাকিয়াতে, মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে যুগােয়াভিয়াতে সােভিয়েত-বিরােধী জাতীয় আন্দোলন চরমে পৌঁছােয়। এইভাবে সােভিয়েত নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয়।

[5] সােভিয়েত নিয়ন্ত্রণের অবসান: পূর্ব ইউরােপের দেশগুলিতে সােভিয়েতীকরণের মাধ্যমে সােভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আয়ু ছিল চার দশক। রাজনৈতিক প্রভূত্ববাদ, আর্থিক স্থবিরতা, চিন্তার দাসত্ব সমগ্র পূর্ব ইউরোপ জুড়ে এক নির্মম কৃত্রিম পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েতীকরণ ছিল কৃত্রিম, যান্ত্রিক, আরােপিত, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, নিয়ন্ত্ৰণবাদী ও আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা। সােভিয়েত রাষ্ট্রের তরফ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই কৃত্রিম শাসনব্যবস্থাকে কোনােরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই দেখা যায়, সােভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পর এই কৃত্রিম ব্যবস্থা তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়ে।